ঠাণ্ডায় কাঁপছে জনপদ

29

পৌষের আকাশে জমা অসময়ের হালকা বৃষ্টিবাহী মেঘ কাটতেই কনকনে শীতের দাপটে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া মৃদু থেকে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহের বিস্তারের মধ্যেই গতকাল রবিবার চলতি মৌসুমে সর্বনিম্ন চার দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে দেশের সর্বউত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায়। সারাদেশের মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে সর্বনি¤œ তাপমাত্রার পারদ তুলনামূলকভাবে কয়েক ডিগ্রি বেশি থাকলেও সন্ধ্যা নামতেই মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ছে গ্রত্যন্ত গ্রামীণ জনপদ। তার সাথে বইছে মৌসুমের কনকনে হিমেল হাওয়া। তাতেই ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা।
অবশ্য সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে কয়েকদিন লাগলেও আজ সোমবার রাতের পর থেকে তাপমাত্রার পারদ ফের উর্ধ্বমূখী হওয়ার আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। পারদ চড়লেও মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশার কারণে দিনের বেলায় সূর্যের কিরণ ভূ-পৃষ্ঠে প্রত্যাশিত উষ্ণতা দিতে পারছে না। আর ইংরেজি নববর্ষের প্রথম সপ্তাহেই ফের গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি এবং শৈত্যপ্রবাহের বয়ে যাওয়ার আলামতও দেখতে পাচ্ছেন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তাই নববর্ষ উদযাপনের প্রস্তুতিতে শীত মোকাবেলার প্রয়োজনীয় উপকরণও সাথে রাখার পরামর্শ আবহাওয়াবিদদের।
অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ এ কে এম রুহুল কুদ্দুস গতকাল রবিবার পূর্বদেশকে জানান, বর্তমানে রাজশাহী, রংপুর এবং ময়মনসিংহ বিভাগের বেশিরভাগ জেলায় মৃদু থেকে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। যা সন্নিহিত এলাকায় বিস্তার লাভ করছে। এরই ধারাবাহিকতায় রাতের তাপমাত্রা আরও কমতে পারে। তবে সোমবার রাতের পর থেকে তাপমাত্রা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সবমিলিয়ে সারাদেশের আবহাওয়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে তিন-চারদিন লেগে যেতে পারে। আর নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহেই শৈত্যপ্রবাহ ও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হতে পারে।
মধ্য-পৌষের কনকনে শীতে বেশি বিপাকে পড়েছে ছিন্নমূল আর শ্রমজীবী মানুষ। শীত নিবারণের উপযুক্ত আশ্রয়ের জন্য কাতর তাদের অনেকে। উষ্ণতার জন্য খড়কুটো জ্বালিয়ে তাপ পোহাতে দেখা যাচ্ছে বিভিন্নস্থানে। ঘন কুয়াশার কারণে কোথাও কোথাও দিনের বেলায়ও যানবাহন চলছে হেডলাইট জ্বালিয়ে। ব্যাহত হচ্ছে নৌ ও বিমান চলাচলও। শীতের কারণে দৈনিক মজুরিভিত্তিক কাজের চাহিদা কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন শ্রমজীবীরা। আবার তীব্র শীতে অনেকে কাজও করতে পারছেন না। তাতে ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। শীতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঠাÐাজনিত রোগের প্রকোপ। বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বৃদ্ধরা। বিভিন্ন হাসপাতালে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীর চাপ বাড়ছে। অন্যদিকে, শীত নিবারণে লেপ-তোষক ও সোয়েটার-জ্যাকেট থেকে শুরু করে গরম কাপড়ের বাজারে ক্রেতার ভিড়ও বাড়ছে। মার্কেট থেকে ফুটপাত সর্বত্র জমজমাট গরম কাপড়ের বাজার।
অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে গতকাল রবিবার সন্ধ্যা ছয়টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার জন্য প্রচারিত আবহাওয়ার দৃশ্যপটে বলা হয়, উপ-মহাদেশীয় উচ্চচাপ বলয়ের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ এবং তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। মৌসুমের স্বাভাবিক লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে। আর পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারাদেশের আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে। দেশের কোথাও কোথাও মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে। টাঙ্গাইল, মৌলভীবাজার ও কুষ্টিয়া অঞ্চলসহ রাজশাহী, রংপুর ও ময়মনািসংহ বিভাগের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরণের শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এই শৈত্যপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও রাতের তাপমাত্রা এক থেকে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস কমতে পারে। গতকাল রবিবার দেশের সর্বোচ্চ ২৬ দশমিক ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা করা হয়েছে সিলেটে। চট্টগ্রাম বিভাগের মধ্যে রবিবার সর্বনি¤œ ১১ দশমিক ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল কুমিল্লায়। বিভাগের বাকি এলাকাগুলোতে সর্বনি¤œ তাপমাত্রা তার ওপর থেকে ১৫ দশমিক দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যেই উঠানামা করেছে।
অধিদপ্তরের রেকর্ডকৃত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, উত্তুরে হাওয়ায় ডিসেম্বরের শুরু থেকেই তাপমাত্রার পারদের পতন শুরু হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৭ ডিসেম্বর চলতি মৌসুমে প্রথমবারের মত সর্বনি¤œ তাপমাত্রার পারদ এক অঙ্কের ঘরে নেমে আসে। ওইদিন দেশের সর্বউত্তরের জনপদ তেঁতুলিয়ায় সর্বনি¤œ ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করে আবহাওয়া অধিদপ্তর। পরদিন আরও এক ডিগ্রি কমে তা আটের ঘরে নামে। কিন্তু এরপর থেকেই পারদের উর্ধ্বমুখী পথচলা শুরু হয়। টানা চারদিনে তিন ডিগ্রিরও বেশি চড়ার পর ফের পতন ঘটে পারদের। পারদের এই পতনমুখী প্রবণতার মধ্যেই আবহাওয়াবিদরা সারাদেশে শীত জেঁকে বসার আলামত দেখতে পান। এর জেরে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় বইতে শুরু করে মৌসুমের প্রথম মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। সর্বনিম্ম তাপমাত্রা নেমে আসে চুয়াডাঙ্গায় সাত দশমিক নয় ডিগ্রিতে।
এর আগে আবহাওয়ার দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাসে জানানো হয়, চলতি ডিসেম্বরের শেষদিকে এবং নতুন বছরের অর্থাৎ ২০২০ সালের জানুয়ারি (পৌষ-মাঘ) মাসে দেশের ওপর দিয়ে দুই থেকে তিনটি মৃদু থেকে মাঝারি এবং দু’টি তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। এমনিতেই জানুয়ারি দেশের শীতলতম মাস। তাই মেয়াদকালের দৈর্ঘ্য কমবেশি হলেও শীতের দাপট কিংবা হাঁড়কাপানো শীতের কামড় অনুভূত হবে জানুয়ারি মাসেই। ফেব্রæয়ারির মাঝামাঝি গিয়ে শেষ হয় বাংলা বর্ষপঞ্জির মাঘ মাস। কাগজে-কলমে বিদায় নেয় শীতকাল। তবে, এবার তুলনামূলকভাবে মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহের স্থায়িত্বকালই বেশি হতে পারে। যাতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পারদ তিন ডিগ্রি সেলসিয়াসের কিছু কম-বেশি হতে পারে বলে আবহাওয়াবিদরা ধারণা করছেন।
প্রসঙ্গত, বিগত ২০১৮ সালের ৮ জানুয়ারি পূর্ববর্তী ৫০ বছরের ইতিহাসের পাতা পাল্টে দিয়ে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় দেশের সর্বনিম্ন দুই দশমিক ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এর আগে সিলেট বিভাগের শ্রীমঙ্গলে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কম দুই দশমিক আট ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ১৯৬৮ সালের ৪ ফেব্রæয়ারি। চলতি বছরের জানুয়ারিতেও সর্বনি¤œ তাপমাত্রা চার ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমেছিল। সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ছয় থেকে আট ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে হলে মাঝারি এবং আট ডিগ্রির চেয়ে বেশি থেকে ১০ ডিগ্রির মধ্যে হলে তাকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বলে থাকে আবহাওয়া অধিদপ্তর। আর সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে আসলে তাকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়।