ড. মোহাম্মদ শাহ: একজন ইতিহাসবিদের অন্তিম যাত্রা

51

জীবন একটি বহতা নদী। সেই জীবন নদী শুধু সামনের দিকে এগুতে জানে। আর সেই চলার পথে হারিয়ে যায় কিছু কিছু জীবন কিন্তু হারিয়ে যায় না সেই মানুষগুলোর স্মৃতি। তেমনি হারিয়ে গেল একজন মানুষ আমার ভায়রা ড. মোহাম্মদ শাহ। যিনি ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলার আহম্মদপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ইব্রাহিম কারীর বাড়িতে বাবা মরহুম আলহাজ¦ মওলানা মোহাম্মদ মজিবুল হক ও মা নূরের নাহার বেগমের ঘর আলোকিত করে পৃথিবীতে এসেছিলেন ১৯৫২ সালের ১লা ডিসেম্বর। সেদিনের সেই শিশুটি আজকের স্বনামধন্য ইতিহাসবিদ চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর ড. মোহাম্মদ শাহ। ড. মোহাম্মদ শাহ গ্রামের বাড়ির প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা শুরু করেন। ১৯৬৯ সালে নিজ গ্রামের শতবর্ষী বিদ্যাপীঠ আমীরাবাদ বি.সি লাহা হাই স্কুল থেকে কুমিল্লা বোর্ড এর আওতায় এস.এস.সি পরীক্ষার মেধা তালিকায় তৃতীয় স্থান অধিকার করার পর ভর্তি হলেন বর্তমানের সার্ধশত বছরের বিদ্যপীঠ চট্টগ্রাম কলেজে। চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হয়ে শেরে বাংলা ছাত্রাবাসে সিট নিয়ে আবারো অদম্য উৎসাহ নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক ক্লাসে পড়তে শুরু করলেন। মাঝে শুরু হলো স্বাধীনতা যুদ্ধ। জড়িয়ে পড়লেন স্বাধীনতা যুদ্ধে। এভাবে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে সেই পবিত্র দায়িত্বটুকু যথাসাধ্য পালন করলেন। অতপর যুদ্ধের কারনে একবছর বিলম্ব সেই ১৯৭২ সালে চট্টগ্রাম কলেজ হতে কৃতিত্বের সাথে মানবিক বিভাগে এইচ.এস.সি পাস করলেন। তারপর চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় থেকে ১৯৭৬ সালে ইতিহাস বিষয়ে অনার্স এবং ১৯৭৭ সালে মাস্টার্স শেষ করলেন। মার্স্টাস শেষ করে নিজের বিভাগে প্রভাষক হিসাবে
যোগ দেয়ার পর ১৯৭৯ সালে ভারতের জহরলাল নেহুরু বিশ^বিদ্যালয় থেকে এম.ফিল এবং ১৯৯৭ সালে যুক্তরাজ্যে লন্ডন ইউনিভার্সিটি থেকে একজন স্কলার হিসেবে পি.এইচ.ডি ডিগ্রী অর্জন করেন। তাতেও তিনি থেমে যাননি। আবার ১৯৯৭ সালে যুক্তরাজ্যের রয়েল হলওয়ে ইউনিভার্সিটি থেকে পোস্ট ডকটরেট ডিগ্রী অর্জন করেন। এই সেই ড. মোহাম্মদ শাহ যিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শুধু জ্ঞান অর্জনের জন্য ছুটেছেন আর চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে ১৯৭৮ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত চাকুরীকালীন যোগ দিয়েছেন দেশে বিদেশে অসংখ্য সেমিনার ও সিম্পোজিয়াম।
ড. মোহাম্মদ শাহ ছিলেন একজন মৌলিক লেখক ও গবেষক। তিনি বাংলাপিডিয়ায় অনেক প্রবন্ধের লেখক। পাকিস্তানের করাচী শহরের রয়েল পাবলিশার্স পাকভারত উপমহাদেশের প্যান ইসলামিক মুভমেন্ট এর উপর তার গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। তাছাড়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে তার জ্ঞানগর্ব প্রবন্ধসমূহ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া তিনি ছিলেন যেকোন জ্ঞান অর্জনে অসম্ভব জেদী, যা শিখবেন বলেছেন তাই কৃতিত্বের সাথে শিখেছেন। এমনকি চাকুরীর শেষ দিকে তিনি প্রথম শ্রেণিতে হোমিও প্যাথ ডিগ্রী অর্জন করে একজন সফল ডাক্তার হিসাবে কাজ করেছেন এবং অনেককেই তিনি বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন। এমনকি অবসর জীবনে এসে গাড়ি চালানো শিখে ড্রাইভিং লাইসেন্স অর্জন করে একটি সুন্দর প্রাইভেট কার কিনে কয়েকদিন চালিয়েছিলেনও।
তিনি ছিলেন একজন বন্ধুবৎসল সজ্জন ব্যক্তি। তিনি যেখানে যেতেন সেখানে আসর মাতিয়ে রাখতেন। তিনি শুধু তার বিষয়ে পÐিত ছিলেন না, তিনি সব বিষয়ে জ্ঞান রাখতেন এবং যে কোন বিষয়ে অনর্গল বক্তব্য দিতে পারতেন। তিনি ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র না হয়েও চমৎকার ইংরেজি বলতেন। তিনি ছিলেন একজন অতিথিপরায়ন ব্যক্তি। এব্যাপারে তাঁর সহধর্মিনি তাকে সর্বদা সার্বিক সহযোগিতা দিতেন।
তিনি ছিলেন একজন ভাল শিক্ষক, ভালো পিতা ও ভাল স্বামী । তিনি একজন কাজ পাগল মানুষ। কখনো নিজের সময়টাকে অলসভাবে কাটানোর কথা ভাবেননি। তাই চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় থেকে অবসর নেয়ার পর জ্ঞান পিপাসু মানুষটি পুনরায় চাকুরী নিয়েছিলেন দেশের সেরা প্রাইভেট বিদ্যাপীঠ নর্থসাউথ বিশ^বিদ্যালয়ে। সেখানে চাকুরীকালীন ছুটির ফাঁকে চট্টগ্রাম নিজ পরিবারের কাছে এসে গত ২২শে সেপ্টেম্বর হাটহাজারী পল্লীবিদ্যুৎ অফিস হতে বিশ^বিদ্যালয়ের দক্ষিণ ক্যাম্পাসে আবাসিক এলাকার নিজ বাড়িতে সি.এন.জি টেক্সীযোগে ফেরার পথে একটি বাসের সাথে সংঘর্ষে এই জীবনঘাতী দুর্ঘটনায় পতিত হন। মোট আট দিন চিকিৎসা থাকা অবস্থায় পরিশেষে ২৯ সেপ্টেম্বর রোববার ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেলে রাত ১০টা ১০ মিনিটে শেষনিশ^াস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তিনি বৃদ্ধা মা, স্ত্রী মোর্শেদা আরা বেগম জেসমিন (গৃহিনি) ও দুই সন্তান যথাক্রমে ফরহাদ মাহমুদ (চিটাগাং গ্রামার স্কুলের আর্টের শিক্ষক) এবং ফারহানা পিয়া (চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে মাইক্রো বায়োলজীর ছাত্রী), প্রবাসে ও দেশে ভাইবোন এবং অনেক গুণগ্রাহী রেখে যান।
তিনি এখন অন্তিম যাত্রা শেষে সোনাগাজীর আহম্মদপুর গ্রামে তার বাবার পাশেই ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ আছর নামাজের পর থেকেই চিরনিদ্রার। আল্লাহ যেন তাঁকে বেহেশত নসীব করেন- আমীন।

লেখক : শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক