তালেবান-আমেরিকা যুদ্ধ, জিত কার?

6

 

যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে থাকবে কেন? তারা টুইনটাওয়ার হামলার প্রতিশোধ নিয়ে নিয়েছে কড়ায়গন্ডায়। প্রায় সমস্ত মুসলিম রাষ্ট্রে আজ তাদের সৈন্য। ইরাকের সাদ্দাম হোসেন পরিবারকে ‘উচিত শিক্ষা’ দিয়ে উৎখাত করে দিয়েছে! তাদের করতলগত হয়েছে দেশটি। হাজার হাজার তালেবান, আলকায়দা সদস্যকে হত্যা করেছে। হাত-চোখ বেঁধে আবুগ্রাইব ও গুয়েন্তানামো কারাগারে নিয়ে ওয়াটার বোডিংসহ বীভৎস কায়দায় নির্র্যাতন করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের অত্যাধুনিক রণকৌশল আর মারণাস্ত্রের সামনে দাঁড়াতেই পারেনি তালেবান, আল-কায়েদা কিংবা ইরাকী বাহিনী। সর্বশেষ সিআইএ-মোসাদের নিখুঁত গোয়েন্দাগীরিতে আফগানিস্তান থেকে উড়ে গিয়ে পাকিস্তানের মাটিতে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করে সাফল্যের শেষ পালকটাও তাদের মুকুটে গুঁজে নিয়েছে।
ঠাÐা যুদ্ধের পর উপসাগরীয় যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সারা দুনিয়াকে, সর্বোপরি মুসলিম বিশ্বকে নিজের একক আধিপত্য ও শক্তিমত্তার জানান দিতে পেরেছে। একটা কড়া ম্যাসেজও দিয়ে দিতে পেরেছে ইরান, প্যালেস্টাইন, সিরিয়া, উত্তর কোরিয়ার মতো ঘাড়ত্যাড়া রাষ্ট্রগুলোকে। পাশাপাশি পাকিস্তানকেও কানে কানে জানিয়ে দিয়েছে ‘তালেবানকে আমাদের আর দরকার নাই, অতএব তোমাদের সাথে মধুচন্দ্রিমাও এখানে সমাপ্তি’।
ইরাকে আজ তাদের খেলাফত প্রতিষ্ঠিত। মধ্যপ্রাচ্যের ভঙ্গুর গণতন্ত্রের আবছা আলোর নিচে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি নিঃশর্ত ও অনুগত রাজরাজড়াদের ক্ষমতায় বসাতে পেরেছে। আরব বসন্তের ঢেউ উস্কে দিয়ে গাদ্দাফির মতো ‘একরোখা দেশপ্রেমিক’ নেতাদের খালেবিলে দৌঁড়ানি দিয়ে কুকুরের মতো পিটিয়ে নৃশংস কায়দায় হত্যা করতে পেরেছে। সেই আরব বসন্তের দগদগে ঘা এখনো ইয়েমেনে। সব প্রাপ্তিই যখন কানায় কানায় পরিপূর্ণ যুক্তরাষ্ট্রের আর দরকার কী আফগানিস্তানে থাকার। ওখানে তো সোনার খনি, তেলের খনি নাই। নাই কোনো পারমাণবিক স্থাপনাও। খামাকা কী দরকার ফালতু দেশটির পেছনে ফি বছর কাঁড়ি কাঁিড় ডলার খরচ করার।
ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র বুঝে গেছে বিগত বিশ বছরে আফগানিস্তানে যে প্রজন্ম লকলক করে বেড়ে উঠেছে তাদের মধ্যে ইসলামি জাতীয়তাবাদের চেতনা প্রবল, তার‌্য জবরদখলকারীদের ঘৃণা করে। সর্বোপরি যে জাতি, যে প্রজন্ম নিজের দেশকে ইসলামি রাষ্ট্র বানানোকে ইমানী দায়িত্ব মনে করে এবং যারা বিনিময়ে পরকালে অনন্ত সুখশান্তির লোভে বিভোর, তাদের দমিয়ে রাখা গেলেও বিলুপ্ত করা অসম্ভব। সুতরাং একটা সুরাহা হোক তাদের সাথে। তাদের পুতুল সরকারও এদের নিয়ে কতো টেনশনে থাকবে।
যে কথা সেই কাজ। ২০১৯ সালের ২৯ ফেব্রæয়ারি কাতারের রাজধানী দোহায় যুক্তরাষ্ট্র তালেবানের সাথে ‘আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য চুক্তি’ শিরোনামে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। চুক্তিতে আল-কায়দাসহ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে আফগান্তিানের মাটি ব্যবহার করতে না দেওয়া, আফগানিস্তান থেকে সব বিদেশি সেনা প্রত্যাহারসহ বিভিন্ন বিষয়ে একমত হয় উভয় পক্ষ। এমনকি চুক্তি স্বাক্ষরের দিন থেকে ১৪ মাসের মধ্যে সব বিদেশি সেনা প্রত্যাহারের কথাও বলা আছে চুক্তিতে। এটি ছিল আফগান রাষ্টক্ষমতার বাইরে গিয়ে তৃতীয় কোন পক্ষের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সমোঝোতা চুক্তি।
এই চুক্তিই মুলত তালেবানদের ভিত এনে দেয়, নতুন উদ্দীপনা জোগায়। কারণ, এখানে তালেবানদের শক্তি, সামর্থ্য ও অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এই চুক্তির ব্যাপারে টু-শব্দ করার শক্তি ছিল না মার্কিন সমর্থিত আফগান সরকারের।
পরবর্তীতে নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সৈন্য প্রত্যাহারের ডেডলাইন ঘোষণা করেন ৩১ শে আগস্ট ২০২১। সেই ডেডলাইন যতই ঘনিয়ে আসে একের পর এক প্রদেশ দখল করে তালেবানরা রাষ্ট্রক্ষমতার ততোই কাছাকাছি চলে আসে। চুক্তিতে আন্তঃআফগান আলোচনার কথা বলা থাকলেও আত্মবিশ্বাসী তালেবানরা সেটির আর তোয়াক্কা করেনি। অতঃপর এর যবনিকাপাত হয় গত ১৫ আগস্ট তালেবানদের বিনাবাধায় রাজধানী কাবুল দখলের মধ্য দিয়ে। এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছুই ছিল না। সরকারি বাহিনী কেন প্রতিরোধ করেনি? কারণ, তারা এই পরিস্থিতির জন্য আগে থেকেই মানসিকভাবে তৈরি ছিল।
যুক্তরাষ্ট্র কি পালিয়ে বেঁচে গেছে? না, যুক্তরাষ্ট্র পালিয়ে বাঁচেনি। আফগানিস্তানে তাদের মিশন শেষ। তার পেট ভরা। তারা কেন আর শুধু শুধু জঞ্জাল পাহারা দেবে? তাই শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্টও ‘কথা রেখেছে’, ৩১ আগস্টের মধ্যে সব সৈন্য প্রত্যাহার করে। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের এই অবস্থাকে অনেকেই ভিয়েতনামের সাথে তুলনা করার প্রয়াস পাচ্ছেন। এটা কিন্তু সঠিক নয়। ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রের শেষ দিনগুলি ছিল ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ পর্যায়ের। ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রের মার খেয়ে পালিয়ে বেঁচে গেছে আর আফগানিস্তানকে তারা খেয়েদেয়ে ছেড়ে দিয়ে গেছে। মুসলিম জাতির এই ত্রিশস্কু অবস্থার জন্য দায়ী কারা? এর দায় নিতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের টুইনটাওয়ারে হামলাকারী আর স্বাধীন রাষ্ট্র কুয়েত দখলকারী অবিবেচক সাদ্দাম হোসেনকে। একইসাথে মুসলিম জাতির অনগ্রসর, অবৈজ্ঞানিক ও ঘুনেধরা চিন্তাচেতনাও এর জন্য দায়ী।
বাঘ তার সমস্ত শক্তি, ক্ষিপ্রতা ও ধারালো নখ-দন্তের কারিশমা দিয়ে একটি হরিনকে ধরাশায়ী করে। পরে খেতে থাকা শিকারের অতিদূরে শিয়াল, হায়েনা, বনকুকুর, অপেক্ষায় থাকে এমনকি আকাশে শুকুনও চক্কর দিতে থাকে। কখন বাঘের খাওয়া শেষ হবে। একসময় বাঘের পেট ভরে গেলে চলে যায়। এরপর হুমুড় করে ঝাঁপিয়ে পড়ে আড়ালে অপেক্ষায় থাকা শিয়াল, হায়েনা, বনকুকুর, শুকুনের দল। তারা বাঘের পেলে যাওয়া হরিণের হাড়গোড়, উচ্ছিষ্ট দিয়ে ভূড়ি ভোজনে লেগে যায়। বাঘ ওদিকে আর ফিরে থাকায় না। এখানে বাঘের যেমন পরাজয় নাই তেমনি শিয়াল,হায়েনা,শকুনদের জয় দেখারও কোন কারণ নাই। তাহলে আফগান যুদ্ধে জিত কার ? জিত তবুও দুই পক্ষেরই। এক পক্ষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অপর পক্ষ আফগান ইসলামি জাতীয়বাদ। তালেবানরা এখন বেশ কৌশলী। কথাবার্তায় বেশ সংযমী। উগ্রতার প্রকাশও কম। নারীদের নিয়ে তাদের মনোভাবের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। আফগান বিজয়ের পর তালেবানদের নেতা কিংবা তাদের মুখপাত্রের ভাষা কিন্তু ভাবাবেগবর্জিত এবং বুদ্ধিদীপ্ত। বিগত বিশ বছরের যুদ্ধবিগ্রহ, ক্ষয়ক্ষতি, স্বজন হারানোর তিক্ত অভিজ্ঞতা, আন্তর্জাতিক চাপ, সর্বোপরি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের চুক্তির ধারা এই পরিবর্তন এনে দিয়ে থাকতে পারে। এখন দেখার পালা ক্ষমতার মৌ মৌ গন্ধে তালেবানরা কাকে কতোদিন মেনে নেয়। তালেবানী ভাবধারা আর মডারেট আফগানদের মধ্যে সংঘাত অনিবার্য।

লেখক: প্রাবন্ধিক