তীব্র বেগে আঘাত হানবে ‘আম্ফান’

75

করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাব মোকাবেলার মধ্যেই দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হয়েছে শতাব্দীর সর্বোচ্চ বিধ্বংসী ক্ষমতাসম্পন্ন সুপার সাইক্লোন ‘আম্ফান’। দ্রুততম সময়ে ধরন পরিবর্তন এবং বাতাসের গতিবেগের তীব্রতার মাপকাঠিতে আম্ফান এরইমধ্যে অতীতের অনেক রেকর্ডই ভেঙে দিয়েছে। গতকাল সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়টির অভিমুখ ছিল ভারত ও বাংলাদেশের সুন্দরবন অঞ্চলের দিকে। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, পরবর্তী চব্বিশ ঘণ্টায় সমুদ্রবক্ষ থেকে উপকূলের দিকে এগিয়ে আসার সময় গতিপথ পরিবর্তন না করলে আজ শেষরাত থেকে আগামীকাল বুধবার সন্ধ্যার মধ্যেই উপকূল অতিক্রম করতে পারে। চট্টগ্রামসহ দেশের সমুদ্রবন্দর ও উপকূলীয় জেলাগুলো থেকে স্থানীয় সতর্ক সংকেত নামিয়ে যথাক্রমে ছয় ও সাত নম্বর বিপদ সংকেত জারি করা হয়েছে।
আবহাওয়ার গতিপথ পর্যবেক্ষণকারী দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, এখন পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে যতগুলো ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যে ‘আম্ফান’ বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগের দিক থেকে এযাবতকালের সবচেয়ে বিধ্বংসী ক্ষমতাসম্পন্ন ঘূর্ণিঝড়। প্রতি এক মিনিট স্থিতিকালে গতকাল সোমবার রাত আটটার দিকে ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের গতি ছিল দুইশ’ ৭০ কিলোমিটার। যা সর্বোচ্চ দমকা হাওয়ার আকারে ঘন্টায় তিনশ’ ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। মৌসুমী বায়ু প্রবেশের আগে এই শতাব্দীতে বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া এটাই প্রথম সুপার সাইক্লোন। বাতাসের গতিবেগের তীব্রতার পাশাপাশি মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার ব্যবধানে এটির ঘূর্ণিঝড় থেকে ‘অতি প্রবল’ ঘূর্ণিঝড় বা ‘সুপার সাইক্লোনে’ পরিণত হওয়াও নতুন রেকর্ড। গত কয়েকদিন ধরে সাগরে অবস্থানকালে ঘূর্ণিঝড়টি প্রচুর পরিমাণে জলীয় বাষ্প শুষে নিয়ে ব্যাপক শক্তি সঞ্চয় করেছে। এর মধ্যেই আম্ফান ঘণ্টায় দেড়শ’ কিলোমিটারেরও বেশি গতিবেগসম্পন্ন ঝোড়ো বাতাসকে তালুবন্দী করেছে। এর আগে সর্বশেষ ২০০৭ সালের জুনে আরব সাগরে একই শক্তিমত্তার সুপার সাইক্লোন ‘গোনু’ তৈরি হয়েছিল। যেটা পরে ওমানের দিকে সরে যায়। সুপার সাইক্লোনে বাতাসের তীব্র গতিবেগের কারণে উপকূলীয় এলাকায় জলোচ্ছ¦াস এবং ঘরবাড়ি ও গাছপালার ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি বেশি থাকে। এছাড়া, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে প্রবল ভারিবর্ষণ হতে পারে উপকূলীয় এলাকসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
ঘূর্ণিঝড় আম্ফান নিয়ে গতকাল সোমবার সন্ধ্যা ছয়টায় দেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ স্বাক্ষরিত সর্বশেষ (ক্রমিক নম্বর ১৯) বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পশ্চিম-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ’আম্ফান’ উত্তর দিকে অগ্রসর ও ঘনীভূত হয়ে সুপার সাইক্লোন আকারে বর্তমানে একই এলাকায় অবস্থান করছে। এটি সোমবার সন্ধ্যা ছ’টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে এক হাজার ৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার উপকূল থেকে নয়শ’ ৯০ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে নয়শ’ ৫৫ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে নয়শ’ ৪০কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল। এটি আরও উত্তর দিকে অগ্রসর হতে পারে এবং পরবর্তীতে দিক পরিবর্তন করে উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে খুলনা ও চট্টগ্রামের মধ্যবর্তী অঞ্চল দিয়ে আজ মঙ্গলবার শেষরাত থেকে আগামীকাল বুধবার বিকাল বা সন্ধ্যার মধ্যে দেশের উপকূল অতিক্রম করতে পারে। সুপার ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৯০ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘন্টায় দুইশ’ ২৫ কিলোমিটার যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে দুইশ’ ৪৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুপার ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের কাছে সাগর খুবই বিক্ষুব্ধ রয়েছে। মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরসমূহকে সাত নম্বর বিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, ল²ীপুর, চাঁদপুর এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহ সাত নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে। অপরদিকে, চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরকে ছয় নম্বর বিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। একইসাথে উপকূলীয় জেলা নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহ ছয় নম্বরবিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে। ঘূর্ণিঝড় এবং অমাবস্যার প্রভাবে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, ল²ীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে চার থেকে ফুট অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ¡াসে প্লাবিত হতে পারে। ঘূর্ণিঝড় উপকূল অতিক্রমকালে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, ল²ীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম জেলাসমূহ এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহে ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণসহ ঘন্টায় একশ’ ৪০ থেকে একশ’ ৬০ কিলোমিটার বেগে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সকল মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে অতিসত্ত¡র নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।
প্রতিবেশি দেশ ভারতের বেসরকারি আবহাওয়া পূর্বাভাস সংস্থা স্কাইমেট জানিয়েছে, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় আম্ফান গতকাল সোমবার দিনের প্রথম ভাগেই সর্বোচ্চ তীব্রতার একটি ‘সুপার সাইক্লোনে’ পরিণত হয়েছে। এই ঘূর্ণিঝড়টি আগামীকাল বুধবার বিকেল থেকে সন্ধ্যা নাগাদ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত দিঘা থেকে শুরু করে বাংলাদেশের হাতিয়া দ্বীপের মধ্যবর্তী সমুদ্রতটের কোনও একটি এলাকার ওপর দিয়ে উপকূলে আছড়ে পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। উপকূলের কাছাকাছি এলে এই অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের শক্তির তীব্রতা সামান্য কমবে। তবে তার পরেও এর বিধ্বংসী ক্ষমতাকে খাটো করে দেখার কোনও সুযোগ নেই। সাধারণত স্থলভূমি থেকে শুষ্ক বাতাস এসে ঘূর্ণিঝড়ের বাতাসের গতিবেগ ও ক্ষমতাকে কিছুটা দুর্বল করে দেয়। সুপার সাইক্লোন আম্ফানের ক্ষেত্রেও একই ধরনের প্রভাব পড়বে। তবুও এটি যেহেতু একটি সুপার সাইক্লোন, সেহেতু ঘূর্ণিঝড়টির তান্ডবলীলা চালানো বা ক্ষয়ক্ষতি সাধনের ক্ষমতা মারাত্মক।
উল্লেখ্য, দেশে এর আগে ১৯৭০ সালে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। এরপর ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ‘ম্যারি এন’ চট্টগ্রামসহ দেশের উপকূলীয় এলাকায় এক লাখ ৩৮ হাজার মানুষের জীবন কেড়ে নেয়। প্রায় একই ধরনের আরেকটি ঘূর্ণিঝড় ছিল ২০০৭ সালের ‘সিডর’। যদিও তাতে মানুষের মৃত্যুর হার তুলনামূলক কম ছিল। সিডরে প্রাণ হারায় তিন হাজার চারশ’ ছয় জন। এর দু’বছরের মাথায় ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’র আঘাতে মারা যায় একশ’ ৯০ জন। আর ২০১৩ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘মহাসেন’-এ মারা যায় ১৮ জন। এভাবে ২০১৫ সালে ঘুর্ণিঝড় ‘কোমেন’, ২০১৬ সালে ‘রোয়ানু’, ২০১৭ সালে ‘মোরা’ দেশের উপকূলীয় জেলাগুলোতে ভয়ঙ্কর তান্ডবলীলা চালায়। ততে প্রাণহানি না হলেও ঘরবাড়ি ও গাছপালাসহ সম্পদহানি ঘটেছিল। সর্বশেষ ২০১৯ সালে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’ ও ‘বুলবুল’। যদিও এ দুটি ঘূর্ণিঝড় প্রতিবেশি দেশ ভারতের উপকূলীয় কয়েকটি রাজ্যের স্থলভাগে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে অনেকটা শক্তি হারিয়ে দেশের উপকূল অতিক্রম করে। ফলে দেশের উপকূলীয় এলাকায় বড় ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারেনি।