তুরস্ক ও সিরিয়ার ভয়াবহ ভ‚মিকম্প থেকে আমরা কী শিক্ষা নিতে পারি

11

মো. দিদারুল আলম

তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা প্রাায় ৩৭ হাজার ছাড়িয়েছে। এখনো বহু মানুষ ধ্বংসস্ত‚পের নিচে চাপা পড়ে আছেন। তাঁদের উদ্ধারে চলছে তৎপরতা। তবে সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আটকে পড়া এসব মানুষের জীবিত থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসছে। এদিকে তুরস্কে উদ্ধারকাজে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তীব্র ঠাÐা, বৃষ্টি, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ বহুবিধ সমস্যা। আশ্রয়, খাবার, পানি, জ্বালানি ও বিদ্যুতের অভাবে চরম দুর্দশায় রয়েছেন উপদ্রæত এলাকাগুলোর বেঁচে থাকা মানুষেরা। ফলে তাঁদের মধ্য থেকেও অনেকের মৃত্যু হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সিরিয়ার অবস্থা আরও খারাপ। দেশটির ভূমিকম্প কবলিত এলাকাগুলো সরকার ও বিদ্রোহী দুই পক্ষের নিয়ন্ত্রণে থাকায় সহায়তা পৌঁছানো নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এবং সিরিয়ার উত্তরে ৬ ফেব্রæয়ারি ভোরে আঘাত হানে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প। গত এক দশকের মধ্যে এটিকে সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প হিসেবে উল্লেখ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তুরস্ক-সিরিয়ার মতো বাংলাদেশও ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা। ঐতিহাসিকভাবে এদেশেও ১৮৭০ থেকে শুরু করে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত তুরস্কের মতো বা এর চেয়ে বড় ধরনের, যেমন-৭ দশমিক ৫ ও ৮ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। আমাদের এখানে মোটামুটি ৫টি ফল্ট লাইন আছে। ১৮৯৭ সালে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের একটি ফল্ট লাইনে ৮ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। সীমান্ত এলাকায় এরকম আরও ২-৩টি ফল্ট লাইন আছে। দেশের ভেতরেও বঙ্গবন্ধু সেতুর আশপাশে এবং নোয়াখালীতে এরকম ফল্ট লাইন আছে।’
আমাদের এখানে বিল্ডিং কোড সঠিকভাবে মানা হচ্ছে কি না, এটাও একটা বড় ইস্যু। ১৯৯৬ সাল থেকে যেহেতু আমাদের বিল্ডিং কোড আছে, সেহেতু এই সময়ের পর থেকে নির্মিত বহুতল ভবনগুলো ভালো অবস্থায় থাকবে বলে বিশ্বাস করি। তবে আমাদের পুরনো ২-৩ বা ৫ তলার যেসব ভবন আছে, যেগুলো ভূমিকম্প সহনীয় নয়, সেগুলো যদি বিধ্বস্ত হয়, সেক্ষেত্রে প্রথমত এখনই সেগুলোকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। দ্বিতীয়ত, উদ্ধারকাজের জন্য নিয়মিত কিছু মহড়া করে করে প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। কিন্তু তা তো হচ্ছে না। সরঞ্জাম কেনা আছে, কিন্তু সেগুলো গত ১০ বছর ধরে ব্যবহৃতই হচ্ছে না। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার সময় অল্প কিছু ব্যবহৃত হয়েছিল। কিন্তু তারপর আর হয়নি।
যেকোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও আমাদের ভূমিকম্প মোকাবেলায় তেমন কোনো প্রস্তুতি নেই বললেই চলে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তুরস্কের মতো বড় ভূমিকম্প বাংলাদেশে হলে উদ্ধার কাজ পরিচালনা করাই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। রাজধানী ঢাকার মতো বড় শহরগুলোতে যে পরিমাণ অপরিকল্পিত বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে তাতে ভূমিকম্পে এসব ভবন ধসে পড়লে শহরগুলো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। যার কারণে ব্যাহত হবে উদ্ধার কাজ। কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় মৃদু ভূকম্পন অনুভূত হচ্ছে। যখনই এসব ছোটখাটো ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটে, তখনই আমাদের মনে আতঙ্ক তৈরি হয়। সবাই নড়েচড়ে ওঠে। গণমাধ্যমেও বিষয়টি নিয়ে খবর প্রকাশিত হয়। এরপর অনেক দিন ভূমিকম্প না হলে সেই আতঙ্ক কেটে যায়। এই ভুলে যাওয়াটা আমাদের জন্য কী ধরনের বিপদ তৈরি করছে তা গুরুত্ব দিয়ে ভাবা দরকার।
ভূমিকম্পের সময় সবচেয়ে উত্তম পন্থা হলো ‘ড্রপ-কাভার-হোল্ড অন’ বা ‘ডাক-কাভার’ পদ্ধতি। অর্থাৎ কম্পন শুরু হলে মেঝেতে বসে পড়ুন। তারপর কোনো শক্ত টেবিল বা ডেস্কের নিচে ঢুকে কাভার নিন, এমন ডেস্ক বেছে নিন বা এমনভাবে কাভার নিন যেন প্রয়োজনে আপনি কাভারসহ মুভ করতে পারেন।
ভূমিকম্পের সময় এলিভেটর-লিফট ব্যবহারও উচিত নয়। রাতে বিছানায় থাকার সময় ভূমিকম্প হলে রেডক্রস বলছে, বিছানায় থেকে বালিশ দিয়ে কাভার নিতে, কারণ সিলিং ধসবে না, কিন্তু ফ্লোরে নামলে অন্যান্য কম্পনরত বস্তু থেকে আঘাত আসতে পারে। ভূমিকম্পের সময় আগুন লেগে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেড়ে যেতে পারে। এমন পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে যত দ্রæত সম্ভব রান্না ঘরের গ্যাস, তেল বা ইলেক্ট্রিক চুলা বন্ধ করুন। মনে রাখবেন যত ছোট ভূমিকম্পই হোক না কেন চুলা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।
যেসব প্রাণি মাটির নীচে থাকে তারা তাদের অত্যন্ত সংবেদনশীল ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সেগুলো টের পেয়ে মাটির উপরে চলে আসে। ২০০৯ সালে চীনে ভূমিকম্পের আগে অনেক ব্যাঙ রাস্তায় উঠে এসেছিলো। এসব দেখেও আমরা সতর্ক হতে পারি। ভূবিদদের এক পরিসংখানে দেখা গেছে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে কেবল রাজধানী ঢাকার প্রায় ৩ লাখ ২৬ হাজার অবকাঠামোর মধ্যে ৭২ হাজার ভবন ধসে যাবে। তাই সচেতন হওয়ার পাশাপাশি যথাযথ উদ্যোগও নিতে হবে। যাতে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা নিম্নতম পর্যায়ে রাখা যায়। ভয়কে জয় করতে হবে। ভূমিকম্প থেকে বাঁচার উপায় বের করতে হবে।
প্রত্যেক এলাকার স্কুল, কর্পোরেট অফিস, অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদি ক্যাম্পেইন চালু রেখে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। যেহেতু আমাদের দেশের সরকারি স্কুল বা প্রতিষ্ঠানগুলো কাঠামোগতভাবে দুর্বল, সে ক্ষেত্রে প্রত্যেক মসজিদে বয়ানসহ ঐ এলাকার যোগাযোগের মাধ্যমে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে মসজিদকেই গড়ে তুলতে হবে। প্রস্তুত রাখতে হবে সোলার বা ব্যাটারি চালিত লাইট, রেডিও, বালিশ, পানি, শুকনা খাবার। একমাত্র সাবধানতাই পারে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে জানমালের রক্ষা করতে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক