ড. আনওয়ারুল হক খতিবী মোহাম্মদ ইমাদ উদ্দীন

55

বাংলাদেশের আরবী ও ইসলামী শিক্ষায় উজ্জ্বল নক্ষত্র চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী স্টাডিজ বিভাগের প্রবীণ শিক্ষক প্রফেসর ড. আনোয়ারুল হক খতিবী (রহ) একজন সফল শিক্ষাবিদ এবং ইসলামী চিন্তাবিদ ছিলেন। চট্টগ্রাম জেলার লোহাগাড়া থানার পশ্চিম কলাউজান গ্রামের প্রসিদ্ধ খতীব পরিবারে জন্ম তাঁর। তাঁর পিতার নাম মাওলানা মাহমুদুল হক খতিবী (রহ)। তাঁর পিতা একজন দক্ষ আলেম ও সুবক্তা ছিলেন। মাতা নাম নাজমা খাতুন। আনওয়ারুল হক খতিবী স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণীর পরীক্ষা উত্তীর্ণ হওয়ার পর ১৯৫৭ সালে চুনতী হাকিমিয়া কামিল মাদরাসায় ভর্তি হয়ে ১৯৬৫ সালে প্রথম বিভাগে আলিম, ১৯৬৭ সালে ১ম বিভাগে ৬ষ্ঠ স্থান অধিকার ফাজিল পাশ করেন। অতঃপর সরকারী আলিয়া মাদরাসা, ঢাকাতে ভর্তি হন এবং ১৯৬৯ সালে কামিল (হাদীস) পরীক্ষায় ১ম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। ১৯৭১ সালে একই মাদরাসা থেকে ডিপ্লোমা-ইন-উর্দু (আদীবে কামিল) পরীক্ষায় ১ম শ্রেণীতে ১ম স্থান অধিকার করেন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ১৯৭৩ সালে বি.এ অনার্স (আরবী) পরীক্ষায় ১ম শ্রেণীতে ১ম স্থান অধিকার করে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার লাভ করেন।১৯৭৪ সালে এমএ (আরবী) পরীক্ষায় ১ম শ্রেণিতে কৃতিত্ব অর্জন করেন।
প্রফেসর ড. আনোয়ারুল হক খতিবী (রহ) ছাত্র জীবনে যেমনিভাবে সুনাম ও খ্যাতি অর্জন করেছেন তেমনিভাবে কর্মজীবনেও ব্যতিক্রম ছিলেন না। ১৯৭৭ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশে আরবী ভাষা শিক্ষক পদে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৭৯ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী ও ফার্সী বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। ক্রমাগতভাবে পদোন্নতি পেয়ে তিনি ১৯৯২ সালে উক্ত বিভাগের সভাপতির দায়িত্ব কৃতিত্ব সহিত নিবিড়ভাবে পালন করেন। পরবর্তীতে চট্টগ্রামের এই সূর্যসন্তানের অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রচেষ্টায় ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৯৭ সালে ‘ওসধস ওনহ ঞধরসরুুধয’ং ঈড়হপবঢ়ঃ ড়ভ ওলঃরযধফ’ শিরোনামে অভিসন্দর্ভ রচনা করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পি.এইচ.ডি ডিগ্রী লাভ করেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জার্নালে আরবী, বাংলা ও ইংরেজী ভাষায় তাঁর বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি উর্দু ভাষায় কবিতাও রচনা করেন।
আনোয়ারুল হক খতিবী স্যারের জীবনাদর্শ বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের জন্য প্রেরণা যোগাবে নিঃসন্দেহ। তিনি পূর্বসুরী আকাবির মনীষীদের জীবন্ত নমুনা ছিলেন। তিনি ছিলেন আলেম সমাজের মধ্যে অতুলনীয় ও প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব।দ্বীনের খেদমতে তার বহুমুখী অবদান ও ত্যাগ অবিস্মরণীয়।ইসলামের সঠিক ও মূলধারাকে তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত করতে আজীবন প্রয়াস চালিয়েছেন। ইতিহাসে তিনি অ¤øান ও বিরল ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবেন। তিনি এমন একজন মানুষ, যাঁর জ্ঞানের পরিধি সুবিস্তৃত ও সুবিশাল। শিক্ষক সমাজে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সম্মানিত ও শ্রদ্ধাভাজন একজন আদর্শ শিক্ষক। ছাত্র সমাজের কাছে একজন প্রাণপ্রিয় মান্যবর উস্তাদ। আমি ২০০৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর তাঁর সাথে প্রফেসর ড. হাফেজ বদরুদ্দোজা স্যারের মাধ্যমে পরিচয় হই। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালে ড. আনওয়ারুল হক খতিবী স্যার ছিলেন আমার জন্য একজন গাইড লাইন ও নির্ভরযোগ্য পরামর্শক। আবার একজন অভিভাবক ছিলেনও বটে। এই মহান শিক্ষকের প্রতি আমার দুর্বলতা, অকৃত্রিম ভালবাসা, হৃদয়ের টান ও আবেগ প্রবণতা একটু বেশী ছিল। এই মহান ব্যক্তির স্নেহ ও ভালবাসা পাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। ক্লাস শেষে যখনই সুযোগ হত স্যারের রুমে চলে যেতাম। দু’জনের মধ্যে অনেক ইলমী আড্ডা হত। আড্ডাতে অনেক সময় শ্রদ্ধেয় আব্বাকেও নিয়ে কথা হত। ছাত্রজীবনে আব্বু লজিং থাকা অবস্থায় নিজ হাতে মুরগী জবাই করার পর কপালে এক টুকরাও গোশত না জোটার গল্প সহ অসংখ্য স্মৃতিগুলি আমাকে বলত। এমন কি স্যারেরও। পরে অবশ্যই জানতে পারলাম এইসব আব্বু নিজেই স্যারকে বলেছেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে ১ম বর্ষে কোন একদিন ‘আদ-দাওয়াহ আল ইসলামিয়্যাহ’ কোর্সের তাঁর ক্লাসে বাংলাদেশে দ্বীন ইসলাম প্রচারে অলীদের ভূমিকা বলতে গিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে মুফতি পরিবার’র অবদান তুলে ধরেন। একই সাথে শ্রদ্ধেয় বাবার সম্পর্কেও।
প্রফেসর ড. আনোয়ারুল হক খতিবী স্যার সব সময় তাঁর হক আদায় করার ক্ষেত্রে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন। একজন শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনে তিনি অত্যন্ত সজাগ ছিলেন। নিয়ম শৃঙ্খলার প্রতি তিনি ছিলেন খুবই সচেতন। স্যার যখন ক্লাস করতেন শিক্ষক হিসেবে তাঁর পাÐিত্য প্রকাশ পেত। যাঁরা তাঁর জ্ঞান ভাÐার স্পর্শ করতে পেরেছেন, জীবনে তারা সফল হয়েছেন, আলোকিত হয়েছেন। আফসোস! আমরা বেশীদিন স্যারের সান্নিধ্য আসার সুযোগ লাভ করতে পারি নি। স্যার ২০১২ সালে ১৭ ফেব্রæয়ারি তাঁর প্রভুর ডাকে না ফেরার দেশে চলে যান। তাঁর মৃত্যুতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামিক স্টাডিজ পরিবার শুধু একজন শিক্ষককে নয় একজন অভিভাবককেও হারিয়েছে। তাঁর মৃত্যুতে এই পরিবার আজও শোকাহত। তিনি এ দেশের মানুষের হৃদয়ে আজীবন বেঁচে থাকবেন। আল্লাহ পাক তাঁকে আন্বিয়া, সোলাহা ও শুহাদার সাথে জান্নাতুল ফেরদাউসের আলা ইল্লিয়িনে মর্যাদাপূর্ণ স্থান নসীব করুন। আর আসুন আমরা এই মহান আলেমের অনুপম চারিত্রিক ও আদর্শ অনুসরণ করে দ্বীনের খেদমতে নিজেদের নিয়োজিত করি।