ডিজিটাল হাজিরা শুধু কর্মচারীদের জন্যই!

99

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যথাসময়ে কর্মস্থলে উপস্থিতি বা হাজিরা নিশ্চিত করতে এবং অনিয়ম ঠেকাতে তিন বছর আগে বসানো হয়েছিল ডিজিটাল ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেশিন। কিন্তু প্রথম থেকে এ ডিজিটাল হাজিরা মেশিনে অনীহা কর্মকতা-কর্মচারীদের। যার কারণে প্রথম দুই বছর কার্যত কোনো ব্যবহারই ছিল না এ হাজিরা মেশিনের। পরে গত বছরের অক্টোবর মাস থেকে মেয়রের নির্দেশনায় ডিজিটাল হাজিরা অনুযায়ী বেতন প্রদানে বিভাগীয় প্রধানদের চিঠি দেওয়া হয়েছিল।
তবে কর্মচারীদের জন্য এ নিয়ম কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হলেও পার পেয়ে যাচ্ছেন কর্মকর্তারা। তাদের ক্ষেত্রে ‘মান্ধাতা’ আমলের কাগুজে হাজিরাই যথেষ্ট। তবে কর্মচারীদের দিতে হয় ডিজিটাল হাজিরায় ফিঙ্গারপ্রিন্ট। এটা রীতিমত বৈষম্য বলে মনে করেন সিটি কর্পোরেশনের কর্মচারীরা।
তবে এ বিষয়ে অবগত হওয়ার পর সিটি মেয়র সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, যারা লিখিত নির্দেশনার বাইরে মৌখিক নির্দেশনা দিয়ে ডিজিটাল হাজিরা দিচ্ছেন না। তারা অফিসের আইন-শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজ করছেন। এটা সহ্য করা হবে না।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, আ জ ম নাছির উদ্দীন মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে নগর ভবনে চালু হয় ডিজিটাল হাজিরা পদ্ধতি। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের কর্মসূচির অংশ হিসেবে চসিকের পুরাতন ভবনে ৪টি ফ্লোরে ৪টি ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেশিন বসানো হয়েছিল। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সময়মত অফিসে উপস্থিতি ও কর্মক্ষেত্রে ফাঁকিরোধে এ মেশিন বসানো হয়। ডিজিটাল পদ্ধতিতে হাজিরা নেওয়া হলে ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ থাকে না। এ কারণে প্রথম থেকে হাজিরা মেশিনে অনীহা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। তাই মেয়রের অজান্তেই দুই বছর মেশিন থাকলেও ব্যবহার করা হয়নি। ফলে বেতন-ভাতা হয়েছিল কাগুজে হাজিরা খাতায়। যেটা নিয়ন্ত্রণ করেন বিভাগীয় প্রধানরা।
গত বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর পূর্বদেশ পত্রিকায় ‘চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন/ডিজিটাল হাজিরা মেশিন কেবলই আইওয়াশ!’ শিরোনামে খবর প্রকাশিত হলে মেয়রের নজর আসে বিষয়টি। তখন তার নির্দেশনায় ওই বছরের অক্টোবর মাস থেকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট অনুসারে বেতন বিল প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সংস্থাটি। এলক্ষ্যে সকল বিভাগীয় ও শাখা প্রধানকে অবহিত করে চিঠি দিয়েছিল তৎকালীন চসিকের সচিব মোহাম্মদ আবুল হোসেন। পরবর্তীতে ওই সচিবই মৌখিকভাবে আইটি অফিসারকে নির্দেশনা দিয়েছিলেন, সকল বিভাগীয় প্রধান ও প্রকৌশল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ডিজিটাল হাজিরা দিবেন না। তাদের জন্য এ নিয়ম প্রযোজ্য হবে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কর্পোরেশনের আইটি অফিসার মোহাম্মদ ইকবাল হাসান বলেন, মেয়রের নির্দেশনায় বিভাগীয় প্রধানদের চিঠি দেওয়ার পর সবার জন্য ডিজিটাল হজিরা কার্যকর করা হয়েছিল। তবে কার্যকরের কিছুদিনের মধ্যে তৎকালীন সচিব আবুল হাসান স্যার আমাকে মৌখিক নির্দেশনা দেন, নির্বাহী প্রকৌশলী থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ডিজিটাল হাজিরা দেওয়া থেকে মুক্ত থাকবেন। তারা পূর্বের কাগুজে হাজিরা খাতায় হাজিরা দিবেন। ওই সময় তিনি বিষয়টি নিয়ে কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহীর সাথে আলাপ হয়েছিল বলে জানান। এরপর থেকে এভাবে চলে আসছে।
বিষয়টি নিয়ে চসিকের বর্তমান সচিব আবু শাহেদ চৌধুরী বলেন, ‘কর্পোরশেন নিজস্ব নিয়মে চলে। এখানে আমরা যেভাবে বলব, প্রতিষ্ঠান সেভাবে চলবে। কর্মকর্তারা ২৪ ঘণ্টা পরিশ্রম করেন এবং যে সময়টা ঘুমান, তাও কর্পোরেশনের স্বার্থে। তাই তাদের জন্য ফিঙ্গারপ্রিন্ট বাধ্যতামূলক না। লিখিত অফিস আদেশে কি লেখা আছে, সেটা দেখলে তো চলবে না।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্পোরশনের এক কর্মচারী জানান, ডিজিটাল দেশে মেয়র মহোদয় ডিজিটাল হাজিরা বসিয়েছেন, আমরা সাধুবাদ জানাই। তবে কর্মচারীদের জন্য সেটা কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হবে। কিন্তু যারা আমাদের জন্য এ নিয়ম প্রয়োগ করছেন, তারা নিজেরাই এ নিয়ম মানেন না। তাহলে তো সেটা রীতিমত বৈষম্য করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন শ্রমিক-কর্মচারী লীগের (সিবিএ) সাধারণ সম্পাদক মোরশেদুল আলম চৌধুরী বলেন, আমরা সবাই জানি, ডিজিটাল হাজিরা মেশিন কর্পোরশেনের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য বসানো হয়েছে। এখন সেটা যদি কারো জন্য প্রয়োগ হয়, আর অন্যরা পার পেয়ে যান। তাহলে অফিসের শৃঙ্খলায় বৈষম্য তৈরি হবে। যার কারণে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ লোপ পাচ্ছে। যা কোনোভাবে কাম্য নয়। মেয়র মহোদয় সর্বদা সবাইকে সমান চোখে দেখেন। আশা করছি, এ ক্ষেত্রেও তিনি সমান চোখে দেখবেন।
এমন বৈষম্যের বিষয়টিকে ‘প্র্যাকটিসের’ প্রাথমিক পর্যায়ের কারণে হচ্ছে দাবি করে চসিকের প্রধান নির্বাহী মো. সামসুদ্দোহা পূর্বদেশকে বলেন, ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে আমাদের আরও অনেক কিছু করার সুযোগ রয়েছে। সম্প্রতি আমাদের আধুনিক নগর ভবন প্রকল্প নিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদয় বলেছেন, আধুনিক নগর ভবন যাতে সর্বোচ্চ ডিজিটাল ম্যানেজমেন্ট নিশ্চিত করা হয়। আমরাও সেদিকে যাচ্ছি। আশা করছি, সময়ের সাথে সবকিছু ডিজিটাল হয়ে যাবে।
তবে বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। তিনি পূর্বদেশকে বলেন, সবার জন্য অফিসের আইন সমান। কেউ মানবেন আর কেউ পার পেয়ে যাবেন, তা হতে পারে না। বিষয়টি আমার নজরে আসেনি। তবে যারা এমনটা করেছেন, তাদের এমন কর্মকান্ড কোনোভাবে সহ্য করা হবে না।