ডা. ফজলুল আমীন স্মৃতিতে অম্লান

13

মনোজ কুমার দেব

চট্টগ্রাম শহরের এক প্রান্তে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে সমৃদ্ধ এক জনপদ দক্ষিণ কাট্টলী। প্রতি বছরের ১০ মার্চ-এ জনপদের মানুষের কাছে ভিন্ন আবহের একটি দিন। এলাকার প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা পুষ্পস্তবক হাতে ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে থামে ‘হোসেন চৌধুরী বাড়ির’ মসজিদ সংলগ্ন অনাড়ম্বর এক কবরের সামনে। যেখানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন ডা. ফজলুল আমীন- এক মৃত্যুঞ্জয়ী মহামানব। চিকিৎসাসেবা, শিক্ষা, সমাজসেবা, অগ্রসর রাজনৈতিক চিন্তা, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি অবিচলতা এসবের প্রতিটিতেই তাঁর নামটি স্মরণীয় হয়ে থাকতো নিঃসন্দেহে। কিন্তু সবগুলো ক্ষেত্রে অনন্য অবদান রেখেই স্মৃতিতে অ¤øান হয়ে রইলেন ডা. ফজলুল আমীন।
জীবনের চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে কীভাবে সাধারণ এক শিশু অসাধারণ মানবে পরিণত হলেন। ফিরে দেখা যাক শতবর্ষ আগের কিছু ঘটনাপঞ্জির দিকে। পিতা মনোয়ার আলী চৌধুরী ও মাতা ওমরাও খাতুনের ঘরে ১৯২১ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে ফজলুল-আমীন-এর জন্ম। পেশায় স্টিমার মাস্টার মনোয়ার আলী চৌধুরী কর্মসূত্রে থাকতেন বার্মায়। ব্রিটিশ সওদাগরী জাহাজ ও.ঋ (ইয়াবতী ফ্লোটিলা) কোম্পানীতে তাঁর চাকুরিটি সম্মান ও অর্থের বিচারে ছিলো খুব আকর্ষণীয়। ১৯৩৩ সালে কোম্পানীতে কর্মরত সব কর্মচারী আন্দোলন শুরু করলে একটি উপদলের হটকারিতায় তিনি চাকুরিচ্যুত হন। ফলে ভাগ্যবিড়ম্বিত হয় ফজলুল আমীনের পরিবার। স্থানীয় মহাজনের কূটকৌশলে তাঁর পরিবার আরও বিপর্যয়ের মুূখোমুখি হলো। জায়গা জমি বেহাত হলো। সুখের ভেলায় ভাসার কথা ছিলো যে শিশুর, সেই শিশুটিই পড়লো অকূল পাথারে। কিন্তু প্রতিকূলতা কখনো তাঁকে অবদমিত করতে পারেনি। মেধার স্বাক্ষর রাখেন ছাত্রাবস্থাতেই। গরফফষব ঊহমষরংয ঝপযড়ড়ষ থেকে প্রাথমিকের গÐি পেরিয়ে ভর্তি হলেন মুসলিম হাই স্কুলে। স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পরিদর্শকের প্রশ্নের শাণিত জবাব দিয়ে পেলেন ডাবল প্রমোশনের কৃতিত্ব। ১৯৩৭ সালে কৃতিত্বের সাথে মেট্রিক পাস করে সরকারি চট্টগ্রাম কলেজে মানবিক শাখায় ভর্তি হন তিনি। সে সময়ের একটি বিয়োগান্তক ঘটনা ফজলুল আমীনের জীবনটাকে পাল্টে দেয়। তাঁর জেঠাত ভাই ডা. রুহুল আমীন শৈশবে পিতৃহারা হলে মনোয়ার আলী চৌধুরী পুত্র¯েœহে ভাতুষ্পুত্রকে মানুষ করেন। চিকিৎসক হয়ে রুহুল আমীন কম বয়সেই মারা যান। ফলে মনোয়ার আলী চৌধুরীর পরিবার চিকিৎসকশূন্য হয়ে যায়। এ অভাব পূরণ করতে দৃঢ়চিত্তে এগিয়ে যান ফজলুল আমীন। চট্টগ্রাম মেডিকেল স্কুলের ভর্তির বিজ্ঞপ্তি দেখে গোপনে পরীক্ষা দিয়ে কৃতকার্য হলেন। ভর্তি হলেন চিকিৎসা বিদ্যায়। দুশ্চিন্তা ছিল অর্থের টানাপোড়নের। কিন্তু অনন্য ইচ্ছাশক্তি আর মেধা দিয়ে তিনি এ কোর্স শেষ করলেন। কোর্স চলাকালীন কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে চট্টগ্রাম জেলা বোর্ড ও শেরে বাংলা প্রদত্ত দু’টি বৃত্তি পেলেন। এল.এম.এফ শেষ করলেন ১৯৪২ সালে। দু’বছর পর সরকারি চাকুরী ছেড়ে ১৯৪৪ সালে প্রয়াত ডা. রুহুল আমীনের দেওয়ানহাটস্থ চেম্বারে বসে প্রাত্যহিক রোগী দেখা শুরু করলেন। নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে রোগ নির্ণয়ের জন্য কয়েক বছরের মধ্যেই খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লো কৃতি চিকিৎসক হিসাবে। এরই মধ্যে ১৯৪৫ সালে রাউজান সুলতানপুর নিবাসী চট্টগ্রামের প্রথম মুসলিম চিকিৎসক ডা. এম এ হাসেমের ছোট ভাই ডা. ফরিদের কন্যা হাজেরা খাতুনের সাথে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এ মহীয়সী মহিলা ফজলুল আমীনের পরবর্তী জীবনে অনন্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। এ সময়ে ঋণ শালিশী বোর্ডে মামলা করে নিজের হারানো জমি পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি এলাকাবাসীর জমিও উদ্ধার করে দিয়ে সবার মন জয় করে নিলেন তিনি। জমিদার প্রাণহরি দাশ প্রতিষ্ঠিত প্রাণহরি একাডেমী ১৯৬০ সালের প্রচÐ ঝড়ে সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হওয়ায় স্কুল ঘরটি পুন:নির্মাণ করলেন ডা. ফজলুল আমীন। এলাকাবাসীর বিশেষ দাবিতে প্রাণহরি একাডেমী পরিণত হলো প্রাণহরি আমীন একাডেমীতে।
অনগ্রসর মেয়েদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ছিল তাঁর। কিন্তু ১৯৭৬ সালের ১০ মার্চ অকাল প্রয়াণ হলে জীবদ্দশায় তাঁর ইচ্ছা পূরণ সম্ভব হয়নি। তাঁর স্বপ্নের কলেজের গোড়াপত্তন হয় ১৯৮৮ সালে। তাঁর ও সহধর্মিণীর নামে কলেজের নাম হয় ডা. ফজলুল-হাজেরা কলেজ যা পরবর্তীতে ডিগ্রিতে উন্নীত হয়।
ডা. ফজলুল আমীন আজ নেই, তাঁর মহান স্বপ্নগুলোর কিন্তু মৃত্যু হয়নি। এ এলাকার মানুষ এখনো তাদের দুঃখ-কষ্ট, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ মৌলিক চাহিদাগুলোর সমাধানে ছুটে যান ডা. ফজলুল আমীনের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে নির্দ্বিধায়। এজন্যই ডা. ফজলুল আমীন মৃত্যুঞ্জয়ী। ১৯৯৬ সালে জাতীয় সমাজ কল্যাণ পরিষদ হতে মরণোত্তর স্বর্ণপদক প্রাপ্তি, ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন হতে স্বাধীনতা স্মারক সম্মাননা প্রাপ্তি ডা. ফজলুল আমীনের অমর কীর্তির কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। তবে সবকিছু ছাপিয়ে আপামর জনসাধারণের ভালোবাসাতেই চিরঞ্জীব হয়ে থাকবেন ডা. ফজলুল আমীন।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক
ইংরেজি বিভাগ