ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে শক্তিশালী জালিয়াতচক্র

738

চট্টগ্রাম মহানগর এলাকায় বিআরটিএ’র লাইসেন্স নিয়ে একটি বড় ধরনের জালিয়াতচক্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। শিক্ষানবিশ লাইসেন্স বা পরীক্ষা না দিয়েই সরাসরি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল করে প্রাপ্তি স্বীকার রশিদ ও লাইসেন্স প্রদান করছে চক্রটি। যা পুরোটাই ভুয়া এবং জাল। এতে সরকার একদিকে হারাচ্ছে রাজস্ব অন্যদিকে অপরিপক্ক চালকরা গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে ডেকে আনছেন মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। যার পরিণতি প্রাণ হারাচ্ছেন সাধারণ জনগণ। বিআরটিএ বলছে, লাইসেন্স পরীক্ষায় কড়াকড়ির কারণে এ চক্র লাইসেন্স জাল করছে।
সূত্রে জানা যায়, প্রতিদিন শত শত যানবাহন নগরীর বিভিন্ন এলাকায় এ প্রাপ্তি স্বীকার রশিদ এবং জাল লাইসেন্স নিয়ে ঘোরাঘুরি করে। সার্জেন্টের কাছে চেক করার ক্ষেত্রে পস মেশিন থাকলেও অনেকেই যাচাই না করে ছেড়ে দেন। দেখতে হুবহু সত্যিকারের লাইসেন্সের মত লাগে বিধায় আসল-নকল বুঝার উপায়ও নেই। এসব তৎপরতা বন্ধ করতে চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছেন বিআরটিএ’র নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা। এসময় বিআরটিএ’র মোটরযান পরিদর্শক এবং বেঞ্চ সহকারীরা সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন। তাদের হাতে জাল লাইসেন্স ধরা পড়ার সাথে সাথে এ লাইসেন্স বা প্রাপ্তি স্বীকার রশিদগুলো জব্দ করা হয়। গত একমাসে প্রায় ২০টির মত এ রকম জাল লাইসেন্স ধরা পড়ে।
বিআরটিএ’র লাইসেন্স শাখা মতে, একজন প্রার্থীকে প্রথমে শিক্ষানবিশ লাইসেন্সের জন্য সহকারী পরিচালক বরাবর আবেদন করতে হবে। এতে জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট বা জন্মসনদ, রেজিস্ট্রার্ড চিকিৎসকের দেয়া মেডিকেল সার্টিফিকেট, সদ্য তোলা দুই কপি ছবি এবং ব্যাংকে টাকা জমা দেয়ার রশিদসহ লাইসেন্স শাখায় জমা দিলে ৩০ মিনিটের মধ্যে শিক্ষানবীশ লাইসেন্স প্রদান করা হয়। যার মাধ্যমে প্রার্থী উপযুক্ত শিক্ষালাভের পর শিক্ষানবীশ লাইসেন্সের নির্ধারিত তারিখে পরীক্ষা দিতে পারবে।
অপেশাদার/পেশাদার চালককে মোটরযান অধ্যাদেশ পূর্বের ১৯৮৩ এবং বর্তমান সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ মোতাবেক প্রার্থীকে মোট ৩টি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়। পরীক্ষাগুলো হলো-লিখিত, মৌখিক, ফিল্ড টেস্ট। এ পরীক্ষাটি নিয়ন্ত্রণ করে ড্রাইভিং কম্পিটেন্সি টেস্ট বোর্ড (ডিসিটিবি)। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে ১৫ দিন পরে প্রার্থীকে দেয়া হয় প্রাপ্তি স্বীকার রশিদ। যার মাধ্যমে আঙ্গুলের ছাপ এবং ছবি তোলার তারিখ নির্ধারণ করা থাকে। ছবি আর ছাপ নেয়া হয়ে গেলে তার স্মার্ট লাইসেন্সটি তৈরির প্রক্রিয়ায় চলে যাবে।
কিন্তু এ জালিয়াতি চক্র এতগুলো ধাপের একটিও পার না করে তৈরি করছে লাইসেন্স বা প্রাপ্তি স্বীকার রশিদ। আবার ওখানে পরিদর্শকসহ বিভিন্ন কর্মকর্তার স্বাক্ষর পর্যন্ত নকল করে বসানো হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে তারা কীভাবে এসব কাজ করে?
বিআরটিএ’র পরিদর্শকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বন্দর-কাস্টমের দিকে এরকম কয়েকটি চক্র সক্রিয় রয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনা করার সময় এসব জাল লাইসেন্স এবং প্রাপ্তি স্বীকার রশিদ তাদের হাতে ধরা পরে। কিন্তু মূল হোতা কে বা কারা তাদের ধরা যাচ্ছে না। যাদের কাগজ জব্দ করা হয়েছে তারা বিভিন্ন মাধ্যম থেকে এগুলো করিয়ে নিয়েছে বলে জানায়। পরে অফিসে যোগাযোগ করতে বললে আর দেখা মেলে না।
সিএমপি’র ট্রাফিক বিভাগে কর্মরত সার্জেন্ট মো. নাজিম উদ্দিন জানান, প্রথমত গাড়িকে থামিয়ে আমরা লাইসেন্স চেক করি। এতে আমাদের সাথে থাকা পস মেশিনে লাইসেন্স নাম্বার মিলাই। মাঝে মাঝে ভুল পেলে জব্দ করি।
কথা হয় ট্রাক চালক আব্দুর রহমানের সাথে। তিনি জানান, আমরা তো লাইসেন্স করতে কেমনে কি লাগে জানি না। অন্যান্য ট্রাক ড্রাইভারের সহায়তায় ১০ হাজার টাকা দিয়ে লাইসেন্স নিয়েছি। পরে জানতে পারি সেটি জাল। ম্যাজিস্ট্রেট কারাদÐও দিয়েছিলো। লাইসেন্স বানাতে যে কয়েকটি প্রক্রিয়া আছে সেটি জানতাম না বলেই আজকে এ দশা হয়েছে।
আরেক চালক মো. এয়াকুব বলেন, বিআরটিএ থেকে লাইসেন্স পেতে নাকি অনেক কষ্ট হয় এমন প্রচার করে আসছে অনেকেই। যার কারণে মনের ভেতরে একটা ভয় কাজ করেছিলো। এখন আপনার মুখ থেকে যেভাবে শুনলাম, সেভাবে কাজ করলে তো সঠিক লাইসেন্সটা পেতাম। ম্যাজিস্ট্রেট আমার কাগজগুলো জব্দ করে আমাকে জরিমানা করেছে। আমি বুঝতে পেরেছি আরেকজনের উপর ভরসা করাটাই ভুল হয়েছে।
কথা হয় বিআরটিএ’র চট্টগ্রাম মেট্রো’র সহকারী পরিচালক ইঞ্জি. উসমান সরোয়ার আলমের সাথে। তিনি পূর্বদেশকে বলেন, আমরা লাইসেন্স পরীক্ষা অত্যন্ত স্বচ্ছভাবে নিচ্ছি, যেখানে অপরিপক্ক চালকরা উত্তীর্ণ হতে পারছেন না। এক কথায় বলতে গেলে আগের তুলনায় এখন পরীক্ষায় কড়াকড়ি হয়। ফলে জালিয়াতি চক্র বিভিন্নভাবে জাল লাইসেন্স এবং ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে বিআরটিএ কম্পাউন্ডের মধ্যে দালাল ঘেঁষতে পারে না। কারণ এর আগে ম্যাজিস্ট্রেটরা অভিযান চালিয়ে কয়েকজন দালালকে কারাদÐ প্রদানের পর তাদের উৎপাত কমে গেছে। তাই বাইরে এসব কুচক্রি মহল বিভিন্নভাবে মানুষকে প্রতারণা করে সরকার এবং প্রশাসনকে ফাঁকি দিচ্ছে।
এ ব্যাপারে বিআরটিএ’র নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সোহেল রানা পূর্বদেশকে বলেন, ইতোপূর্বে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে জাল লাইসেন্স সনাক্ত হওয়ার পরে প্রত্যেককে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদÐ প্রদান করা হয়েছে। আমরা ইতোপূর্বে জালিয়াতি চক্রের ব্যাপারে কয়েকজনের কাছ থেকে শুনেছি। তিনি আরও বলেন, এ জালিয়াতি চক্রের ব্যাপারে তদন্ত করা হচ্ছে। শীঘ্রই এ চক্রকে আইনের আওতায় আনতে পারবো।