ঠেকানো যাচ্ছে না স্বর্ণ চোরা কারবারিদের

187

বিমানবন্দরে শুল্ক গোয়েন্দাদের নজরদারির পাশাপাশি আদালতে বিচারাধীন স্বর্ণ চোরাচালান মামলা নিষ্পত্তির হার বাড়লেও রোধ করা যাচ্ছে না অবৈধ পথে স্বর্ণ পাচার। বিচারে বহনকারীর বিভিন্ন মেয়াদে জেল-জরিমানা হলেও আন্তর্জাতিক স্বর্ণ চোরাকারবারি চক্র তার পরোয়া করছে না। এমনকি, দেশে অবস্থানরত শীর্ষ চোরাকারবারি গ্রেপ্তার এড়িয়ে চলতে সক্ষম হচ্ছে। চোরাচালান চক্রের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের মামলার তদন্ত ও বিচারের আওতায় আনতে না পারার কারণেই বিমানবন্দর দিয়ে স্বর্ণ পাচার রোধ করা যাচ্ছে না বলে মনে করছেন আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্ট আইন-প্রয়োগকারী সংস্থার দয়িত্বশীল কর্মকর্তারা।
মহানগর দায়রা আদালত সূত্রে প্রাপ্ত নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, বিগত ছয় বছরে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে চোরাই স্বর্ণের বার জব্দের ঘটনা যেমন বেড়েছে, তেমনি সর্বশেষ তিন বছরে আদালতে এ সংক্রান্ত মামলার নিষ্পত্তির হারও তুলনামূলকভাবে বেড়েছে। বিগত ২০১৬ সালের মে মাসে পক্ষকালের ব্যবধানে স্বর্ণ চোরাচালানের পৃথক দুটি মামলার রায়ে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মত দুই আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন মহানগর দায়রা জজ আদালত। মূলতঃ ওই বছর থেকেই স্বর্ণ চোরাচালান মামলার নিষ্পত্তির হার বাড়তে থাকে। যা চলতি বছরও অব্যাহত রয়েছে। ২০১৬ সালে তৎকালীন মহানগর দায়রা জজ ডজনখানেক স্বর্ণ জব্দের মামলা নিষ্পত্তি করেন। প্রতিটি মামলার রায়েই আসামির জেল-জরিমানা হয়। সর্বশেষ চলতি বছরের গত ২৮ অক্টোবর মহানগর দায়রা জজ শেখ আশফাকুর রহমান বিমানবন্দরে ১৫টি স্বর্ণের বারসহ আটকের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় শাহাদাত হোসেন (৩১) নামে এক আসামিকে ১৪ বছরের কারাদন্ড দিয়েছেন আদালত। দন্ডিত শাহাদাত আনোয়ারার বটতলি নূর পাড়া গ্রামের আব্দুস সবুরের ছেলে। পাশাপশি এক লাখ টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। রায় ঘোষণার সময় আসামি কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন। পরে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। ২০১৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি বিমানবন্দরে আটক হয়েছিলেন। এর আগে বিমানবন্দরে ২০ কেজি ওজনের একশ’ ৪৬ টি স্বর্ণের বারসহ শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার মামলায় মীর শাহনেওয়াজ মোরশেদ নামে এক আসামিকে গত ২২ জুলাই যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানার আদেশ দেন পঞ্চম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ জান্নাতুল ফেরদাউস চৌধুরী। জরিমানা অনাদায়ে তাকে আরও ছয় মাস কারাভোগ করতে হবে রায়ে উল্লেখ করা হয়। মামলার দায়েরের ছয় বছর পর এ রায় ঘোষণা করা হয়।
পুলিশ ও শুল্ক গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামের ইতিহাসে বৃহত্তম স্বর্ণের চালান আটক করা হয় ২০১৪ সালের ২৫ মার্চ। ওই চালানে আটক হওয়া সর্বমোট নয়শ’ দুইটি স্বর্ণের বারের ওজন ছিল একশ’ পাঁচ কেজি দুইশ’ গ্রাম। বাজার মূল্য ৪৫ কোটি ২০ লাখ টাকা। এই স্বর্ণ চোরাচালানের সাথে জড়িত সন্দেহে আটক করা হয় বিমানের ১০ যাত্রীকে। একই মাসে পৃথক আরেকটি চালানে আরও ছয় কেজি স্বর্ণ জব্দ করা হয়। এছাড়াও ২০১৪ সালের পুরো বছর জুড়ে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে সবচেয়ে বেশি অবৈধ স্বর্ণ জব্দ করা হয়। যার পরিমাণ দুইশ’ ৫৪ কেজি। গ্রেপ্তার করা হয় ২৫ জনকে। তাদের অধিকাংশই বহনকারী। এসব ঘটনায় মামলা হয় ২৪টি। আর ২০১৩ সালে মামলা দায়ের হয় মাত্র আটটি। ২০১৫ সালে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৩২টি চালানে একশ’ তিন কোটি টাকা মূল্যের প্রায় দুইশ ৩০ কেজি স্বর্ণের বার এবং সাড়ে ছয় কেজি স্বর্ণালংকার আটক করে শুল্ক কর্তৃপক্ষ। এসব ঘটনায় আটক করা হয়েছে ৪০ জনকে। এর বাইরে পরিত্যক্ত অবস্থায় জব্দকৃত একশ’ কোটি টাকা মূল্যের আরও অন্তত দুইশ’ কেজি স্বর্ণের বার জিডি মূলে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা করে। ওই বছর স্বর্ণ জব্দের ঘটনায় মোট ৩২টি মামলা দায়ের করা হয় পতেঙ্গা থানায়। এর মধ্যে অধিকাংশ মামলার তদন্ত শেষে আদালতে চার্জশিট জমা দিয়েছে পুলিশ। কিন্তু, একটি মামলার তদন্তেও চিহ্নিত করা যায়নি আড়ালে থাকা শীর্ষ চোরাকারবারিদের। চলতি বছর বিমানবন্দরের পাশাপাশি সড়কপথেও বড় দুটি অবৈধ স্বর্ণের চালান জব্দ করে নগর ও জেলা পুলিশ। গত ৪ মার্চ দুই ঘণ্টার ব্যবধানে নগরীর সিআরবি থেকে সিএমপির ডিবি পুলিশ আর জেলার জোরারগঞ্জ থানা পুলিশ পৃথক দুটি চালানে সাতশ’ পিস অবৈধ স্বর্ণের বার জব্দ করে। এসব স্বর্ণের বাজারমূল্য ৩১ কোটি টাকা বলে পুলিশ দাবি করে। এ ঘটনায় মোট চারজনকে আটক করা রয়েছে। এর মধ্যে নগরীর সিআরবি এলাকায় একটি প্রাইভেট কারে তল্লাশি চালিয়ে একশ’ পিস স্বর্ণের বারসহ দু’জন আর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মিরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ সোনাপাহাড় এলাকায় একটি পাজেরো গাড়ি থেকে ছয়শ’ পিস স্বর্ণের বারসহ দু’জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ঘটনায় সিএমপির কোতোয়ালি ও জোরারগঞ্জ থানায় পৃথক মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে জোরারগঞ্জ থানায় দায়ের হওয়া মামলায়ও পুলিশ চালানের মূল হোতা চুয়াডাঙ্গার দর্শনা পৌরসভার মোবারকপাড়ার মৃত বাদল খানের ছেলে আলমগীর খান পলাতক দেখিয়েই মোট তিনজনকে আসামি করে গত ৩০ সেপ্টেম্বর আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে। পুলিশ ছয় মাসেও তার টিকিটিও ছুঁতে পারেনি। আর স্বর্ণ জব্দের সময় গ্রেপ্তার হওয়া কালু ও রাকিব কারাগারে আটক রয়েছে। এছাড়া স্বর্ণ চোরাচালানের সাথে সরকারি ও বিভিন্ন বেসরকারি বিমান পরিবহণ সংস্থার কর্মী থেকে শুরু করে কতিপয় আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, রাজনৈতিক প্রভাবশালী ও ব্যবসায়ীদের সম্পৃক্ততার তথ্য বিভিন্ন সময়ে তদন্তে উঠে আসে।
শীর্ষ চোরাকারবারিদের আইনের আওতায় আনতে না পারার কারণেই আকাশ কিংবা স্থলপথে স্বর্ণ চোরাচালান রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করেন মহানগর দায়রা আদালতে নিযুক্ত রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুঁলি মো. ফখরুদ্দিন চৌধুরী। তিনি পূর্বদেশকে বলেন, স্বর্ণ জব্দের প্রায় সবকটি মামলার এজাহার থেকে শুরু করে তদন্ত শেষে দাখিল করা চার্জশিট পর্যন্ত কেবল গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিকেই আসামি কিংবা অভিযুক্ত করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই বিচারের আওতায়ও আসে শুধু চালানের বাহক। বিচার শেষে রায়ে অভিযুক্ত বহনকারীর শাস্তি হলেও শীর্ষ পর্যায়ের চোরাকারবারিরা আড়ালেই থেকে যায়। স্বর্ণ জব্দের মামলা তদন্তে পুলিশ আড়ালে থাকা শীর্ষ চোরকারবারিদের চিহ্নিত করতে পারে না। তাই তারা বিচারের প্রক্রিয়ায় বাইরেই থাকে। চক্রের মূল কারবারিদের শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে চোরাচালান রোধ করা সম্ভব নয়।
চোরাচালান চক্রের শীর্ষ ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) আমেনা বেগম পূর্বদেশকে বলেন, স্বর্ণ জব্দের মামলার ক্ষেত্রে দেখা যায়, এগুলো সংগ্রহ করা হয় মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই ও ওমানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে। সংগ্রহের পর তা পাচার প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ হচ্ছে সেই দেশের বিমানবন্দর। স্বর্ণ, মাদক ও মুদ্রা পাচারের মত অপরাধগুলো আন্তর্জাতিক চক্রের মাধ্য সংঘটিত হয়ে থাকে। চোরাচালানের মূল হোতারা অবস্থান করে সিঙ্গাপুর, ওমান, আরব আমিরাত, সৌদি আরবের মত মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে। সেখানে বসেই চালানের যাত্রা থেকে গন্তব্য পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করে। দেশের বিমানবন্দরে যারা ধরা পড়ে, তারা কেবলই বাহকমাত্র। মূল হোতাকে তারা নিজেরাও চিনে না। ফলে, ভিনদেশে অবস্থানকারী শীর্ষ চোরাকারবারিকে চিহ্নিত করা মুশকিল। কোনও কোনও ক্ষেত্রে নাম জানা গেলেও সঠিক ঠিকানা পাওয়া যায়না। এক্ষেত্রে, ইন্টারপোল বা বিভিন্ন দেশের আন্তঃদেশীয় একটা টাস্কফোর্সের মাধ্যমে চোলাচালান বা পাচার সংক্রান্ত মামলাগুলো তদন্তের পদক্ষেপ নিলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকার উদ্যোগী হলে স্ব-স্ব দেশের পুলিশ যৌথভাবেও এ ধরনের টাস্কফোর্স গঠন করতে পারে।