তবুও বেঁচে থাক বুকের মানিক

10

নিজস্ব প্রতিবেদক

গত শুক্রবার দিনভর টানা ভারী বৃষ্টি সন্ধ্যায়ও যখন ধরে আসছিল না তখন থেকেই গৃহকর্তা জয়নাল আবেদীন মোবাইলে কল করে শ্বশুর-শাশুড়ি ও স্ত্রীকে পাহাড়ের পাদদেশ থেকে চলে আসার জন্য বারংবার তাগাদা দিচ্ছিলেন। বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় বেরিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনাও ছিল আকবরশাহ থানার ফিরোজশাহ কলোনির এক নম্বর ঝিল এলাকার বরিশালঘোনায় পাহাড়তটে বসবাসকারী ওই পরিবারটির। ঝুঁকিপূর্ণ সেমিপাকা বাসার ভেতর দেড় বছর বয়সী ফুটফুটে দুই যমজ কন্যাশিশুকে বুকে আগলে রেখেছিলেন মা শাহীনুর বেগম ও খালা মাইনুর বেগম। মধ্যরাতে এক লহমায় ধসে পড়া পাহাড়ের একাংশ যমজ কন্যাশিশুদের কাছ থেকে কেড়ে নেয় মা ও খালার অপত্য স্নেহ এবং নিরাপদ আশ্রয়। যমজ শিশুদের বাঁচিয়ে পরপারে পাড়ি জমান মা ও খালা। হাসপাতালে ঠাঁই হয় তাদের নানা-নানীর। দুর্ঘটনাস্থল থেকে দুই যমজ শিশুকে উদ্ধার করে নিয়ে যায় প্রতিবেশিরা।
অবুঝ বয়সে মা ও খালাকে হারানো দুই হতভাগ্য যমজ কন্যাশিশুরা হলো, তাসকিয়া ইসলাম তানহা ও তাকিয়া ইয়াসমিন তিন্নি। মাকে হারানোর বেদনা এখনও অনুভব করতে না পারা এই দুই শিশুর এখন রয়েছে অদূরে বসবাসকারী আরেক খালা নার্গিস বেগমের বাসায়। দুর্ঘটনার পর থেকে নার্গিস বেগম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মা রানু বেগম ও বাবা ফজলুল হকের সেবা-শুশ্রষায় তাদের পাশে রয়েছেন। আর মা-খালার বুকের ভেতরে নিরাপদে থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া দুই যমজ কন্যাশিশু তানহা ও তিন্নির দেখাশুনা করছে খালাতো বোন ইয়াসমিন আকতার ও আশপাশের প্রতিবেশীরা। ফিরোজশাহ কলোনির ১ নম্বর ঝিল এলাকায় নার্গিস বেগমের বাসা। এর কিছু দূরে ঝিলের শেষ মাথায় বসবাস করতেন নিহত শাহীনুরের পরিবার।
টানা ভারী বৃষ্টির এক পর্যায়ে শুক্রবার বিকালেই বাসা থেকে বড় ছেলে তরিকুল ইসলাম তানিমকে সঙ্গে নিয়ে নার্গিসদের বাসায় চলে যান গৃহকর্তা জয়নাল আবেদীন। সেখান থেকেই মোবাইলে বারবার স্ত্রীকে কল করে সবাইকে নিয়ে বড় বোনের বাসায় চলে আসার জন্য তাগাদা দিচ্ছিলেন তিনি। টানা বৃষ্টি হলে এমনটাই করে ওই পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু শুক্রবার কী জানি কী ভেবে তারা বাসা ছেড়ে যান নি। মধ্যরাত একটার দিকেই ঘনিয়ে আসে বিপদ। পাহাড়ের একাংশ ধসে পড়ে বাসার উপর। বাসায় অবস্থান করা সবাই মাটির নিচে চাপা পড়লেও মা-খালা মিলে বুকে আগলে রেখেছিলেন দুই যমজ কন্যাশিশুকে। দুর্ঘটনার পর প্রতিবেশীরা মা-খালাকে মৃত আর নানা-নানীকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করেন। তখন দুই যমজ কন্যাশিশু অবিশ্বাস্যভাবে অক্ষত অবস্থায় ছিল।
দুই কন্যাশিশুর বড় খালা নার্গিস বেগমের মেয়ে ইয়াসমিন আকতার জানান, কয়েক পশলা বৃষ্টি হলেই জয়নালের পরিবারের সবাই বাসা ছেড়ে তাদের এখানে চলে আসত। বৃষ্টির রাতে তারা সবাই তাদের বাসাতেই থাকত। শুক্রবার দিনের বেলায় তার খালু আর খালাতো ভাই তাদের বাসায় চলে আসলেও পরিবারের অন্যরা কেন জানি আসে নি। শেষ পর্যন্ত রাতে তারা দুর্ঘটনার শিকার হলো। এখন দুই অবুঝ কন্যাশিশুর দেখাশুনা তাকেই করতে হচ্ছে।
পাহাড়ধসে নিহত অপর দু’জনের মত শাহীনুর ও মাইনুরের লাশও গতকাল শনিবার দিনভর চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ছিল। ওই দুর্ঘটনায় আহত শাহীনুরের মা ও বাবা হাসপাতালের ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাদের দেখভাল করছেন নার্গিস বেগম। অকালে মাকে হারানো ছেলে সন্তানকে নিয়ে হাসপাতালে রয়েছেন বাবা জয়নাল আবেদীনও। দুর্ঘটনায় স্ত্রী ও শ্যালিকাকে হারানোর শোক আর বুকের মানিকদের বাঁচিয়ে রাখার যুগপৎ তাড়না এখন তার চোখেমুখে।