পূর্বদেশ ডেস্ক
দার্জিলিং পাহাড়ে ৩টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার। দেশটির সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিকল্পিত ৩টি প্রকল্পের মধ্যে ২টি তিস্তার শাখা নদীতে হওয়ায় বাংলাদেশে পানির প্রবাহ আরও কমে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে; বিশেষত ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যে।
এছাড়া দুইটি নতুন খাল কেটে তিস্তার পানি প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে পশ্চিমবঙ্গ। ওই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলার আরও কৃষি জমিকে সেচের আওতায় আনতে পশ্চিমবঙ্গ এ উদ্যোগ নিয়েছে। এর মাধ্যমে তিস্তা কেন্দ্রিক পানি সংকট আরও বেড়ে বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন বাংলাদেশি পানি বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে ভারতের গণমাধ্যমে প্রকাশিত এ খবর সঠিক কি না, তা দেশটির কাছে জানতে চাইবে বাংলাদেশ। এ লক্ষ্যে ভারতে চিঠি পাঠানোর প্রস্তুতি চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে।
টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, এই ৩টি ছাড়াও ১০টি ছোট জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ডিপিআর তৈরির নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে ভারত। পরিকল্পিত জলবিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ‘রান অব দ্য রিভার’ প্রকল্প বলা হচ্ছে। এর অর্থ হলো, জলবিদ্যুৎ তৈরির জন্য ব্যবহৃত পানি আবার নদীতে ফেরত দেওয়া।
এ বিষয়ে পানি বিশেষজ্ঞদের অভিমত, আগেও ভারতের এ ধরনের অনেক প্রকল্পকে রান অব দ্য রিভার বলা হয়েছে। কিন্তু কারিগরিভাবে তা হয় না। তাই ভারতের নতুন এ প্রকল্প দূরভিসন্ধিমূলক কি না সেটাও যৌথ পরিদর্শন করে দেখা দরকার। ভারতের উচিত প্রকল্পের পুরো তথ্য বাংলাদেশকে জানানো।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, মমতা বন্দোপাধ্যায় বলছেন যে, তিস্তায় জল নেই। তারপর তিনি বললেন, সিকিম জল আটকে রেখেছে। পানি তো আর এমনি আটকানো যায় না, জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের নামেই পানি আটকে রাখা যায়। সিকিম বলছে, তাদের জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের ড্যামগুলোর সবই রান অব দ্য রিভার। অর্থাৎ তারা নদীর পানি নদীতে ছেড়ে দেবে। এটা তখনই সম্ভব যখন অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হয় বা বরফ গলা পানি যখন আসে তখন সেটা জমা করে ছেড়ে দেওয়া যায়।
যখন ভাটিতে নিম্নতম প্রবাহের উপরে পানি থাকে; জমা পানি ছেড়ে দেওয়া তখনই তা অর্থবহ হয়। অর্থাৎ এজন্য নদীতে নিম্নতম প্রবাহ থাকতে হবে। তিস্তায় যে পরিমাণ পানি ছিল, ওই পরিমাণ প্রবাহই যদি থাকে তাহলে বুঝতে হবে নদীর পানি নদীতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ভারত সরকার দার্জিলিং পাহাড়ে ৩টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করতে যাচ্ছে। যদি রান অব দ্য রিভার বাস্তবেই হতো তাহলে ‘তিস্তায় জল নেই’ বলতে হতো না, তিস্তায় পানি থাকতো।
তাই রান অব দ্য রিভার ধারণাটি ঠিকঠাক কাজ করছে কি না- তা বোঝার জন্য বাংলাদেশকেই উদ্যোগী হয়ে যৌথ পরিদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে বলে মনে করেন পানি বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, যৌথ পরিদর্শন করে দেখা দরকার, এটা আসলে রান অব দ্য রিভার, নাকি ভাটির মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করার একটি দূরভিসন্ধিমূলক প্রকল্প।
ভারতের কাছে ব্যাখ্যা চাইবে বাংলাদেশ
ভারতের গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, দুইটি নতুন খাল কেটে তিস্তার পানি প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে পশ্চিমবঙ্গ। খবরটি সঠিক কি না, তা দেশটির কাছে জানতে চাইবে বাংলাদেশ। এ লক্ষ্যে ভারতে চিঠি পাঠানোর প্রস্তুতি চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের পানি বণ্টন বিষয়ে বাংলাদেশ অংশের বহুপক্ষীয় বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক। তিনি বলেন, চিঠি খসড়া তৈরি হয়ে আছে। শিগগির সেটা ভারতে কাছে পাঠানো হবে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, তিস্তা থেকে পানি প্রত্যাহার পরিকল্পনার বিষয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমের বরাতে বাংলাদেশে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এটা আমাদের নজরে এসেছে। কিন্তু আমরা অফিসিয়ালি ভারতের কাছ থেকে জানতে পারিনি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যটি সত্য কি না, তা জানার পর এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাবে বাংলাদেশ। এ কারণে ভারত থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তথ্য পাওয়ার আগে কোনো মন্তব্য করবো না। আগে ভারত থেকে তথ্য পাই, তারপরে বলবো।
যদি ঘটনা সত্য হয় তাহলে সেটা উদ্বেগের কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে জাহিদ ফারুক বলেন, অবশ্যই সেটা উদ্বেগের বিষয় হবে। কিন্তু আমরা সবসময় আমাদের বন্ধু ভাবাপন্ন রাষ্ট্র হিসেবে সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার নীতিতে চলি। সেটা যদি না হয়, তাহলে আমাদের তো অপশন আছে। কী অপশন আছে, সেটা তো আপনাদের (সাংবাদিকদের) বলবো না।
তিনি আরও বলেন, ভারতীয় জলমন্ত্রীর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকের প্রস্তুতিও চলছে। আগামী এপ্রিল মাসের মধ্যে ভারতীয় পক্ষকে বৈঠক অনুষ্ঠানের আহবান জানানো হয়েছে। আমাদের প্রস্তাবে তারা মৌখিকভাবে ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে। আনুষ্ঠানিক দিন-তারিখ নির্ধারণ হলে আপনারা জানতে পারবেন।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভারতে সঙ্গে পানি বণ্টন সমস্যা সমাধানের দুইটি পথ, টেকনিক্যাল আলোচনা ও রাজনৈতিক আলোচনা। আমার মতে এ সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ রাজনৈতিক আলোচনা। কিন্তু আমাদের দেশ থেকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই টেকনিক্যাল আলোচনার বিষয়ে জোর দেওয়া হয়। এভাবে বাংলাদেশ ভালো অবস্থান বজায় রাখতে পারবে না।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি এক দশকের বেশি সময় ধরে ঝুলে আছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বলছে- তারা তিস্তা চুক্তি করতে রাজি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের আপত্তির কারণে হচ্ছে না। অন্যদিকে, বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি দেশের কেন্দ্রীয় সরকারের ইশারা ছাড়া কোনো রাজ্য সরকার বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক চুক্তির বিষয়ে বাধা দেবে, এটা কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।