ঢাকায় চিকিৎসক হত্যায় ঘাতক স্বামী মুরাদপুর থেকে গ্রেপ্তার

43

নিজস্ব প্রতিবেদক

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচয় সূত্রে দীর্ঘদিনের প্রেমের সম্পর্কের পর দুই বছর আগে ২০২০ সালের অক্টোবরে পরিবারকে না জানিয়ে কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করেছিলেন নরসিংদীর মেয়ে ডা. জান্নাতুল নাঈম সিদ্দিক ও কক্সবাজারের ছেলে রেজাউল করিম রেজা। কিন্তু বিয়ের পরও একাধিক নারীর সাথে সম্পর্ক অব্যাহত রাখেন রেজাউল। এ নিয়ে জান্নাতের সাথে রেজাউলের প্রায়ই তর্কাতর্কি ও ঝগড়া হতো। এর জেরেই পরিকল্পিতভাবে ঘটা করে জন্মদিন উদযাপনের কথা বলে জান্নাতুলকে হোটেলে ডেকে এনে জবাই করে মৃত্যু নিশ্চিত করেন রেজাউল।
রাজধানী ঢাকার পান্থপথে ‘ফ্যামিলি এপার্টমেন্ট’ নামের আবাসিক হোটেলে নারী চিকিৎসক জান্নাতুল নাইম সিদ্দিকীকে হত্যা করেন বলে জানান রেজাউল। গতকাল শুক্রবার চট্টগ্রামের মুরাদপুরের একটি মেস থেকে অভিযুক্ত স্বামী রেজাউলকে গ্রেপ্তারের পর এসব তথ্য জানিয়েছে র‌্যাব।
ঢাকায় হত্যাকান্ডের পর গত বৃহস্পতিবার রাতে র‌্যাব-২ এবং র‌্যাব-৭ এর যৌথ অভিযানে নগরীর মুরাদপুর এলাকার একটি মেস থেকে রেজাউলকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তার কাছ থেকে হত্যাকান্ডের সময় পরিহিত রক্তমাখা গেঞ্জি, নিজের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন ও ব্যাগ এবং জান্নাতুলের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়েছে। গ্রেপ্তার রেজাউল কক্সবাজারের মৃত নবী হোসাইনের ছেলে।তিনি ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ ও এমবিএ সম্পন্ন করেন। এমবিএ অধ্যয়নকালে তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি নেন। কয়েক মাস আগে ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সিনিয়র এক্সিকিউটিভ হিসেবে যোগদান করেন রেজাউল। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জান্নাতুলকে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন রেজাউল।
নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার জান্নাতুল থাকতেন রাজধানীর শাজাহানপুরে। গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলায়। তিনি মগবাজার কমিউনিটি মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস সম্পন্ন করে সেখানেই গাইনী বিষয়ক একটি কোর্সে অধ্যয়ন করছিলেন। গত ১০ আগস্ট রাতে রাজধানীর কলাবাগান থানা পুলিশ ফ্যামিলি সার্ভিস অ্যাপার্টমেন্ট নামে আবাসিক হোটেলের একটি কক্ষ থেকে জান্নাতুল নাইম সিদ্দিকীর মরদেহ উদ্ধার করে। ওইদিন সকাল আটটায় রেজাউল করিম রেজার সঙ্গে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে তিনি আবাসিক হোটেলে উঠেছিলেন।
জান্নাতুল হত্যাকান্ড ও রেজাউলের গ্রেপ্তারের বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে গতকাল শুক্রবার রাজধানী ঢাকার কারওয়ান বাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে আয়োজন করা হয়।
এতে জানানো হয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ২০১৯ সালে তাদের পরিচয় হয়। এরপর উভয়ের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। সম্পর্কের পরিণতিতে ২০২০ সালের অক্টোবরে উভয়ে পরিবারকে না জানিয়ে পালিয়ে কাজী অফিসে বিয়ে করে। বিয়ের পরও বিভিন্ন নারীর সাথে রেজার সম্পর্ক অব্যাহত রাখার বিষয়টি পরবর্তীতে জান্নাতুল জানতে পারেন। এ নিয়ে প্রায়ই উভয়ের মধ্যে বাগ-বিতন্ডা হতো। এরই জের ধরে জান্নাতুলকে হত্যার পরিকল্পনা করেন রেজাউল। পরিকল্পনা মোতাবেক ঘটা করে জন্মদিন উদযাপনের কথা বলে গত ১০ আগস্ট জান্নাতুলকে পান্থপথের ফ্যামিলি এপার্টমেন্ট আবাসিক হোটেলে নিয়ে যান রেজা। হোটেল কক্ষের ভেতর ধারালো অস্ত্র দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের পর গলা কেটে জান্নাতের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।
র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ঘটনার পর নিহতের বাবা বাদী হয়ে কলাবাগান থানায় একটি মামলা করেন। র‌্যাব এ ঘটনার পর থেকে ছায়া তদন্ত শুরু করে। তারই একপর্যায়ে হত্যাকান্ডে জড়িত অপরাধীকে শনাক্ত এবং গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। হত্যাকান্ড ঘটিয়ে জান্নাতুলের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি নিয়ে যান ঘাতক রেজাউল। গ্রেপ্তারের সময় তার কাছ থেকে ওই মোবাইল ফোনটি জব্দ করা হয়েছে।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রেজাউলের দেয়া তথ্যের বরাত দিয়ে র‌্যাব জানায়, পরিবারের অমতে তারা পরস্পরকে ভালোবেসে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তবে বিয়ের পরও বিভিন্ন নারীর সাথে রেজাউলের সম্পর্ক অব্যাহত রাখার বিষয়টি জান্নাতুল জানতে পারেন। এ নিয়ে তার সাথে রেজাউলের প্রতিনিয়ত কথা কাটাকাটি ও বাগ-বিতন্ডা হতো। তারপরও তার সাথে সম্পর্ক টিকিয়ে রেখেছিলেন জান্নাতুল। এরই মধ্যে রেজাউল তার প্রতিবন্ধকতা দূর করতে জান্নাতুলকে হত্যার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি তার ব্যাগে ধারালো চাকু নিয়ে চলাফেরা করতেন। গত ১০ আগস্ট জান্নাতুলের জন্মদিন ঘটা করে উদযাপনের কথা বলে রাজধানীর পান্থপথে ‘ফ্যামিলি অ্যাপার্টমেন্ট’ নামের আবাসিক হোটেলে নিয়ে যান রেজাউল। হোটেল রুমে ঢোকার পর তাদের মধ্যে তর্কাতর্কি হয়। তর্ক-বিতর্কের একপর্যায়ে রেজা তার সাথে থাকা ব্যাগ থেকে ধারালো অস্ত্র বের করে জান্নাতুলের শরীরে আঘাত করে। জান্নাতুল নিস্তেজ হয়ে পড়লে গলা কেটে তার মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। হত্যাকান্ডের পর রক্তমাখা কাপড়-চোপড় পরিষ্কার করে হোটেলের বাথরুমে গোসল সারেন রেজাউল। এরপর কক্ষ থেকে বেরিয়ে নিজেই বাইরে থেকে দরজার তালা বন্ধ করে দিয়ে চলে যান। যাওয়ার সময় তিনি জান্নাতুলের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটিও সাথে করে নিয়ে যান।
জিজ্ঞাসাবাদে রেজাউল র‌্যাবকে জানায়, ধস্তাধস্তির কারণে তিনি হাতে কিছুটা আঘাত পান। হোটেল থেকে বেরিয়ে তিনি প্রথমে তার মালিবাগের বাসায় যান। বাসা থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে একটি হাসপাতালে গিয়ে হাতের ক্ষতস্থান সেলাই এবং প্রাথমিক চিকিৎসা নেন। এরপর আরামবাগ বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসযোগে চট্টগ্রাম এসে মুরাদপুর এলাকার একটি মেসে আত্মগোপন করেন। র‌্যাব সদস্যরা অভিযান চালিয়ে সেখান থেকেই তাকে গ্রেপ্তার করে।