ডায়াবেটিক নিয়ে সতর্কতা চাই

23

 

ডায়াবেটিস বা বহুমূত্রকে মারণঘাতী রোগ বলা চলে না। তবে ডায়াবেটিস সর্বরোগের মাতৃগর্ভ। ডায়াবেটিস একটি বিপাকজনিত রোগ যা মানবদেহে সংক্রমিত হয় না। মানব দেহের শরীরে ইনসুুলিন নামের হরমোনের সম্পূর্ণ বা আংশিক ঘাটতির কারণে বিপাকজনিত গোলযোগ সৃষ্টি হয়ে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। পরবর্তী সময়ে তা প্রস্রাবের সাথে বেরিয়ে আসে। এই সামগ্রিক অবস্থায়ই হলো ডায়াবেটিস। এই রোগের ফলে রক্তে গøুকোজের পরিমাণ দীর্ঘস্থায়ীভাবে বেড়ে যায়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, মানবদেহে অগ্নাশয় নামক একটি গ্রন্থি থেকে ইনসুলিন নামক হরমোন নিঃসৃত হয়। এই ইনসুলিন গøুকোজকে ভেঙ্গে শরীরের বিভিন্ন কাজে লাগাতে সাহায্য করে থাকে।
ডায়াবেটিস রোগের কিছু সাধারণ লক্ষণ চিকিৎসকরা নির্ধারণ করেছেন। তা হলো (১) ঘনঘন প্রস্রাব হওয়া (২) খুব বেশি পিপাসালাগা (৩) বেশি ক্ষুধা পাওয়া (৪) যথেষ্ট পরিমাণে আহার (খাওয়ার) পর ও ওজন কমে যাওয়া (৫) ক্লান্তি ও দুর্বলতা বোধকরা (৬) ক্ষত শুকাতে বিলম্ব হওয়া (৭) খোশ-পাঁজড়া, ফোড়া প্রভৃতি চর্মরোগ দেখা দেওয়া (৮) চোখে কম দেখা ইত্যাদিসহ অন্যান্য উপসর্গ দেখা দিতে পারে। তাই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ না থাকলে মানব দেহে অনেক ধরনের বিপদ দেখা দিতে পারে। এ রোগ নিয়ন্ত্রণে না থাকলে, যেসব মারাত্মক উপসর্গ বা জটিলতা দেখা দিতে পারে। তা হলো ; পক্ষাঘাত, স্নায়ুতন্ত্রের জটিলতা, হৃদরোগ, পায়ে পচনশীল ক্ষত, চর্মরোগ, মূত্রাশয়ের রোগ, প্রস্রাবে আমিষ নির্গত হওয়া যা কিডনির জটিলতা বা কর্মক্ষমতা লোপ পাওয়া, পাতলা পায়খানা, য²া, মাড়ির প্রদাহ, চুলকানি, ফোড়া, পাঁচড়া ইত্যাদি। এছাড়াও এ রোগের কারণে যৌন ক্ষমতা হ্রাস, মহিলাদের ক্ষেত্রে বেশি ওজনের শিশু জন্ম, মৃত শিশু জন্ম, অকালে প্রসব, জন্মের পরপরই শিশুর মৃত্যু এবং অন্যান্য নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্র নই, তবে ডায়াবেটিস রোগের কারণে এ বিষয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করতে হয়েছে। সুস্থ এবং ডায়াবেটিস রোগীদের তাই শুধু চিকিৎসকের উপর নির্ভর না করে ব্যাপক ভাবে পড়া শোনা করে জানতে হবে। ডায়াবেটিস রোগীদের নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপনের উপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে। বিষয়গুলো জানা না থাকলে নিয়ন্ত্রিত জীবনাচার অসম্ভব। সাম্প্রতিক এক তথ্যে জানা যায় যে, চট্টগ্রামে ৭২ শতাংশ রোগী অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত। প্রতিদিন শতাধিক রোগী শনাক্ত হচ্ছে। যাদের মধ্যে মধ্য বয়স্করাই অধিক। দেশের প্রধান প্রধান শহরগুলোর চিত্র একই ধরনের এবং উদ্বেগজনক। আজ বিশ্বের প্রতিটি পরিবার, রাষ্ট্র চরম হুমকির মুখে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রতি বছর একজন ডায়াবেটিস রোগী চিকিৎসা বাবদ আনুমানিক ৮৬৫ ডলার ব্যয় করে থাকে। যার ৬০ শতাংশই শুধু ঔষধ বাবদ ব্যয় হয়ে থাকে। এছাড়া হাসপাতালে ভর্তিজনিত ব্যয় প্রায় ২৮ ভাগ। বাংলাদেশসহ বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। ২০১৯ এর জরিপে দেখা যায় যে, বিশ্বের শীর্ষ দশ ডায়াবেটিস সংখ্যাধিক্য দেশের তালিকায় বাংলাদেশ অন্যতম। তার স্থান দশম হলে অতি শীঘ্রই তা আরও উপরে উঠে যাওয়ার সম্ভাবনা। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন যে, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে বাংলাদেশের জনগণ আরও ব্যাপক হারে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা। বর্তমানে সবচেয়ে উচ্চহারে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বাড়ছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। তার মধ্যে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ অন্যতম। যার কারণ হিসাবে বলা হচ্ছে, এসকল উন্নয়নশীল দেশসমূহে দ্রæত নগরায়ন ও সুষম খাদ্য গ্রহণের তারতম্যের কারণে মানুষের দৈহিক ওজন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আনুপাতিক ও কাক্সিক্ষত হারের চেয়ে বেশি ওজন বৃদ্ধি ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। অন্যদিকে যান্ত্রিক সহজলভ্যতার কারণে মানুষের মধ্যে কায়িক শ্রম যেমন দিন দিন কমছে তেমনি বেড়ে যাচ্ছে নানাবিধ মানসিক চাপ বহুগুণ। তার সাথে যুক্ত হয়েছে সামাজিক অসংগতি ও অস্থিরতা।
আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের (আইডিএফ) তথ্য মতে বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৮৪ লক্ষ যা মোট জনসংখ্যার ৮ দশমিক ১ শতাংশ। দেশের শূন্য থেকে ১৯ বছরের মধ্যে টাইপ ওয়ান রোগীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজারের অধিক। সর্বশেষ ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী বর্তমান বিশ্বে দশমিক .৫৩৭ মিলিয়ন ব্যক্তি ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত। ২০৩০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা বেড়ে .৬৪৩ মিলিয়ন হওয়া অসম্ভব নয়। তারমধ্যে ৯০ মিলিয়ন বাস করে দক্ষিণ এশিয়ায়। প্রতিদশ জনে একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। প্রতি পাঁচ জনের চারজনই বাস করে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশসমূহে। ২০২১ সালে ৬.৭ মিলিয়ন মানুষ এ রোগে মৃত্যুবরণ করে। কোভিড-১৯ এ রোগের সংখ্যাকে আরও প্রলম্বিত করছে সারা বিশ্বে কোভিড-এর কারণে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
সাম্প্রতিক সময়ের সামাজিক অস্থিরতার প্রেক্ষিতে বিশ্বের মানুষকে আরো নিয়ন্ত্রিত জীবনাচরণে অভ্যস্থ হতে হবে। ডায়াবেটিস হ্রাসে নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের কোন বিকল্প নেই। সে কারণে চিকিৎসা পদ্ধতির পাশাপাশি কায়িক শ্রম করার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। আমাদের বাংলাদেশ এবং চট্টগ্রামবাসীকে এই ঘাতক রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কৌশল আয়ত্বে আনা জরুরি। শঙ্কার বিষয় হলো নগরায়ন সহজ জীবনকে প্রকৃতিবিমুখ যেমন করছে, তেমিন হাতের নাগালে সুলভ যানবাহন মানুষকে শ্রমবিমুখ করে তুলছে। আগামী প্রজন্মকে গড়ে তোলার জন্য এখনই সতর্ক ও সচেতন হতে হবে। আসুন ডায়াবেটিস সম্পর্কে আরো জেনে নেই। অসংক্রমণ রোগ থেকে বাঁচাতে আমাদের অবশ্যই সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

লেখক : কবি, নিসর্গী ও ব্যাংক নির্বাহী (অব)