ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দেশে আনা হচ্ছে ‘নিষিদ্ধ’ ওষুধ

39

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে ব্যবহৃত মশার ওষুধের মান নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দেওয়ায় বিদেশ থেকে নতুন করে চারটি ওষুধ কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কিন্তু সরকার যে চারটি ওষুধ কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেগুলোও জনস্বাস্থ্যের জন্য কতটা নিরাপদ উঠেছে সে প্রশ্নও। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, নতুন যে চার ওষুধ কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে তার দুটি জনস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ না হওয়ায় ‘প্রত্যাহার’ করে নিয়েছে থাইল্যান্ড সরকার। আর একটি ওষুধ পরিবেশ সম্মত না হওয়ায় এক যুগ আগে বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর রেজিস্ট্রেশন বাতিল করেছে। এ অবস্থায় নতুন করে বিতর্কের মুখে পড়ছে দুই সিটি করপোরেশন। এছাড়া একটি ওষুধ নিয়ে বিতর্কের কথা জানিয়েছেন কীটতত্ত¡বিদরা। খবর বাংলা ট্রিবিউনের
জানা গেছে, ডেঙ্গু নিয়ে চলমান সংকট নিরসনের জন্য গত ২৮ জুলাই বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের যৌথ উদ্যোগে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রধানমন্ত্রী কার্যালযয়ের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক মো. আবুল কালাম আজাদ, আইন ও বিচার বিভাগের সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব সাজ্জাদুল হাসান, স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আসাদুল ইসলাম, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং স্বাস্থ্যসেবা অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও কীটনাশক বিশেষজ্ঞরা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ অনুযায়ী চারটি ওষুধ কেনার সিদ্ধান্ত হয়। ওই ওষুধগুলো হচ্ছে, ম্যালাথিউন ৫৭% ইসি, ম্যালাথিউন ৫% আরএফইউ, ডেল্টামেথ্রিন + পিআরও -২% ইডবিøউ, প্রিমিফোস- মিথাইল ৫০% ইসি।
এদিকে বিপিএল লিমিটেড কোম্পানির ‘ম্যালাথিউন ৫৭% ইসি’ কীটনাশকটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের বাতিল হওয়া কীটনাশকের তালিকায় রয়েছে। পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলায় ২০০৭ সালের দিকে এর রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে সংস্থাটি। এর সিরিয়াল নং এপি-৬৮। এর আগে ২০০৩ সালের দিকে অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন মশা নিধনে এই ওষুধটি ব্যবহার করতো। বর্তমানে বাতিল হওয়া এই ওষুধটিও কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে। বাকি ওষুধগুলোর রেজিস্ট্রেশন নেই।
তবে ওষুধের নাম নিশ্চিত করে বলতে না পারলেও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. শরীফ আহমেদ বলেন, ‘সেদিন আলোচনা হয়েছে। যে চারটি ওষুধের নাম এসেছে তার মধ্যে দুটি ওষুধই থাইল্যান্ডে ফ্রিজআউট (প্রত্যাহার) করা হয়েছে। থাইল্যান্ড থেকে এ খবর পেয়েছি। এখন যেটা থাইল্যান্ড থেকে ফ্রিজআউজ করা হয়েছে সেটা কি নেওয়া যাবে? থাইল্যান্ডের অবস্থা তো আমাদের থেকেও খারাপ। এর সঙ্গে পরিবেশের একটা বিষয় আছে। পরিবেশ সম্মত না হলে সেটা নেওয়া যাবে না।’
তিনি বলেন, ‘ওষুধ আনার পর এটার ফিল্ড টেস্ট করতে হবে। এজন্য মশার লার্ভা ধরে ২৪ ঘণ্টা গøুকোজ দিয়ে রাখতে হবে। এরপর এটা বড় হয়ে মশা হবে। তারপর এটার ফিল্ড টেস্ট করতে হবে। আমরা যখনই ওষুধের ভালো রেজাল্ট দেখবো তখনই সরকারের উচ্চ পর্যায়কে রেজিস্ট্রেশন দেওয়ার জন্য জানাবো।’
ডা. মো. শরীফ আহমেদ বলেন, ‘সভায় বিদেশ থেকে সরাসরি দ্রæত সময়ে কীটনাশক আমদানির জন্য ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নামে রেজিস্ট্রেশন করার সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ী ২৯ জুলাই উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং, খামার বাড়ির কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরে রেজিস্ট্রেশনের জন্য আবেদন করা হয়। প্রত্যাশিত কীটনাশক আমদানির ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে।’
তিনি জানান, এই ওষুধগুলো আমদানির ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। ওই সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কীটনাশকের নমুনা বিদেশ থেকে ৩১ জুলাই পৌঁছে। নমুনা পাওয়ার পর মহাখালীর আইইডিসিসআরে (রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান) কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য পাঠাতে হবে। পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়ার পর দুই সিটি করপোরেশন রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করবে। রেজিস্ট্রেশন সম্পাদনের পরপরই কীটনাশক আমদানির জন্য এলসি খোলা হবে। রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান এলসি পাওয়ার পর কীটনাশক উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু করবে। উৎপাদিত কীটনাশক কার্গো বিমানে নিকটবর্তী সিডিউল অনুযায়ী বাংলাদেশে আনা হবে। প্রত্যাশিত কীটনাশক কাস্টমস ক্লিয়ারিং শেষে সিটি করপোরেশনের হাতে পৌঁছাবে। এ কীটনাশক নির্দিষ্ট অনুপাতে মিশ্রণ শেষে ব্যবহার করতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, ‘ম্যালাথিউন সারা পৃথিবীতে ব্যবহার হয়। তবে প্রিমিফোস- মিথাইল ৫০% ইসি নিয়ে একটু কথাবার্তা রয়েছে। তারা কি এটাও তালিকায় ঢুকিয়ে দিয়েছে? আর ‘ম্যালাথিউন ৫৭% ই সি’ যদি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর নিষিদ্ধ করে থাকে তাহলে সেদিন যে মিটিং হয়েছিল সেখানে তাদের পরিচালকসহ সবাই উপস্থিত ছিলেন। তারা কেন বিষয়টি অবহিত করলেন না? যদি নিষিদ্ধ করা হয়, কী কারণে করা হয়েছে তার ব্যাখ্যা দিলেন না? তাদের তো মিটিংয়ে ডাকা হয়েছে, তারা সরকারকে গাইড করবে। সেখানে গিয়ে কেন মুখ বন্ধ করে ছিলেন?’
তিনি বলেন, ‘আমিও ওই কমিটির সদস্য। সেই মিটিংয়ে তো নির্দিষ্ট কোনও ওষুধের নাম উল্লেখ করা হয়নি। সেখানে ৪ থেকে ৫টি ওষুধ রেজিস্ট্রেশনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে যাতে একটিতে সমস্যা হলে অন্যটি ব্যবহার করা যায়। কিন্তু সিটি করপোরেশন এই তালিকা কোথায় পেলো?’
নিষিদ্ধ ওষুধ কেন আবার নেওয়া হচ্ছে, কিংবা কেন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল তা জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের পরিচালক (বালাইনাশক প্রশাসন ও মান নিয়ন্ত্রণ) কৃষিবিদ এ জেড এম ছাব্বির ইবনে জাহান বলেন, ‘এই সিদ্ধান্তটি সরকারের হাই পজিশন থেকে হয়েছে। তাই কোনও মন্তব্য করতে পারবো না।’