ডেঙ্গুঝুঁকিতে চট্টগ্রামও

98

চট্টগ্রামেও ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিয়েছে। এ পর্যন্ত ১০৩ জন ডেঙ্গুরোগী শনাক্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই ঢাকা থেকে আসা। এসব রোগীদের অনেকেই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। গত দুইদিনে শনাক্ত হয়েছে ৫২ জন রোগী। এদের মধ্যে ২৫ জন চট্টগ্রামে মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল এবং বাকিরা বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
এদিকে ডেঙ্গু মোকাবেলায় স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে ১শ শয্যার হাসপাতাল রাখার পাশাপাশি প্রায় চার হাজার পরিচ্ছন্নতাকর্মীর ছুটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বাতিল করেছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। চমেক হাসপাতালে বিশেষ সেল চালু করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে চট্টগ্রামে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১শ ৭৭ জন। আর চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে মাত্র ৫ জন ডেঙ্গু রোগী ছিল। কিন্তু রাজধানী ঢাকায় ডেঙ্গু রোগ ছড়িয়ে পড়ার পর চট্টগ্রামেও রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে সোমবার পর্যন্ত ১০৩ জন ডেঙ্গুরোগীর সন্ধান পেয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
এ পর্যন্ত চট্টগ্রামে ১০৩ জন ডেঙ্গুরোগী শনাক্ত হয়েছে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশা দমনে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) ওষুধ ছিটানোসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়ার কথা বললেও কার্যত এসব উদ্যোগ কোথাও তেমন একটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। অনেককে দিনের বেলায় মশারি টাঙিয়ে ঘুমাতে হচ্ছে ডেঙ্গু রোগবাহী মশার আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য। নগরীর অধিকাংশ এলাকায় মশার ওষুধ ছিটানো হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন নগরবাসী।
নগরের সরকারি ও বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, প্রতিদিনই শনাক্ত হচ্ছে ডেঙ্গুরোগী। গত রবিবার ও সোমবার ৫২ জন শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে জেনারেল হাসপাতালে ১ জন, আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালে ৬ জন বেসরকারি ক্লিনিক মেডিকেল সেন্টারে ৫ জন ও রয়েল হাসপাতাল, ন্যাশনাল হাসপাতালে ২ জন, রয়েল হাসপাতালে ১ জন, মেট্রোপলিটনে ৩ জন, সিএসসিআরে ১ জন, ম্যাক্স হাসপাতালে ৩ জন এবং পার্কভিউ হাসপাতালে ৩ জন করে রোগী শনাক্ত হয়। এছাড়া এর মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৫ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
চট্টগ্রামে ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা বাড়লেও আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই বলে জানিয়েছেন সিভিল সার্জন ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী। এছাড়া চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর অধিকাংশই সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে গেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। তিনি আতঙ্কিত না হয়ে জ্বর হলেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন বা হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দিয়েছেন।
তিনি জানান, ডেঙ্গু পরীক্ষার সুবিধার্থে চট্টগ্রামের ১৩টি উপজেলা হাসপাতালে ডেঙ্গু (এনএস-ওয়ান) কীট পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, রবিবার স›দ্বীপ ছাড়া বাকি সব উপজেলায় আমরা ৪০টি করে কীট পাঠিয়ে দিয়েছি। সোমবার এসব কীট হাসপাতালগুলোতে পৌঁছে গেছে। এখন হাসপাতালগুলো ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে পারবে। রোগীরা সম্পূর্ণ বিনামূল্যেই এ পরীক্ষা করার সুবিধা পাবেন।
সিভিল সার্জন বলেন, সব রোগীর ডেঙ্গু পরীক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই বাছাই করে ডেঙ্গু পরীক্ষা করা হবে। আর রোগীদের মধ্য থেকে বাছাইয়ের কাজটি করবেন তিন সদস্যের বোর্ড। পরীক্ষায় ডেঙ্গু পাওয়া গেলে তা দ্রæত আমাদের (সিভিল সার্জন কার্যালয়ের) কন্ট্রোল রুমে অবহিত করতে বলা হয়েছে। সবকয়টি হাসপাতালে ডেঙ্গু কর্নার করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, চট্টগ্রামে যাতে ডেঙ্গু মহামারী আকার ধারণ না করতে পারে, সেজন্যে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে ক্রাশ প্রোগ্রাম চালু করা হয়েছে। এ প্রোগ্রামের আওতায় নগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডের ড্রেনগুলোতে ২৫ হাজার লিটার এডাল্টিসাইড, ১০ হাজার লিটার লার্ভিসাইড ছিটানো হচ্ছে। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে লিফলেটও বিতরণ করা হচ্ছে জনগণকে সচেতন করতে।
সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন বলেন, সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়া প্রতিরোধে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ক্রাশ প্রোগ্রাম গ্রহণ করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক হাসান শাহরিয়ার কবির বলেন, ডেঙ্গুরোগী বেড়েই চলেছে। শহরের পাশাপাশি উপজেলার গ্রামাঞ্চল থেকেও সদরের হাসপাতালগুলোতে রোগী আসছে। তবে পরিস্থিতি এখনও তেমন উদ্বেগজনক বলে আমরা মনে করছি না।
অন্যদিকে মেডিসিন ওয়ার্ডে আলাদা বøক করে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের রাখার কথা জানিয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল প্রশাসন। মেডিসিন ওয়ার্ডের তিনটি ইউনিটে প্রতিটিতে ২০ শয্যা করে ডেঙ্গু বøক করা হচ্ছে। চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু রোগীদের মশারি টাঙিয়ে রাখা হয়েছে। হাসপাতালের চিকিৎসকদের নিয়ে একটি টিমও গঠন করা হয়েছে।
চমেক হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আখতারুল ইসলাম জানান, হাসপাতালে ডেঙ্গুরোগীদের জন্য বিশেষ সেল চালু করা হয়েছে। আলাদা বøক করা হয়েছে। অনেকে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন।

মশা নিধন
নতুন ওষুধ সংগ্রহের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর
কার্যালয়ের

ঢাকার ২ সিটি কর্পোরেশনে ব্যবহৃত মশার ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার প্রেক্ষাপটে নতুন ওষুধ সংগ্রহের নির্দেশ দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। ৩ দিনের মধ্যে তা সংগ্রহ করে রেজিস্ট্রেশন সম্পন্নের কথা বলা হয়েছে। এজন্য সিটি কর্পোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে বিদেশি ৫টি নামকরা কোম্পানি নতুন করে রেজিস্ট্রেশনের আওতায় আসবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
রাজধানীসহ প্রায় সারাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে বেসরকারি হিসাবে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে মশা নিধনে দুই সিটির ব্যবহৃত ওষুধ কার্যকর নয়- এমন জোরালো অভিযোগ আছে। সিটি কর্পোরেশনও অবশ্য স্বীকার করেছে, তাদের ওষুধে মশা মরে না।
এ পটভূমিতে গত ২৮ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়র মুখ্য সমন্বয়ক (এসডিজি) মো. আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় দুই সিটি কর্পোরেশনের প্রধান দুই স্বাস্থ্য ও ভান্ডার কর্মকর্তাসহ কয়েকজন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় নগরীতে ডেঙ্গুবাহিত এডিস মশা নিধনে ৩ দিনের মধ্যে নতুন ওষুধ সংগ্রহ করে দ্রæত রেজিস্ট্রেশন দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তবে পুরনো ওষুধের মধ্যে লার্ভিসাইডিং নিয়ে কোনও বিতর্ক না থাকায় সেটি আগের মতো ব্যবহার করা হবে। খবর বাংলা ট্রিবিউনের
সভায় উপস্থিত এক কর্মকর্তা জানান, বৈঠকে নতুন ওষুধ সংগ্রহের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে কমপক্ষে বিদেশি ৫ কোম্পানির ওষুধের দ্রæত রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হবে। ওষুধে যাতে কোনও ধরনের সমস্যা না হয়, সেদিকে নজর রাখার তাগিদ দেওয়া হয়।
জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. শরীফ আহমেদ বলেন, ‘ওষুধের ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি রয়েছে। ৩ দিন বা তারও কম সময়ের মধ্যে নতুন করে ওষুধ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেসব ওষুধের দ্রæত রেজিস্ট্রেশন দেওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরপর সেই ওষুধ ব্যবহার করা হবে’।
সূত্র জানায়, নতুন কীটনাশক না কেনা পর্যন্ত বর্তমানে ব্যবহৃত কীটনাশকের ঘনত্ব বাড়িয়ে ডিএনসিসিকে ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছেন বৈঠকে উপস্থিত বিশেষজ্ঞরা।
গত ১৫ জুলাই ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) তাদের ওষুধ পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়ে একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করে। এরপর ২৩ জুলাই কমিটি করে ঢাকা ডিএসসিসি। বলা হয়েছে, এই কমিটি প্রতি ৩ মাস পরপর বৈঠক করে মশার ওষুধ বিষয়ে অভিমত দেবে। ওই কমিটি গঠনের পর ডিএসসিসি মেয়র মো. সাঈদ খোকন জানিয়েছিলেন, সমালোচনা নিরসনে তারা সরকারের ম্যান্ডেট পাওয়া সংস্থা রোগতত্ত¡, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে (আইইডিসিআর) মশা মারার ওষুধ সরবরাহ করবে। তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রয়োজনে ব্যবহার করা হবে নয়তো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডবিøউএইচও) কাছে পাঠানো হবে। তবে গতকাল সোমবার পর্যন্ত এ পরীক্ষার ফল সিটি কর্পোরেশনে পৌঁছায়নি। এরই মধ্যে গত ২০ জুলাই রাজধানীর বনানীতে নিজ বাসভবনে মেয়র খোকন ডবিøউএইচও’র ৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে তিনি জানান, ওষুধের বিস্তারিত ফল ডবিøউএইচও’র কাছে পাঠানো হয়েছে। তবে ডবিøউএইচও থেকে এখনও কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি।

আগেই সতর্ক করেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

এবারের বর্ষা মৌসুমে এডিস মশার প্রাদুর্ভাব ও ডেঙ্গুর প্রকোপ যে বাড়তে পারে, সে বিষয়ে সিটি কর্পোরেশনসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে আগেই সতর্ক করা হয়েছিল বলে জানালো স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। মশা নিয়ন্ত্রণ ও ডেঙ্গু প্রতিরোধে সিটি কর্পোরেশনের ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যেই সরকারের আরেক দপ্তর থেকে এমন বক্তব্য এলো।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে সর্বশেষ প্রস্তুতি জানাতে গতকাল সোমবার মহাখালীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সভাকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ডা. সানিয়া তাহমিনা ঝরা বলেন, প্রাণঘাতি এ রোগ যে ঢাকার বাইরেও ছড়াতে পারে, সেই আশঙ্কার কথাও তারা আগেই জানিয়েছিলেন। হ্যাঁ, আমরা ধারণা করতে পেরেছিলাম। ডাক্তারদেরকে ফেব্রæয়ারি মাস থেকেই সতর্ক করা হচ্ছিল যাতে তারা ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রস্তুতি নিতে পারে’।
ডা. সানিয়া জানান, মার্চ মাসে তারা ঢাকায় এডিস মশার বিষয়ে জরিপ চালান। তখনই সিটি কর্পোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে রাখা হয়েছিল। আশঙ্কা থেকেই আমরা ডেঙ্গু গাইডলাইন আপডেট করেছি। ইতোমধ্যে প্রতিটি জেলাশহরে ডেঙ্গু টেস্ট কিট পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ঢাকায় এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ বাড়তে শুরু করে গত জুন মাস থেকে। জুলাইয়ের শেষে এসে তা রাজধানীর বাইরেও ছড়িয়ে পড়ছে। এবার ডেঙ্গুর লক্ষ্যণ ও উপসর্গগুলো আলাদা হওয়ায় শুরু থেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছেন চিকিৎসকরা। এই পরিস্থিতিতে মশা নিধনে ব্যর্থতার জন্য ঢাকার দুই মেয়র সাঈদ খোকন ও আতিকুল ইসলাম তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন। এই নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করে হাই কোর্টের একজন বিচারক বলেন, পৃথিবীর আর কোনো দেশে মশা মারতে আদালতকে রুল দিতে হয় না। খবর বিডিনিউজের
মেয়র সাঈদ খোকন অবশ্য পরিস্থিতি ‘নিয়ন্ত্রণে’ আছে বলেই দাবি করে আসছিলেন। ডেঙ্গু আক্রান্তের তথ্য নিয়ে সংবাদমাধ্যমে আসা প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করার পাশাপাশি ডেঙ্গু নিয়ে ‘ছেলেধরার মতো গুজব’ ছড়ানো হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেছিলেন তিনি। তবে গত রবিবার ঢাকার এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু রোগীদের দেখতে গিয়ে তিনিও স্বীকার করেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি এখন ‘উদ্বেগজনক’।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, গত শনিবার সকাল ৮টা থেকে রবিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় রেকর্ড ৮২৪ জন ডেঙ্গু রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ডেঙ্গুর বিস্তার বাড়তে থাকায় রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে রোগীদের স্থান সংকুলান হচ্ছে না। ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ সরকারি হাসপাতালগুলোতে নির্ধারিত শয্যার বাইরেও মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে রোগীদের।
তবে বেসরকারি হাসপাতালগুলো ধারণক্ষমতার বাইরে রোগী ভর্তি করছে না। ফলে নতুন করে ডেঙ্গু আক্রান্তদের নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে দৌড়াতে হচ্ছে স্বজনদের।
অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বছরের শুরু থেকে রবিবার পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১১ হাজার ৬৫৪ জন ডেঙ্গু রোগী। এ সময়ের মধ্যে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন ৮ হাজার ৭২৫ জন। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত ২০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে এলেও সরকারি হিসাবে এখনও মৃতের সংখ্যা আটজন।
মৃতের সংখ্যা ও হাসপাতালে ভর্তির প্রকৃত সংখ্যা কেন জানা যাচ্ছে না- এই প্রশ্নে ডা. সানিয়া বলেন, ‘বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে বার বার বলার পরেও তাদের অনেকে তালিকাগুলো দেয়নি। তারা ডেঙ্গু রোগী সামলাতে গিয়ে অনেক চাপে আছে হয়তো’। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ডেঙ্গু পরীক্ষায় বেঁধে দেওয়া ফি ঠিকমত আদায় হচ্ছে কিনা- সে বিষয়ে নজরদারি করতে অধিদপ্তরের ১০টি দল গতকাল সোমবার থেকে মাঠে নেমেছে।
পাশাপাশি প্রতিটি হাসপাতালে ‘ডেঙ্গু কর্নার’ এবং বিষয়টি তদারকি করার জন্য একজন ফোকাল পয়েন্ট নিয়োগ দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া দেশের প্রবেশমুখগুলোতে, বিশেষ করে বিমানবন্দর ও স্থল বন্দরে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আগামী বৃহস্পতিবার মেডিকেল কলেজগুলোর তত্ত¡াবধানে ঢাকার প্রতিটি জোনে ডেঙ্গু সচেতনতামূলক প্রচারাভিযান চালাবে বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।

ডেঙ্গু ছড়িয়েছে
৫০ জেলায়

ডেঙ্গু ছড়িয়েছে ৫০ জেলায়। গত ২৪ ঘণ্টায় আরও এক হাজার ৯৬ জন বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এবার বর্ষার শুরুতেই ঢাকায় মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব ঘটে, এখন বিভিন্ন জেলা থেকে আক্রান্তের খবর আসছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গতকাল সোমবার জানিয়েছে ৫০টি জেলায় ডেঙ্গুরোগী শনাক্ত হয়েছে।
বিভিন্ন জেলায় আক্রান্তদের অনেকে ঢাকা থেকে রোগ নিয়ে গেছেন। তবে রাজধানীর বাইরেও এডিস
মশার বিচরণ রয়েছে বলে স্থানীয় পর্যায়ে আক্রান্তের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, মশাবাহিত এই রোগে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় (রবিবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল সোমবার সকাল ৮টা) ১ হাজার ৯৬ জন দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর আগের ২৪ ঘণ্টায় ৮২৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল।
অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বছরের শুরু থেকে গতকাল সোমবার পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১৩ হাজার ৬৩৭ জন ডেঙ্গু রোগী। বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি আছেন তিন হাজার ৮৪৭ জন। এ সময়ের মধ্যে হাসপাতাল থেকে নয় হাজার ৭৮২ জন ছাড়পত্র পেয়েছেন বলে জানাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। খবর বিডিনিউজের
গত ২৪ ঘণ্টায় শুধু ঢাকার সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেই ভর্তি হয়েছে ৮৫৬ জন ডেঙ্গু রোগী। সবচেয়ে বেশি ১২৫ জন ভর্তি হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এছাড়া রাজধানীর বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে আরও ২৬৫ জন ডেঙ্গু রোগী গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে অন্তত ২৫ জনের বেশি মানুষের মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে এলেও সরকারি হিসাবে এখনও মৃতের সংখ্যা আটজন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে মিটফোর্ডে ১১৩, শিশু হাসপাতালে ৩৪, সোহরাওয়ার্দীতে ৪৮, হলি ফ্যামিলিতে ৪১, বারডেমে ২৩, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৭, পুলিশ হাসপাতালে ২১, মুগদা মেডিকেলে ৬০, বিজিবি হাসপাতালে ১০ এবং কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ৭৯ ডেঙ্গু রোগী গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছে। একই সময়ে রাজধানীর বাইরে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে গত ২৪ ঘণ্টায় মোট ১ হাজার ২৮৩ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি আছে ৫৩১ জন।
তীব্র জ্বর, মাথা ব্যথা ও মাংসপেশিতে ব্যথা, শরীরে লালচে দানা ইত্যাদি ডেঙ্গু রোগের লক্ষ্যণ হলেও এবার এর ব্যতিক্রম পাওয়া যাচ্ছে। জ্বর হলে কাছের হাসপাতালে কিংবা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে রক্তের পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিয়েছে সরকার। চিকিৎসকরা জ্বরে প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়া থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি রোগীকে বেশি বেশি তরল খাবার খাওয়াতে বলেছেন।
এবার ডেঙ্গুজ্বরে রক্তের ঘনত্ব কমে যাওয়ার লক্ষ্যণ দেখা দেওয়ায় আক্রান্তের রক্তচাপ কমে যাচ্ছে কি না, তা নিয়মিত পরীক্ষা করতে বলা হচ্ছে। জ্বর ভালো হওয়ার পরও ডেঙ্গুজনিত মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে বলে সতর্ক করছেন চিকিৎসকরা। এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ায় তা প্রতিরোধে বাড়ির আশপাশ পরিচ্ছন্ন রাখতে বলা হচ্ছে।
অফিস, ঘর ও আশেপাশে যে কোনো পাত্রে (এসির ট্রে/ফুলের টব) জমে থাকা পানি তিন দিনের মধ্যে পরিবর্তন করতে পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। এডিস মশা সাধারণত দিনের বেলা কামড়ায় বলে দিনে ঘুমানোর ক্ষেত্রেও মশারি ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

বিনামূল্যে রক্ত
পরীক্ষা চসিকের

গতকাল সোমবার থেকে ডেঙ্গু জ্বরের ফ্রি রক্ত পরীক্ষা শুরু হয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন জেনারেল হাসপাতালে। গতকাল সকালে নগরীর আলকরণ মোড়ে চসিক জেনারেল হাসপাতালে বিনামূল্যে ডেঙ্গু জ্বরের এই পরীক্ষা উদ্বোধন করেন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের বিনামূল্যে ডেঙ্গু এনএস ওয়ান, সিবিসি ও প্লাটিলেট পরীক্ষা করাচ্ছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন জেনারেল হাসপাতাল। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এই কর্মসূচি চলবে। এছাড়া কারও জ্বর ও ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দিলে তাৎক্ষণিক পার্শ¦বর্তী চিকিৎসা কেন্দ্রে চিকিৎসকের চিকিৎসা নেয়ার পরামর্শ দিয়েছে চসিক। চসিকের এই স্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিদিন সকাল ৮টা হতে বিকাল ২টা পর্যন্ত ডেঙ্গু সংক্রান্ত বিষয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও পরামর্শ দেবে। উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত সমাবেশে নগরবাসীকে আগাম সতর্ক করতে জনসচেতনতামূলক যে কর্মসূচি চসিক গ্রহণ করেছে, সেই কর্মসূচিকে আরো বেগবান করতে গণমাধ্যমকর্মীদের সহযোগিতা চাইলেন সিটি মেয়র।
তিনি বলেন, সচেতনতা ছাড়া ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধ করা চসিকের একার পক্ষে সম্ভব নয়। ডেঙ্গু রোগ প্রাদুর্ভাব রোধে নগরবাসীর মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে গণমাধ্যমকর্মীদের সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে। এই ব্যাপারে শুধু গণমাধ্যম কর্মী নয়, এতে সবার দায়িত্ব রয়েছে। রয়েছে দায়িত্বশীল ভুমিকাও। শুধু চসিকের দিকে তাকিয়ে থাকলেই চলবে না, প্রত্যেক নাগরিকের উচিত হবে স্ব স্ব বাড়িঘরের আশপাশে এডিসের প্রজনন হতে পারে, এমন সব স্থান ধ্বংস করা। দিনের বেলায় শিশুদের ঘুমের সময় মশারি ব্যবহার করাও সকল অভিভাবকের দায়িত্ব। সিটি মেয়র আরো বলেন, বিভিন্ন পেক্ষাপটে বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের জলবায়ুর পরিবর্তন হয়েছে। এই পরিবর্তনজনিত কারণে তাপমাত্রা ২৮ ডিগ্রি থেকে ৩৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে বিদ্যমান। এই ধরনের তাপমাত্রা ডেঙ্গু রোগ বাহক এডিস মশার প্রজননের জন্য উপযোগী তাপমাত্রা। তাই ডেঙ্গু থেকে মুক্তির জন্য আমাদেরকে এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র বাসাবাড়ির ফ্রিজ, টয়লেট, ডাবের খোসা, ফুলের টবসহ স্যাঁতস্যাঁতে জায়গা পরিস্কার রাখতে হবে। এই প্রসঙ্গে সিটি মেয়র বলেন, চিকনগুনিয়া ও ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব ও সংক্রমণ থেকে নগরবাসীকে রক্ষার জন্য চসিকের ক্রাশ প্রোগ্রাম চলমান রয়েছে। সচেতনতা সৃষ্টিতে প্রচার প্রচারণা কায়ক্রমও পরিচালনা করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, চসিকের পরিচ্ছন্ন কর্মীরা প্রতিটি ওয়ার্ডে ঝোপ-ঝাপ এবং নালা নর্দমা পরিস্কারসহ এডিস মশার এবং মশার লার্ভা ধ্বংসকারী ওষুধ ছিটাচ্ছে প্রতিদিন। এই পরিচ্ছন্ন কাজটি নিবিড়ভাবে দেখভাল করার জন্য ওয়ার্ড কাউন্সিলর, সংরক্ষিত ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের প্রতি আহবান জানান সিটি মেয়র। তিনি বলেন, কারও জ্বর বা ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দিলে তাৎক্ষণিক চসিক জেনারেল হাসপাতাল, নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্র হতে বিনামূল্যে রক্ত পরীক্ষা ও চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারবেন। যতদিন পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব থাকবে, ততদিন চসিকের সকল স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ডেঙ্গুর পরীক্ষা করা হবে। প্রয়োজনে ০৩১- ৬৩৪৫৮৪, ০৩১-৬১৬৫৫৫ নম্বরে যোগাযোগ করার অনুরোধ মেয়রের। বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারসমূহে ডেঙ্গু রোগ পরীক্ষা সংক্রান্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনাকে সাধুবাদ জানিয়ে সিটি মেয়র সরকার কর্তৃক ডেঙ্গু রোগ পরীক্ষা যে ফ্রি ধার্য করে দিয়েছে, তা নগরীর বেসরকারি ক্লিনিক মালিকগণ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
চসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান কাউন্সিলর নাজমুল হক ডিউক এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় কাউন্সিলর তারেক সোলায়মান সেলিম, কাউন্সিলর হাসান মুরাদ বিপ্লব, সিটি মেয়রের একান্ত সচিব আবুল হাসেম ও ডাক্তার ইসরাত জাহান জুলি, ডাক্তার আশীষ মুখার্জী, ডাক্তার ইমাম হোসেন রানা, ডাক্তার আর পি আসিফ খানসহ চসিক জোনাল মেডিকেল অফিসার ও মেডিকেল অফিসারগণ এই সময় উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে চসিক প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সেলিম আকতার চৌধুরী শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন। সভা পরিচালনা করেন চসিক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাক্তার মোহাম্মদ আলী। গতকাল চসিক জেনারেল হাসপাতালে ৬০ জনকে ফ্রি ডেঙ্গু জ্বরের রক্ত পরীক্ষা করা হয়। অন্যান্য চিকিৎসা নিয়েছে ২শ এর অধিক। খবর বিজ্ঞপ্তির