ডিসেম্বরে দুই বড় প্রকল্প ও ২০২৪-এ মাতারবাড়ি দেবে বিদ্যুতে সুখবর

26

মনিরুল ইসলাম মুন্না

দেশব্যাপী লোডশেডিং থেকে মুক্তি পেতে সেপ্টেম্বর মাসে লোডশেডিং কমানোর আশ্বাস দিয়েছিল বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী। তারপরও নগরীসহ অন্যান্য জায়গায় এখনও নিয়মিত লোডশেডিং হচ্ছে। বিশেষ করে গ্রামে দৈনিক ১২ থেকে ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং করছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। তবে আশার বাণী হচ্ছে আগামি ডিসেম্বরে রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও ভারতের ঝাড়খন্ডে আদানি পাওয়ার প্ল্যান্ট চালু হতে যাচ্ছে। এছাড়াও ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্রও চালু হয়ে যাবে। এতে বিদ্যুতের সংকট কমবে, তৈরি হবে নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিম পূর্বদেশকে বলেন, বিদ্যুতের সংকটটা সাময়িক। শীঘ্রই এর থেকে আমরা বেরিয়ে আসব।
গত জুলাই মাসের শুরু থেকে লোডশেডিং এর মাত্রা বাড়তে থাকে। প্রথমে অল্প সময় হলে পরবর্তীতে গ্যাস স্বল্পতার কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ থাকায় দীর্ঘ সময় পর্যন্ত গড়ায়। পরবর্তীতে বিদ্যুতের সংকট কাটিয়ে তুলতে কিছু পদক্ষেপ নেয় সরকার। এরমধ্যে এলাকাভিত্তিক বিদ্যুতের লোডশেডিং, রাত আটটার পর দোকানপাট-শপিং মল বন্ধ, সরকারি অফিসে বিদ্যুতের ব্যবহার ২৫ শতাংশ কমানো, অধিকাংশ বৈঠক অনলাইনে করা, অত্যাবশ্যক না হলে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ পরিহার এবং শিক্ষার্থী পরিবহনে ব্যক্তিগত যানবাহনের ব্যবহার যৌক্তিকীকরণ ইত্যাদি। এর মধ্যে এমন পদক্ষেপও আছে, যা কেবল সংকটকালে নয়, সব সময়ের জন্যই জরুরি। যেমন সরকারি অফিসে বিদ্যুতের ব্যবহার কমানো, যথাসম্ভব অনলাইনে বৈঠক এবং অতি জরুরি না হলে কর্মকর্তাদের বিদেশ যাওয়া বন্ধ করা ইত্যাদি। আর এভাবে কিছুটা বিদ্যুৎ সাশ্রয় হলে পরবর্তীতে তা কাজে লাগবে- এমন উদ্দেশ্যে এসব পদক্ষেপ নেয়া হয়।
গত জুলাই মাসে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, সেপ্টেম্বরে লোডশেডিং অর্ধেকে নেমে আসবে, তারপর থেকে লোডশেডিং একেবারেই কমে যাবে। তবে চলতি মাসের মাঝামাঝি লোডশেডিং কিছুটা কমেও এসেছিল। তবে হঠাৎ করেই গত এক সপ্তাহে তা অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। ভেঙে পড়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি। দিনে এক ঘণ্টা লোডশেডিং দেয়া হবে বলে ঘোষণা থাকলেও নগরীতে এলাকাভেদে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নগর এলাকায় বিদ্যুৎ কিছুটা স্বাভাবিক হলেও পল্লী অঞ্চলে আরও ভয়াবহ। এমনকি গ্রামাঞ্চলে দিনে ১৮-২০ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হচ্ছে। এর মূল কারণ জাতীয় পর্যায়ে গ্যাস ও ফার্নেস অয়েলের সংকট। একদিকে পেট্রোবাংলার বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে, অপরদিকে আমদানি বিল ঠিকমতো পরিশোধ না করায় ফার্নেস অয়েলের আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে কয়েকটি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিক।
এছাড়াও গত এক সপ্তাহ ধরে মধ্যরাতের দিকে বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। যদিও সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর ঘোষিত লোডশেডিংয়ের দৈনিক সময়সূচিতে রাত ১১ টার পর বিদ্যুৎ যাওয়ার কথা নয়।
এদিকে রাত ১২ টার পর থেকে রাত দুইটা পর্যন্ত বেশ কয়েকবার বিদ্যুৎ আসা যাওয়া করছে। তীব্র দাবদাহে কষ্ট পাচ্ছে শিশু ও বয়োবৃদ্ধরা। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র সমালোচনার ঝড় বইছে। কেউ কেউ বলছে, সরকার বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ঠিক রাখতে পারছে না। আর কেউ কেউ বলছে, বিদ্যুৎ বিভাগ সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা করছে, লোডশেডিং কমাবে বলে কমাচ্ছে না ইত্যাদি।
তাপমাত্রা কমে না আসা পর্যন্ত পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। এমন পরিস্থিতিতেই বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) আগামি ১৩ অক্টোবরের মধ্যে বিদ্যুতের নতুন দাম ঘোষণা করবে বলে জানা যায়।
নগরীর স্টার্ক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সল্যুশেনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম ইমন পূর্বদেশকে জানান, বিদ্যুৎ বিভ্রাটের হাত থেকে মুক্তির প্রতিশ্রুতির পেছনে সরকারের হয়তো যুক্তি ছিল, বছরের এ সময় নাগাদ তাপমাত্রা কমে আসবে এবং বিদ্যুতের চাহিদাও সে অনুযায়ী কমবে। তিনি আরও বলেন, সরকার হয়তো এটাও আশা করেছিল যে পায়রা বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থেকে যে অসমাপ্ত সঞ্চালন লাইন, তার কাজ সেপ্টেম্বরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু সেটাও হয়নি।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নিয়াজ আহমেদ বলেন, গত ৩ দিন ধরে মাঝরাতের দিকে ৩০-৪০ মিনিট করে বিদ্যুৎ থাকছে না। আমি বুঝতে পারছি না, কেন অফিস ও কারখানা বন্ধ থাকার সময়ে এরকম হচ্ছে।
পিডিবির দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিম পূর্বদেশকে জানান, বিদ্যুৎ বিভ্রাট পরিস্থিতির অবনতির জন্য আংশিকভাবে গত সপ্তাহের অস্বাভাবিক উষ্ণ আবহাওয়া দায়ী। প্রচন্ড গরমের কারণে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ব্যবহারের চাহিদা বেড়েছে। তবে সামনে তা কমে আসবে। চট্টগ্রামে সাড়ে ১২০০ থেকে সাড়ে ১৩০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত চাহিদা থাকে। তা আবার গ্রাহকের ব্যবহারের উপর কম-বেশি হয়। এরপরও দেশে বিদ্যুৎ খাতে যেমন ঘাটতি নেই, তেমনি চট্টগ্রামেও বিদ্যুৎ সরবরাহে আমাদের কোনো কৃপণতা নেই। কিন্তু জাতীয়ভাবে বিদ্যুতের সংকট থাকায় গত দুই দিনে নগরীতে আড়াইশ থেকে তিনশো মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা থাকা স্বত্বেও সরবরাহ করতে পারিনি। এতে এক ফিডার বন্ধ রেখে অন্য ফিডারে সরবরাহ করতে হচ্ছে। তবে দেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় চট্টগ্রাম অনেক ভাল অবস্থানে আছে।
নগরীতে রাত ৮ টার পর থেকে দোকানপাট বন্ধ রাখতে নির্দেশনা দেয়া হলেও মানেনি কোনো ব্যবসায়ী। সরকারি নির্দেশনা মানাতে ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে নিয়মিত অভিযান চালিয়ে আগস্ট মাসেই ১৮০ মামলায় ৮ লাখ ৪১ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা আদায় করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। তবে নিয়মিত জরিমানা গুণেও নগরের বিভিন্ন এলাকায় এ নির্দেশনা মানতে দেখা যায়নি ব্যবসায়ীদের। উল্টো সরকারি নির্দেশনাকে ‘বুড়ো আঙ্গুল’ দেখিয়ে প্রশাসনের সাথে চোর পুলিশ খেলছেন ব্যবসায়ীরা।
এদিকে আগামি বিজয় দিবসে সরকারের দু’টি বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধনের পরিকল্পনা রয়েছে। বাগেরহাটের রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র আরেকটি ভারতের ঝাড়খন্ডে নির্মাণাধীন আদানি পাওয়ার প্ল্যান্ট। এই দুই বিদ্যুৎকেন্দ্রই বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ উদ্যোগে নির্মাণ করা হচ্ছে। এই দুই বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধন হলে ২ হাজার ২৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, আগামি ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে দু’টি বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধনের চিন্তা করা হচ্ছে। আর এর উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্ত্র মোদী। এখন কিভাবে উদ্বোধন করা হবে এ নিয়ে পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
জানা গেছে, সরকারের অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্পগুলোর একটি রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র। ১৩২০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করতে ব্যয় হচ্ছে ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সুন্দরবনসংলগ্ন বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার সাপমারি-কাটাখালী ও কৈর্গদাশকাঠী এলাকায় ১৮৩৪ একর জমির ওপরে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ভারত সরকারের কনসেশনাল ফাইন্যান্সিং স্কিমের অধীনে নির্মিত হচ্ছে। এটি বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড, ভারতের এনটিপিসি লিমিটেড এবং বাংলাদেশের পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (পিডিবি) মধ্যে একটি ফিফটি ফিফটি জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানি।
অন্যদিকে, রূপকল্প ২০৪১ এবং বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনায় পরিষ্কার বলা হয়েছে দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে দেশীয় সোর্সের পাশাপাশি বিদেশ থেকে বিদ্যুৎ আমদানির কথা। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই ভারত থেকে বর্তমানে ১১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে সরকার। আরও ১৬০০ মেগাওয়াট আসার অপেক্ষায়। সে লক্ষ্যে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে সহযোগিতার জন্য ২০১১ সালে ভারত-বাংলাদেশ সহযোগিতামূলক ‘ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট’ স্বাক্ষর হয়। সেই চুক্তির আওতায় ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় ভারতের বিশিষ্ট ধনী ব্যবসায়ি আদানি গৌতম প্রতিষ্ঠিত আদানি গোড্ডা পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণে সমঝোতা সই করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-বিপিডিবি। এই সমঝোতা চুক্তির আওতায় শুধুমাত্র বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ দেওয়ার জন্য ভারতের ঝাড়খন্ড প্রদেশের গোড্ডা জেলায় ১৬০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার একটি তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে আদানি গ্রæপ। বিপিডিবির তথ্যানুযায়ী, আদানি পাওয়ারও গত আগস্ট থেকে পরীক্ষামূলক উৎপাদনে যায়। চুক্তি অনুযায়ী আদানি পাওয়ারের গত বছর থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহের কথা ছিলো। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ কাজ ছয় মাস পিছিয়ে যায়।
এদিকে বিপিডিবি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে আদানি পাওয়ারের কাজ শেষের দিকে। এখন বাংলাদেশ অংশে সঞ্চালন লাইনের পরীক্ষা চালানো হবে। শীঘ্রই এ কাজ শুরু করা হবে। সাবস্টেশন নির্মাণ কাজ শেষ না হওয়ায় প্রাথমিকভাবে ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সঞ্চালন দিয়ে শুরু হবে।
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, সব কাজ শেষ করে আগামি ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আমাদের বাংলাদেশের অংশের কাজ এখনও শেষ হয়নি। ফলে আগামি মাস থেকে পরীক্ষামূলক সঞ্চালন শুরু হবে। মূল বিদ্যুৎ ডিসেম্বরে পাবো আমরা। রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং আদানি পাওয়ার প্ল্যান্ট দুটোই ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে উদ্বোধন করার কথা রয়েছে।
এ দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাশাপাশি কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলায় মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের প্রথম ইউনিটে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে। দ্বিতীয় ইউনিটে শুরু হবে একই বছরের জুলাই মাসে। ৫১ হাজার সাড়ে ৮শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইতোমধ্যে পোর্ট ও ভৌত অবকাঠামোর কাজ ৮২ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে, সার্বিক ভৌত অবকাঠামোর কাজ হয়েছে ৬৫ শতাংশ- এই তথ্য জানান মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিচালক আবুল কালাম।