তাপমাত্রা চল্লিশের ঘরে

19

আগের বছর কালবৈশাখী মৌসুমের একেবারে শুরু থেকেই দেশের অন্য বিভাগের সাথে চট্টগ্রাম অঞ্চলেও দাপট দেখিয়েছিল ঝড়ো-হাওয়ার সাথে তুমুল বৃষ্টিপাত। কোথাওবা আঘাত হেনেছিল শিলাবৃষ্টিও। কিন্তু করোনাকালের চলতি মৌসুমে চৈত্র মাস পেরিয়ে বৈশাখের প্রথম সপ্তাহ প্রায় বিদায় নিতে চললেও চট্টগ্রাম অঞ্চলের কালবৈশাখী ঝড়-বাদলের তেমন দেখাই মিলছে না। বরং এবার আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানে গত রবিবার পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ ৩৯ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার রেকর্ডটি চট্টগ্রামের সমুদ্র উপক‚লবর্তী সীতাকুন্ড এলাকা নিজের দখলে রাখলেও গতকাল সোমবার যশোরে তা চল্লিশের ঘর ছুঁয়েছে। একদিনের ব্যবধানে এক লাফে বেড়েছে চার ডিগ্রি সেলসিয়াস। সিলেটসহ কয়েকটি বিভাগে বিক্ষিপ্ত বৃষ্টিপাত হলেও চলতি সপ্তাহের শেষদিকে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে ফের অস্বস্তির দাবদাহের আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, চলতি মৌসুমে এরইমধ্যে তিন দফায় তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের উপর দিয়ে। মাঝখানে একদিনের বিরতি দিয়ে গতকাল সোমবার থেকে ফের পটুয়াখালী অঞ্চলসহ ঢাকা, রাজশাহী এবং খুলনা বিভাগের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি মাত্রার তাপদাহ বয়ে যাচ্ছে। তাপমাত্রার ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় চৈত্রের শেষদিকে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ওঠেছিল ৩৯ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এরপর তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি সেলসিয়াস হ্রাস পেয়ে গত ১৬ এপ্রিল থেকে কোথাও কোথাও বৃষ্টিপাতের প্রবণতা বাড়তে শুরু করে। ওই রাতে দেশের বিভিন্ন স্থানে আগের তুলনায় বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। পরদিন ১৭ এপ্রিল সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী চব্বিশ ঘন্টায় সিলেটে দেশের সর্বোচ্চ ৩৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। গত ১৮ এপ্রিল সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী চব্বিশ ঘন্টায় রংপুরের রাজারহাটে দেশের সর্বোচ্চ ২৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে আবহাওয়া অধিদপ্তর। আর গতকাল সোমবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী চব্বিশ ঘন্টায় সিলেটে ৫২ মিলিমিটার রেকর্ড করা হয়েছে। গত ১৭ এপ্রিল রাজশাহীতে দেশের সর্বোচ্চ ৩৫ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের পরদিন ১৮ এপ্রিল খুলনা বিভাগের মংলা ও যশোরে ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। মাত্র একদিনের ব্যবধানে গতকাল সোমবার তা চার ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে চল্লিশের ঘর ছুঁয়েছে। খুলনা বিভাগের যাশোরে রেকর্ডকৃত এই তাপমাত্রাই চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, সর্বশেষ বৈশাখের গত কয়েকদিন রাজধানী ঢাকা ও সিলেটসহ দেশের উত্তর এবং পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন বিভাগে হঠাৎ ঝড়ো-হাওয়া বয়ে যাওয়ার পাশাপাশি বিক্ষিপ্ত বৃষ্টিপাতে স্থানভেদে ক্ষণিকের জন্য স্বস্তির পরশ বুলিয়ে দিলেও তাপমাত্রার খুব বেশি পতন ঘটেনি। তাই বিক্ষিপ্ত ঝড়-বাদল দীর্ঘমেয়াদে উষ্ণতার অস্বস্তি থেকে মুক্তি দিতে পারে নি। আগামি কয়েকদিনে চট্টগ্রামসহ দেশজুড়ে তাপমাত্রা পুনরায় বৃদ্ধি পেয়ে ঊষ্ণতা বাড়বে। মানুষ তো বটেই, ফসলের জন্যও এই আবহাওয়া বিপদ ডেকে আনছে। এমন আবহাওয়া অব্যাহত থাকার পর এপ্রিলের শেষ দিকে আরেক বিপদের আশঙ্কা করছেন আবহাওয়াবিদ ও বন্যা বিশেষজ্ঞরা। টানা খরতাপের কারণে নদ-নদী থেকে প্রচুর পরিমাণে জলীয় বাষ্প আকাশে জমা হচ্ছে। এর ফলে বঙ্গোপসাগর থেকে মাসের শেষ দিকে একটি বড় মেঘমালা আসতে পারে। ওই সময় দেশের উজানে ভারতীয় অংশে বৃষ্টিপাত দ্রæত বাড়বে। তীব্র বৃষ্টি থেকে আগাম ঢল দেশের হাওর এলাকায় হঠাৎ বন্যা হয়ে হাজির হতে পারে।
অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. শাহীনুল ইসলাম পূর্বদেশকে বলেন, এখন দেশের কয়েকটি বিভাগে বিক্ষিপ্ত বৃষ্টিপাত ও ঝড়ো হাওয়া বয়ে চলেছে তা চলতি সপ্তাহের মাঝামাঝি পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। সপ্তাহের শেষদিকে তাপমাত্রা এখনকার চেয়ে আরও বৃদ্ধি পারে। তবে মাসের শেষদিকে বঙ্গোপসাগর থেকে একটি বড় মেঘমালা এসে আকাশের দখল নিতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে গতকাল সন্ধ্যা ছয়টার পরবর্তী চব্বিশ ঘন্টার জন্য প্রচারিত আবহাওয়ার সিনপটিক অবস্থা বা দৃশ্যপটে বলা হয়েছে, পশ্চিমা লঘুচাপের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। মৌসুমের স্বাভাবিক লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে। আর পূর্বাভাসে বলা হয়, টাঙ্গাইল ও কিশোরগঞ্জ জেলাসহ ময়মনসিংহ, সিলেট, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের দুয়েক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা বা ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টিপাত হতে পারে। এছাড়া, দেশের অন্যত্র অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারাদেশের আবহাওয়া প্রধানতঃ শুষ্ক থাকতে পারে। সারাদেশে দিনের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি এবং রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। অধিদপ্তরের রেকর্ডকৃত পরিসংখ্যানে গতকাল সোমবার চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন অঞ্চলের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩২ থেকে ৩৫ দশমিক চার ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঘরেই উঠানামা করেছে। ঢাকা, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের ওপর দিয়ে বয়ে চলা তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে।
এর আগে অধিদপ্তরের এপ্রিল ও মে মাসের দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এপ্রিল মাসে দেশের উত্তর থেকে মধ্যাঞ্চল পর্যন্ত দুই থেকে তিনদিন বজ্রসহ মাঝারি থেকে তীব্র কালবৈশাখী বা বজ্র-ঝড় এবং দেশের অন্যত্র চার থেকে পাঁচদিন হালকা থেকে মাঝারি কালবৈশাখী কিংবা বজ্রঝড় হতে পারে। এ মাসে দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে একটি তীব্র তাপপ্রবাহ এবং অন্যত্র এক থেকে দুটি মৃদু থেকে মাঝারি তাপ প্রবাহ বয়ে যেতে পারে। এ মাসে বঙ্গোপসাগরে এক থেকে দুটি নিম্নচাপ সৃষ্টি হতে পারে এবং এর মধ্যে একটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে। আর মে মাসে দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে দুই থেকে তিনদিন মাঝারি থেকে তীব্র বজ্রঝড় ও দেশের অন্যত্র তিন থেকে চারদিন হালকা থেকে মাঝারি কালবৈশাখী হতে পারে। মে মাসে দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে এক থেকে দু’টি টি তীব্র তাপপ্রবাহ এবং অন্যত্র দুই থেকে তিনটি মৃদু বা মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের মতে, নামে বৈশাখ যুক্ত থাকলেও শীতের বিদায়ের পর ফাল্গুন, চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, সমগ্র পূর্ব এবং উত্তরপূর্ব ভারতে যে ঝড় বয়ে যায় তাই কালবৈশাখী। বাংলা বর্ষের শুরুতে মানে বৈশাখ মাসে এ ঝড় তুলনামূলকভাবে বেশি হয় বলেই এ ঝড় কালবৈশাখী নামে পরিচিত লাভ করেছে। বৈশ্বিকভাবে কালবৈশাখীকে ডাকা হয় ‘নর-ওয়েস্টার।’ অর্থাৎ উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে এই ঝড় ধেয়ে আসে বলে একে ‘নর-ওয়েস্টার’ বলে। তাই বলে কালবৈশাখী শুধুমাত্র বৈশাখ মাসেই (মানে ১৫ এপ্রিল থেকে ১৫ মে পর্যন্ত) দেখা যায়- এমনটি নয়। কালবৈশাখী এবং সাধারণ ঝড়ের মধ্যে পার্থক্য বিচার করার ক্ষেত্রেও কিছু মাপকাঠি রয়েছে। আবহাওয়াবিদরা সাধারণভাবে ঝড়ের গতিবেগ ঘন্টার ৫০ কিলোমিটারের বেশি এবং স্থায়ীত্ব অন্তত একমিনিট হলে সেটাকেই কালবৈশাখী ঝড় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর এশিয়া অঞ্চলের আবহাওয়াবিদরা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রাকে তীব্র তাপপ্রবাহ, ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে মাঝারি এবং ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে মৃদু তাপপ্রবাহ হিসেবে গণনা করেন।