তীব্র গরমে পুড়ছে দেশ

6

পূর্বদেশ ডেস্ক

বৈশাখের তপ্ত গরমে দেশজুড়ে বিপর্যস্ত অবস্থা। ৯ অঞ্চলে তীব্র তাপপ্রবাহ বইছে। এরমধ্যে দুই জেলায় চলছে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ। সর্বোচ্চ তাপমাত্রায় চুয়াডাঙ্গাকে ছাড়িয়েছে যশোর, পারদ উঠেছে ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল চুয়াডাঙ্গায় ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগে ১৯৬৪ সালে যশোরে ৪৪ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছিল। আর পাবনা জেলার ঈশ্বরদীতেও পরে অতি তীব্র তাপপ্রবাহের খবর দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর, সেখানে তাপমাত্রা পৌঁছেছে ৪২ ডিগ্রিতে।
দেশজুড়ে এমন খরতাপ পরিস্থিতিতে দেশের সব স্কুল-কলেজ সাত দিনের ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। ঈদের ছুটি শেষে আজ রোববার খোলার কথা থাকলেও তা এখন খুলবে ২৮ এপ্রিল। তাপপ্রবাহের কারণে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা বিবেচনায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
আবহাওয়াবিদ কাজী জেবুন্নেছা গণমাধ্যমকে বলেন, আজকে (শনিবার) দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে যশোরে।
তিনি বলেন, ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত বছর ঢাকায় সবচেয়ে বেশি সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আগামী দিনগুলোতে সিলেট এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে দু-এক জায়গায় হালকা বৃষ্টি হতে পারে। আসলে বলার মতো তেমন কোনো বৃষ্টি এ মাসের বাকি দিনগুলোতে নেই।
আগামী দু’তিনদিন তাপমাত্রা আরো বাড়তে পারে জানিয়ে জেবুন্নেছা বলেন, আগামী ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত তাপমাত্রা মোটামুটি এরকমই থাকবে। তেমন বিস্তৃত পরিসরে ভারী বৃষ্টির কোনো পূর্বাভাস নেই। আগের তুলনায় এখন জলীয়বাষ্পের পরিমাণ কমে আসছে। এটি একটি ভালো দিক। অস্বস্তি কিছুটা কম হবে। তবে তাপমাত্রা ক্রমেই বাড়ছে
এর আগে গত শুক্রবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছিল চুয়াডাঙ্গায়। শুক্রবার ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৮ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এদিকে গতকাল চুয়াডাঙ্গা ও পাবনায় ‘তীব্র গরমে’ দুজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বজনরা। সকালে দামুড়হুদা উপজেলায় কৃষিজমিতে কাজ করার সময় আমির হোসেন ও দুপুরে পাবনার রূপকথা রোডে দোকানে চা পানের সময় সুকুমার দাস অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে হাসপাতালে নিয়ে গেলে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। তবে তারা ‘হিটস্ট্রোকে’ মারা গেছেন কিনা তাৎক্ষণিকভাবে তা নিশ্চিত করে জানাতে পারেননি চিকিৎসকরা।
জাকির হোসেন (৩৩) দামুড়হুদা উপজেলার ঠাকুরপুর গ্রামের আমির হোসেন ছেলে। তিনি ঠাকুরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দফতরি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সুকুমার দাস (৬০) পাবনা শহরের শালগাড়িয়া এলাকার জাকিরের মোড়ের বাসিন্দা।পাবনায় গতকাল সর্বোচ্চ ৪১ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে; যা পাবনা জেলায় চলতি মৌসুমের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা।
একসঙ্গে এত অঞ্চলের তাপমাত্রা এত বেশি হওয়ার রেকর্ড বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে উঠেছে কিনা, তার সঠিক তথ্য এখনও বের করতে পারেনি আবহাওয়া অধিদফতর। সংস্থাটি বলছে, আবহাওয়া এমন থাকতে পারে আগামী এক সপ্তাহ পর্যন্ত। আগামীতে তাপমাত্রা ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়াতে পারে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেছে তারা। প্রসঙ্গত, গত বছর পাবনায় একদিন তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি রেকর্ড করা হয়েছিল।
সূর্যাস্তের পর তাপমাত্রা কমলেও মিলছে না স্বস্তি। সারাদিনের তীব্র তাপপ্রবাহে শরীরের ত্বক পুড়ে যাওয়ার উপক্রম। এমন পরিস্থিতিতে তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকবে জানিয়ে হিট অ্যালার্ট জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
যদিও দেশে তাপপ্রবাহ মে এবং জুন মাসে বাড়ে। কিন্তু এ বছর এপ্রিলের শুরু থেকেই তাপ বৃদ্ধির পারদ ঊর্ধ্বমুখী হয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় উচ্চ তাপমাত্রা অনুভ‚ত হচ্ছে। ফলে, অনেকটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা।
গতকাল শনিবার বেলা ৩টায় যশোরে চলতি বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। শহরের বারান্দিপাড়া কদমতলার মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, দুপুর থেকে যেন আগুনের হল্কা ছাড়ছে প্রকৃতি। কোনো কাজ করাই সম্ভব হচ্ছে না এই গরমে।
অপরদিকে চুয়াডাঙ্গায় ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাটিতে টানা ১৪ দিন ধরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বিরাজ করছে।
এর আগে শুক্রবার (১৯ এপ্রিল) রাজধানী ঢাকায় ৩৮ ডিগ্রি, সাতক্ষীরা ও টাঙ্গাইলে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ৪০ দশমিক ২, খুলনায় ৪১ ডিগ্রি, খুলনার মোংলা, রাজশাহী ও পাবনার ঈশ্বরদীতে ৪১ এবং যশোরের তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি।
আবহাওয়া অধিদফতরের সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। দেশের উপর দিয়ে চলমান তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে এবং তাপমাত্রা আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। এছাড়া, জলীয়বাষ্পের আধিক্যের কারণে বৃদ্ধি পেতে পারে অস্বস্তি। এই তাপপ্রবাহ সহসাই কমছে না। আরও বেশ কয়েকদিন তাপমাত্রা এমন উষ্ণ থাকবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
এমন তীব্র দাবদাহে দুর্বিষহ অবস্থা পার করছেন দেশের খেটে খাওয়া মানুষগুলো। এছাড়া তাপদাহে গত কয়েকদিনে ডিহাইড্রেশন, জ্বর ও হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন অনেকে। বিশেষ করে শিশু ও গর্ভবতী মায়েরা বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন। অনেককে হাসপাতালে চিকিৎসাও নিতে হয়েছে।
এদিকে চলমান তাপপ্রবাহের মধ্যে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা বিবেচনায় সব স্কুল-কলেজ ৭ দিনের ছুটি ঘোষণা দিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর। আগামী ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত সব এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, অন্তত টানা ৫ দিন কোনো এলাকায় গড় তাপমাত্রার চেয়ে তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি অব্যাহত থাকলে ঐ ঘটনাকে দাবদাহ বলা হয়। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে মৃদু দাবদাহ ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে মাঝারি দাবদাহ এবং ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রাকে তীব্র দাবদাহ হিসেবে বিবেচনা করে।
এই মৌসুমে তাপমাত্রা বেশি থাকার জন্য অপরিকল্পিত উঁচু ভবন, জমি ভরাট, ভারী যানবাহন নির্গমন, এয়ার কন্ডিশনার এবং জীবাশ্ম জ্বালানির অতিরিক্ত ব্যবহার এবং বৃক্ষ নিধনকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ছাড়া ‘এল নিনো’ ও একটা কারণ বলে মনে করছেন অনেকে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এল নিনোর কারণে মানবসৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে পৃথিবীর নানা প্রান্তে তৈরি হতে পারে খাদ্য, পানি ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার ঝুঁকি। মূলত এটি হচ্ছে, প্রশান্ত মহাসাগরের নিরক্ষরেখার দক্ষিণের আবহাওয়ার এলোমেলো আচরণ। সাধারণত দুই থেকে সাত বছর পরপর এল নিনো পরিস্থিতি তৈরি হয়। যা ১৮ মাসের বেশি সময় পর্যন্ত স্থায়ী হয়ে থাকে। যা আবহাওয়ার বিশেষ নেতিবাচক অবস্থাকে বোঝায়। প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্য ও পূর্ব অংশে সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা যখন স্বাভাবিকের চেয়ে ছাড়িয়ে যায় তখন তাকে এল নিনো বলা হয়।
তাপমাত্রা এমন অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা জানান, বায়ুমÐলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের স্তর ঘন হচ্ছে এবং স্থল ও সমুদ্র উভয় ক্ষেত্রেই তাপমাত্রা বাড়ছে। যেহেতু আমরা এল নিনো পর্যায়ে প্রবেশ করছি, শুষ্ক আবহাওয়া আরও কয়েক বছর অব্যাহত থাকবে।
আবহাওয়া অধিদপ্তার জানায়, চলমান তাপপ্রবাহ বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটে অস্থায়ী দমকা হাওয়াসহ বজ্রবৃষ্টি হতে পারে। রয়েছে শিলাবৃষ্টির আশঙ্কা। বাগেরহাট, যশোর চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়ায় তীব্র তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকবে। পাশাপাশি মে মাসও উত্তপ্ত মাস হিসেবে বিবেচিত হবে। মে মাসেও তীব্র গরম থাকবে। সর্বোচ্চ ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস উঠতে পারে তাপমাত্রা।
এদিকে চট্টগ্রামেও গরমে জনজীবন বিপর্যস্ত। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন কৃষক, দিনমজুর, রিকশাওয়ালাসহ শ্রমজীবী মানুষেরা। এছাড়া বেশি ঝুঁকিতে বয়স্করা, বিশেষ করে যারা বিভিন্ন রোগে ভুগছেন। গরমে ঘরের ভেতরেও টেকা দায়। ফ্যানের বাতাসে গরম কাটে না।
গত শুক্রবার বোয়ালখালীর পশ্চিম শাকপুরা ২ নম্বর ওয়ার্ড আনজিরমার টেকস্থ সৈয়দ আলমের নতুন বাড়িতে মোছাম্মৎ সাফা নামের ছয় মাস বয়সী একটি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। মায়ের বুকের দুধ খেয়ে ঘুমানোর কিছুক্ষণ পর শিশুটিকে মৃত অবস্থায় পান তার বাবা-মা। পরিবারের ধারণা, সে হিট স্ট্রোকে মারা গেছে।
এদিকে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে গরমের তীব্রতা। তীব্র গরমে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। এতে খেটে খাওয়া মানুষ সীমাহীন কষ্ট ভোগ করছেন। দাবদাহ উপেক্ষা করেই মাঠেঘাটে কাজ করছেন তারা, চালাচ্ছেন রিকশা, ঠেলাগাড়ি।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এখন ঝড়-বৃষ্টির মৌসুম। তবে ঝড়ের সঙ্গে যদি পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হয় তাহলে গরম কমার সম্ভাবনা নেই।