ডিজিটাল সময়ের ঈদ যেন আনন্দের শিক্ষায় ভরে উঠে

20

 

রস ছাড়া রসগোল্লা হয় না,আনন্দ ছাড়া ঈদ উৎসব হয়ে উঠে না। ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার পাশাপাশি তাই ঈদে চলে নানা ভাবে নানা আয়োজনের। যাতে ঈদ আনন্দে ভরে উঠে, উৎসবে পরিণত হয়। তবে ঈদের আনন্দ নিছক আনন্দের বিষয়ে গÐিবদ্ধ থাকে না। সেই সব আয়োজন ও আনন্দের বিষয় আমাদের ও আমাদের প্রজন্মদের মানসিকভাবে, সামাজিকভাবে সুস্থ রাখতে, বিকশিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অর্থাৎ তা-সব আনন্দের আয়োজন শিক্ষণীয় বিষয়ও হয়ে উঠে। শিক্ষার সাধারণ অর্থ, জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জনই হল শিক্ষা। সেই জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন কেন করি? করি এই জন্য যে যাতে দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক গুণাবলী অর্জিত হয়। ভাল মানুষ হয়ে উঠতে পারার জন্য। সমসাময়িক শিক্ষাবিদরা জোর দিয়ে বলে যাচ্ছেন,সন্তানরা তখনই ভাল শিখতে পারে যখনই তারা নিজে নিজে কোন কিছু করার সুযোগ পায়। আরও ভাল হয় সেই শিখনের কালে যদি অভিজ্ঞ কোন গুরুজনের সহায়তা পাওয়া যায়। এই দিক দিয়ে ঈদকে আমরা প্রায়োগিক শিক্ষা কালের ‘পাঠশালা’ও বলতে পারি। যেখানে জীবনমুখী নানা কিছু দেখার ও চর্চা করার সুযোগ থাকে। শিক্ষা অর্জনের সুযোগ থাকে। তাও আবার আনন্দ ও অনুপ্রেরণার ভেতর দিয়ে। আর আনন্দময় পরিবেশ ও প্রেষণা হল কিছু শিখা বা চর্চায় সফল হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যা ঈদ উৎসবে পাওয়া যায়। আধুনিক কালের শিক্ষাবিদরা এই বিষয়কে গুরুত্ব দিচ্ছেন।
আমরা পেশাগত ও জীবিকার ব্যস্ততায় পরিবার ও সমাজের দায়িত্ব পালনে তেমন সময় দিতে পারি না। ঈদ সেই ব্যস্ততার মাঝে তা-সব পালনের সুযোগ তৈরি করে দেয়। শুরুতে সন্তানসন্ততির কথা ভাবা যাক। মানুষের বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ঘটে, মানসিক সক্ষমতা অর্জিত হয় বিচিত্র বিষয় ও সমস্যা মোকাবেলার মাধ্যমে।তার জন্য ঈদ উৎসব হল গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। তা অর্জনের জন্য সন্তানদেরকে ঈদের নানা ধর্মীয় ও সামাজিক বিষয়ে অংশ গ্রহণ করানো যায়, বিচিত্র বিষয়ের মুখোমুখী করানো যায়। তাহলে সন্তানদের বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ঘটবে।মানসিক সক্ষমতার বিকাশ ঘটবে। পরিবার ও সমাজের নানা বিষয়ে তার সাথে মিথষ্ক্রিয়া ঘটার সুযোগ তৈরি হবে। হউক তা পরিবারের জন্য ঈদের কাপড়-চোপড় কেনাকাটা করার বিষয়, হউক তা আত্মীয় স্বজনদের জন্য উপহার কেনার-দেয়ার বিষয়। সন্তানদের সাথে নিন। কাপড়চোপড় কেনার সময় তার মতামত নেয়ার সুযোগ থাকলে মতামত নিন। এতে তার সাথে আপনার সখ্যতা গড়ে উঠবে। তার মনন জগতে পরিবার ও সমাজের বিষয়-আশয় জায়গা করে নিবে। ডিজিটাল সময়ে যা করা খুবই জরুরি। জরুরি এই জন্য যে আমাদের সন্তানদের সময় ও ব্যস্ততা এখন অনলাইনই, ফেইসবুক নিয়ে নিচ্ছে, তাদের মেধা-মনন বিকাশে স্থবিরতা এনে দিচ্ছে, তাতে অতিরিক্ত সময় দেয়ায়। সেখানে পরিবার ও সমাজ তথা ঈদ থাকার সম্ভাবনা কম। থাকলেও লাইক দেয়ায় ও কমেণ্ট করায় তা গ্রাস করে নিতে পারে। লাইক, কমেণ্টে ও ডিজিটাল শুভেচ্ছা বিনিময়ে ঈদের স্বাদ সীমিত হয়ে যেতে পারে। তাই তাদের জগতে এখন আগের মত সরাসরি ঈদের বিষয় সহজে ঢুকতে পারে না। আগে ঈদে তাদের যন্ত্রণায়(?) ও আগ্রহে হয়ত আমরা অভিভাবকরা অস্থির হতাম। এখন অনেক অভিভাবকের অভিযোগ সন্তানরা অনলাইনে ব্যস্ত থাকে। তার কারণে পারবারিক ও সামাজিক বন্ধনে শীতলতা এসে যাচ্ছে। যা মোটেই কাম্য নয়, শুভ নয়। ঈদের তো অন্যতম ইহজাগতিক উদ্দেশ্য হল,মানুষকে সামাজিক করে তোলা, পারস্পরিক দায়িত্বশীল করা। সম্পর্ক তৈরি ও ঘনিষ্ঠ করা। মানুষ মানুষের কাছে যাওয়ার জড়তা ভেঙ্গে দেয়া। আর্থিক ও নানা সহায়তায় পরস্পরের কাছে যাওয়া, নৈকট্য অর্জন করা। এই সব কিছুর সবকিছু তো অনলাইনে সম্ভব না। কিন্তু সন্তানদের কেউ কেউ অনলাইনে আসক্ত হয়ে পড়ায় তাদের কাছে ঈদের এই বিষয়গুলো আর আকর্ষণীয় হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। ফলে ঈদের যে আনন্দের শিক্ষায় প্রাকৃতিক সুঘ্রাণ থাকে তা তাদের অনুভূতির উপর কাজ করতে পারে না। ফলে ঈদে যে মহৎ অর্জনগুলো হওয়ার কথা তা অর্জনে নিষ্ক্রিয়তা দেখা যেতে পারে, বাঁধা বা অন্তরায় তৈরি হতে পারে। এই জন্য আমাদের সন্তানদের ঈদের নানা আয়োজন ও নানা বিষয়ে সক্রিয় করে তোলতে হবে ও অংশগ্রহনের সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। এর জন্য সন্তানদের ঈদের জামা-কাপড় কেনাকাটায়, আত্মীয় স্বজনদের উপহার নেয়ার সময় সন্তানদের সম্ভব হলে সাথে রাখুন। পছন্দ অপছন্দে তার মতামত নেবার চেষ্টা করুন। প্রয়োজন ক্ষেত্রে তার সিদ্ধান্ত জানার চেষ্টা করুন। এতে তার জগতে ঈদ সক্রিয় হয়ে উঠতে পারবে,তার মনন গড়নে ঈদের এই সব বিষয় দারুণ রসদ যোগাবে। শুধু তাই নয়, আর্থিক বাজেট বা খরচের তালিকা তৈরি করায়, উপহার ও আর্থিক সহায়তা গ্রহীতাদের তালিকা তৈরি করাতেও তাকে জড়িত করুন। ঈদকে আনন্দময় করে তোলতে, শিক্ষা ও সওয়াবের জন্য এই সব করার মাধ্যমে আত্মা পবিত্র হয়, আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের সুযোগ তৈরি হয় তা জানার বোঝার সুযোগ করে দিন তাদের। এই জন্য এই সবে তাকে সক্রিয় রাখুন, যা তাকে মানবিক ও দায়িত্বশীল করে তোলবে। তখন ঈদ আর তাদের দৃষ্টিতে ঈদের কেনাকাটায় সীমাবদ্ধ থাকবে না। আমাদের বংশ পরম্পরার ঐতিহ্যে ও স্মৃতিধারায় ঈদের এই সব সাহায্য সহায়তার বিষয়াবলি সুঘ্রাণ ছড়ানোর বিষয় হয়ে উঠবে, তা সম্পদে পরিণত হবে। যা আমাদের প্রজন্মদের শক্তি যোগাবে, মর্যাদাময় করে তোলবে। এই যে আর্থিক সহায়তা দানের তালিকা তাদের দ্বারা তৈরি করানো, কাপড়-চোপড় কেনাকাটায় তাদের মতামত ও সিদ্ধান্ত জানতে চাওয়া এই সব সন্তানদের মানসিক সক্ষমতা ও বুদ্ধিমত্তা তৈরি করায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই মানসিক সক্ষমতা ও বুদ্ধিমত্তা অর্জন হল শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য, যা পরবর্তী সময়ে বিদ্যা অর্জনকালে মূল্যবান পাথেয় হয়ে থাকবে।
প্রত্যেক মানুষই তার সক্ষমতা ও রুচি অনুযায়ী বাড়ি তৈরি করে। তেমনি প্রত্যেক শিশুও তারা যা দেখে যা শুনে অন্য কথায় তাদের নিজ নিজ অভিজ্ঞতা দিয়ে তাদের নিজ নিজ পৃথিবী তৈরি করে নেয়। তাদের তৈরি পৃথিবী তাদের অভিজ্ঞতায় হলেও তার গুণগত মান নির্ভর করে কী ধরণের রসদ ও পরিবেশ আমরা তাদের দিচ্ছি তার উপর। খড়কুটা বা নিম্নমানের নির্মান সামগ্রী যোগান দিলে সে কুঁড়ে ঘর বা ঝুপড়ি ঘর তৈরি করবে। আর মাটি-জল-টিন যোগান দিলে মাটির টিনের ঘর তৈরি হবে। আর যদি পরিকল্পিত পরিশ্রম করে লৌহ-ইট-বালি-সিমেন্ট যোগান দিতে পারি তা হলে পাকা ঘর তৈরি হবে। সন্তানরা কে কি ধরনের পৃথিবী বানাবে তা তাদের অর্জিত অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে। আর সেই অভিজ্ঞতা নির্ভর করে আমরা তাদেরকে কী শুনাচ্ছি, কী দেখাচ্ছি ও আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল তাদের দ্বারা কী করাচ্ছি ও কিসে ব্যস্ত রাখছি তার উপর। খড়কুটা সরবরাহ করে দিয়ে যেমন পাকা ঘর আশা করতে পারি না তেমনি পরিবার ও সমাজের নানা মানবিক ও আনন্দের কাজে সন্তানদের জড়িত করতে না পেরে তার থেকে মানবিক ব্যক্তিত্ব আশা করতে পারি না। এই বিবেচনায় সমাজ ও পরিবার কোন ধরণের প্রতিবেশ ও মানসিক রসদ যোগান দিচ্ছে তার উপর নির্ভর করবে সন্তানের ভবিষ্যৎ।
আমরা অনেক অভিভাবক ঈদের কেনাকাটা ও উপহারকে নিছক কেনাকাটাই ভেবে চলি। এই সবে সন্তানদের সক্রিয় রাখতে পারলে তা যে সন্তানদের ভবিষ্যৎ নির্মার , তার পারিবারিক,সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ গড়নে কত গভীর ভূমিকা রাখতে পারে তা ভেবে দেখি না। আর ভেবে দেখি না জম্মের পর সন্তানের শুধু জৈবিক সত্তাই থাকে। সেই জৈবিক সত্তার মাংসপিÐটি মানবিক সত্তায় পরিণত হতে পারে পরিবারে সমাজে সম্পৃক্ত ও সক্রিয় থাকতে পারার কারণে। আর তার শিল্পী বা কারিগর হলেন অভিজ্ঞ গুরুজন, শিক্ষক। সময় ও প্রযুক্তির কথা বিবেচনা করে আমাদেরকে সন্তানগড়ার কাজে গুরুজন হয়ে দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। তাদের প্রতি বিভিন্ন আয়োজন উৎসবে মনোযোগী ও ধৈর্য্যশীল হতে হবে। যাতে তারা মানবিক হয়ে উঠতে পারার,সামাজিক গুণাবলী অর্জন করে সামাজিক হয়ে উঠতে পারার সুযোগ ও প্রেষণা পায়। প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠতে পারার জন্য। এই সবগুণাবলী এমনে এমনে বা বই থেকে সরাসরি প্রকৃতভাবে অর্জন করা সম্ভব হয় না। সম্ভব হয় পরিবার ও সমাজের নানা বিষয় ও ঘটনার সাথে মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে। তাই সমাজ ও পরিবার বিচ্ছিন্ন মানুষ প্রকৃতপক্ষে ভাল মানুষ হয়ে উঠতে পারে না। বড়কে সম্মান করা, ছোটকে স্নেহ করা, পাড়াপড়শির সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা, পারস্পরিক কল্যাণ কামনা করার তাড়না তৈরি হয়, আর তাড়না থেকে প্রচেষ্টা শুরু হয় ঈদ উৎসবে মত ধর্মীয় ও সামাজিক নানা আয়োজনে ও উৎসবে সক্রিয় থাকার কারণে, অংশ গ্রহণের কারণে। তাই ঈদের নামাজ শেষে সন্তানদের নিয়ে সবার সাথে কোলাকোলি করা, কুশলাদি জানা, ধনী-গরিব সবাইর ঘরে যাওয়া, গরিব হলেও তাদের জন্য কিছু সময় দেয়া, আত্মীয়স্বজনকে সম্মানের সহিত উপহার ও আর্থিক সহায়তা দেয়ার অভ্যাস করানো তা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। এই সব আমাদের সন্তানদের নিয়ে করা সম্ভব হলে, তাদের সক্রিয় রাখতে পারলে ঈদ প্রকৃতপক্ষে আনন্দের শিক্ষায় ভরে উঠবে। এতেই ঈদ আমদের আনন্দের ও জীবন সফলতার বার্তা বয়ে আনবে। তাতেই শিক্ষা ও জীবন গড়ার আনন্দে ঈদ অর্থবহ হয়ে উঠবে। প্রজন্মরাও ফেইসবুক ও অন্যান্য ডিজিটাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আসক্তি থেকে মুক্তি পাবে। এতেই তারুণ্যের অপচয় ঘটবে না,জীবন গড়ার পথে তা ব্যয়িত হবে। এতে কিশোর গ্যাং বা হ্যালমেট বাহিনিতে জড়িয়ে পড়ার আগ্রহ সন্তানরা হারিয়ে ফেলবে। সবার জন্য এই ডিজিটাল সময়েও ঈদ আনন্দের বার্তা বয়ে আনুক। ঈদের আনন্দময় শিক্ষা হতে সন্তানরা সুস্থভাবে বেড়ে উঠার প্রেরণা খোঁজে পাক, সেই প্রত্যাশা সবার। সবাইকে ঈদ মোবারক।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক
অধ্যক্ষ- খলিলুর রহমান মহিলা (ডিগ্রি) কলেজ