তোমারি জন্যে ভাসিয়েছি ভেলা

28

কবিতা তো প্রেমপত্র নয়
প্রেমের অধিক ধন,
যে বুঝেছে কাব্যকথা
সেই তো মহাজন।

কবিতা মূলত: মহাজনী শিল্প। ভাষা, ছন্দ, শব্দ আর কবির অর্ন্তচিন্তার যোগফল কবিতা। তাই কবিতায় প্রকাশ পায় কবির আত্মব্যঞ্জন ও হৃদয় স্পন্দন। কবি আশীষ সেন প্রেমিক হৃদয়ের কবি। এককথায় শিল্পের পাগলা কানাই, জাত প্রেমিক। আশীষ সেন সত্তর দশক থেকে আমাদের কবি পাড়ায় সরব। কবিতাই তার একমাত্র আরাধ্য দেবতা। দীর্ঘদিন কাব্য প্রেয়সীর সাথে যুত্তবন্ধ থাকলেও তিনি অত্যন্ত লাজুক স্বভাবের কবি। কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ২০০৭ সালে। “এক ক্লান্ত পদাদিক” নামের কাব্যগ্রন্থটি পাঠক হৃদয়ে বেশ আড়োলন সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছিল। ১৪ বছর বিরতির পর এবারের বইমেলা উপলক্ষে দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছে খ্যাতিমান প্রকাশনা সংস্থা চট্টগ্রামের বলাকা প্রকাশন। তাপস চক্রবর্তীর দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদে সুশোভিত গ্রন্থে কবির বাছাই করা ৩৪টি কবিতা স্থান পেয়েছে। গ্রন্থে প্রকাশিত প্রতিটি কবিতায় কবির কাব্য প্রতিভার স্বাক্ষর বিদ্যমান। তার কাব্য কর্মের মুন্সিয়ানায় আমি মুগ্ধ। আশীষের নতুন বই কবি হিসেবে তাকে অনেক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে বলে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। বিশেষ করে অপরাপর সমসাময়িক কবিদের চেয়ে তার কাব্য ভাষা ও ছান্দিক স্বকীয়তা সম্পূর্ণ বর্তমান প্রতিষ্ঠিত কবিদের নিজস্ব ধারার বাইরে গিয়ে আশীষ বাংলা কবিতায় তার একান্ত নিজস্বতা প্রমাণেও সফল। এই প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে অচিরেই আশীষ তার স্বীয় স্টাইল নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবেন বলে আমি বিশ্বাস করি। কবিতাকে সে তার প্রেমিকা রূপে সুপ্রতিষ্ঠিত করে জাগতিক নারী জৈবিকতা ও স্থুল প্রেমকে নির্বাসনে পাঠিয়ে কবিতাকে প্রেমিকার আসনে অধিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। তাই তার কবিতা হয়ে উঠেছে প্রেমের প্রতীক। কাঙ্খিত প্রেমের দেবী। এখানেই কবির সফলতা। যা, সমসাময়িক অন্য কবিদের কবিতায় অনুপস্থিতই বলা যায়।
কবি আশীষ সেন লেখেন কম। যা লেখেন তা কবিতা ছাড়া অন্যকিছু নয়। সুললিত ছান্দিক বৈশিষ্টে তার কবিতা সাবলিল, ঋদ্ধ ও পরিপুষ্ট।
নিঃসন্দেহে কবির গ্রন্থ কাব্য জগতে তাকে প্রতিষ্ঠিত কবির সুদৃঢ় আসনে অধিষ্ঠিত করতে সক্ষম।
নারী প্রেম আর কাব্যপ্রেম তার কাছে শিল্পের প্রাধান্যকেই অগ্রাধিকার দিয়েছে। যেমন চুম্বন কবিতায় তিনি বলছেন “বিজনে বিজনে খুঁজিছো লাল নীল কতো কবিতার বীজ”….অথবা
“আবেগের ভারে যদি না দিতাম—বনে উন্মুখ অঙ্কুর
চুম্বনের শস্য ক্ষেত্রে বিষন্ন সন্ধ্যায়…
জানি পোড়া জমি হয়ে যেতো সমুদ্র তোমার হৃদয়।”
অপর দিকে খোঁজ কবিতায় কবিতাকে কবি বলছেÑ
“আপনাকে জানা আমার কখনো ফুরাবে না,
ফুরাবে না….।
ঘরের দুয়ার থেকে দূরে দূরে বহুদূরে
আজও জানার টানে ভেসে বেড়াই
সবার হৃদয়পুরে।
এমনি তিনি তার প্রায় সব কবিতাতে প্রমাণ করেছেন, কবিতাই তার প্রেম এবং তিনি কাব্য প্রেমিক শিল্প মহাজন।
পরিশেষে এই বই সম্পর্কে কবি ও সাংবাদিক প্রদীপ খাস্তগীরের মুখে আমিও বলতে চাইঃ
“কবিতা রোদ-বৃষ্টির মতো আশা জাগানিয়া। তবু মাঝে মাঝে তপ্ত দহনে এগিয়েছে মানুষের জীবন…
কবি আশীষ সেন- কবিতা লালন করেন মননে, জানেন এবং বুঝেন কবিতার ভাষা।
প্রেম-অপ্রেমের ব্যঞ্জনা, প্রাণ-প্রকৃতির রাগ-অনুরাগের সমন্বয়ে কবি আশীষ সেন কবিতায় সংসার পাতেন নিরন্তন। “তোমারি জন্য ভাসিয়েছি ভেলা” কবি আশীষ সেনের দ্বিতীয় কবিতা কিতাব। এটি একটি অপরূপ নিপুণ কাব্যপ্রতিমা। ছন্দে-গন্ধে, ভাঙা গড়ায় নিজেকে বারবার ঋদ্ধ করেছেন।
জয়তু কবি আশীষ সেনÑ আপনার জয় হোক। জয় হোক কবিতার।