টেকনাফ -উখিয়া শিবিরে সক্রিয় এক ডজন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপ

52

ইয়াবা, মাদক, মানবপাচার, হাটবাজারেও নিজেদের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে উখিয়া-টেকনাফ রোহিঙ্গা শিবিরের অভ্যন্তরে অন্তত ১২টি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এসব সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে হামলা, সংঘর্ষের ঘটনা বাড়ছে। সাথে চলছে অস্ত্রের মহড়াও। গত ৭ মাসে খুন হয়েছে ৩৩ রোহিঙ্গা। অপহরণ, ধর্ষণসহ নানা অপরাধও বাড়ছে। যা নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে হচ্ছে আইনশৃংখলা বাহিনীকে। স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন বিলম্বিত ও ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ করতে পরিকল্পিতভাবে শিবিরগুলোকে অস্থিতিশীল করে তোলা হচ্ছে। বর্তমানে উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ১৮ হাজার ৯১৩ জন।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, যেসব রোহিঙ্গা শিবিরে অপরাধ বেড়েছে, সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল বাড়ানো হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারিও। দায়িত্বশীল সংস্থার তথ্যমতে, উখিয়া-টেকনাফে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে রোহিঙ্গাদের ১২টির অধিক দল রয়েছে, যারা শিবিরের অভ্যন্তরে অপরিকল্পিতভাবে দোকানপাট, ইয়াবাও মাদক বিক্রির আখড়া তৈরি, মানবপাচার, অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়, ডাকাতি ও মাদকের টাকায় আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহসহ নানা অপরাধকর্ম করছে।
নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্রমতে, উখিয়া-টেকনাফ রোহিঙ্গা শিবিরে ৬টি অধিক করে সন্ত্রাসী বাহিনী আছে। এর মধ্যে টেকনাফের আবদুল হাকিম বাহিনী বেশি তৎপর। এই বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিপণ আদায়ের জন্য যখন-তখন লোকজনকে অপহরণ করে। মুক্তিপণ না পেলে হত্যা করে লাশ গুম করে। ইয়াবা, মানবপাচারে যুক্ত থাকার পাশাপাশি এ বাহিনীর সদস্যরা রোহিঙ্গা নারীদের তুলে নিয়ে ধর্ষণের ঘটনাও ঘটায়।
২০১৬ সালের ১৩ মে টেকনাফের মুছনী রোহিঙ্গা শিবিরের পাশে শালবন আনসার ক্যাম্পে হামলা চালায় হাকিম বাহিনী। এ সময় আনসার কমান্ডার আলী হোসেনকে গুলি করে হত্যা করে। নিয়ে যায় ১১টি আগ্নেয়াস্ত্র। হাকিমের বাড়ি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের দক্ষিণ বড়ছড়ায়। ২০১৪ সালে রোহিঙ্গাদের পক্ষে ‘স্বাধিকার’ আন্দোলনের ডাক দিয়ে ‘হারাকান আল ইয়াকিন’ বাহিনী গঠন করে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন তিনি। মাঝেমধ্যে ফেসবুকে ভিডিও বার্তায় রোহিঙ্গাদের সংগঠিত করার ডাক দেন। হাকিমের পাঁচ ভাই জাফর আলম, রফিক, নুরুল আলম, আনোয়ার ও ফরিদের নেতৃত্বে অনেকে রোহিঙ্গা শিবিরের বিভিন্ন আস্তানা থেকে ইয়াবার টাকা, মুক্তিপণের টাকা, মানব পাচারের টাকা সংগ্রহ করে হাকিমের কাছে পৌঁছে দেন।
পুলিশের তথ্য মতে, আবদুল হাকিমকে ধরার চেষ্টা করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ইতিমধ্যে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ এ বাহিনীর দুই সদস্য নিহত হয়েছেন। হাকিমের বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় খুন, অপহরণ ও ধর্ষণের আটটি মামলা রয়েছে। ইয়াবা বিক্রি ও মানবপাচারের টাকায় হাকিম বাহিনী আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করছে।
পুলিশের তথ্যমতে, টেকনাফের বিভিন্ন শিবিরে আরও ছয়টি বাহিনী তৎপর রয়েছে। এগুলো হচ্ছে ছাদেক, হাসান, নুরুল আলম, হামিদ, নুর মোহাম্মদ ও গিয়াস বাহিনী। প্রতিটি দলের সদস্য ১২-২০ জন। ইতিমধ্যে এসব বাহিনীর ছয়জন খুন হয়েছেন। অন্য সদস্যরা আত্মগোপন করায় বাহিনীর তৎপরতা এখন শিবিরে নেই।
অপরদিকে উখিয়া থানার ওসি আবুল খায়েরের ভাষ্য, উখিয়ার বিভিন্ন শিবিরেও রোহিঙ্গাদের বেশ কয়েকটি বাহিনীর তৎপরতা ছিল, তবে এখন নেই। বাহিনীর সদস্যরা ইয়াবা ব্যবসা ও মানবপাচারে জড়িত বলেও পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে।
পুলিশের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের অভ্যন্তরীণ বিরোধ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন ৩৩ জন রোহিঙ্গা। নিহত ব্যক্তিদের অধিকাংশ ইয়াবা ব্যবসায়ী। দুজন মানবপাচারকারী এবং রোহিঙ্গা নেতাও রয়েছে। সম্প্রতি বালুখালী শিবিরের ই-বøক থেকে পুলিশ আয়েশা বেগম (১৯) নামের এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করে। ধর্ষণের পর তাকে গলাটিপে হত্যা করা হয়। এর আগে গত ৩ ফেব্রæয়ারি রাতে মুখোশধারী একদল রোহিঙ্গা উখিয়ার কুতুপালং শিবির থেকে খতিজা বেগম নামের এক কিশোরীকে অপহরণের পর ধর্ষণ করে। এরপর হত্যা করে লাশ জঙ্গলে ফেলে যায়। উখিয়ার বালুখালী শিবিরের বাসিন্দা এক গৃহবধূ বলেন, স¤প্রতি এক রাতে মুখোশধারী তিন যুবক ঘরে ঢুকে তার এক কিশোরী মেয়েকে অপহরণের চেষ্টা চালায়।
মিয়ানমারের মংডু মেরুলোয়া ফকিরা পাড়ার এলাকায় বাসিন্দা ২২/২৩ বছরের এক যুবক (নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক) ২৫ আগস্টের পর পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে কুতুপালং-২ ক্যাম্পে। সে পেশায় ব্যবসায়ি। ফকিরাপাড়া বাজারে ক্রোকারিজের দোকান করত সে। তারা ৫ ভাই এক বোন। মা ও বাবা জীবিত। তারা বাবাও আরএসও (রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গনাইজেশন) নেতা। এ সশস্ত্র গোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগে তার বাবা তিন বছর কারাগারে ছিলেন। আলেকিন সদস্যদের চাপের মুখে সে গত এক বছর আগে যোগ দেয় আলেকিন নামের সশস্ত্র গোষ্ঠীর সাথে। তাদের প্রধান নেতা পাকিস্তানের বংশোদ্ভূত মিয়ানমারের নাগরিক হাফেজ আতা উল্লাহ। তাদের নেতা ছিল মংডু বাহার ছড়ার বাসিন্দা মৌলভী মোক্তার, ওকাট্টা (চেয়ারম্যান) নজীর আহম্মদ, এনায়েত উল্লাহ, মুফিজ, ওকা সালামত, মৌলভী ইয়াছিন, জাবের উল্লাহ, ফকিরারা পাড়ার ইব্রাহিম, আবুল হাসিম, গুরাপুতুসহ আরো অনেকে। তারা সবাই ছিল সমাজ সর্দার ও প্রশিক্ষিত আলেকিন নেতা। এরা এদেশে পালিয়ে এসে কুতুপালং, বালুখালী, উচিপ্রাং, লেদা, নয়াপাড়া, বাহারছড়া শামলাপুর এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে।
আরো জানান, আলেকিন গ্রুপে না গেলে রোহিঙ্গা মুসলমান যুবকদের অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। তাদের সাথে যোগ না দিলে এবং আলেকিন সশস্ত্র গোষ্ঠীর নেতাদের পাহারা না দিলে ধরে নিয়ে যুবকদের চোখ বেঁধে। তারপর নির্যাতন চালানো হয়।
বিশ্লেষকরা বলছে, মিয়ানমারের সশস্ত্র রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গোষ্ঠীর প্রশিক্ষিতদের বেশির ভাগ বাংলাদেশে চলে এসেছে। এখানে এসে তারা বিভিন্ন মৌলবাদি জঙ্গীগোষ্ঠির সাথে যোগাযোগ করছে। এতে করে আগামীতে এসব রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
এদিকে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠী এখানে এসেও এদেশীয় কিছু মৌলবাদি গোষ্ঠির সাথে তৎপরতা শুরু করেছে। অনেকে রোহিঙ্গাদের সহায়তার নামে অন্য কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গারা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা না গেলে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।
মঙ্গলবার (৯ জুলাই) রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেছেন ৩ বাহিনীর প্রধান। পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের সাথে ব্রিফিংকালে বাংলাদেশ পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ (আইজিপি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তায় জনবল বৃদ্ধির কথা ভাবছে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী। সে লক্ষ্যে তিন বাহিনীর প্রধান রোহিঙ্গা শিবিরের বিভিন্ন ক্যাম্প সরেজমিনে পরিদর্শ করেছেন। বর্তমানে যে পরিমাণ জনবল রয়েছে তা অপ্রতুল।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গা শিবির নিয়ে স্থানীয়দের জনজীবনে যাতে নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয় এবং শিবিরগুলোতে যাতে রোহিঙ্গাদের কারণে আইনশৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে না পারে সেটাই তিন বাহিনী প্রধান ঘুরে দেখেছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকায় পৌঁছার পর কিভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ করা যায় এ বিষয়ে পরিকল্পনা নেয়া হবে। পাশাপাশি ক্যাম্পে অপরাধ দমনেও পরিকল্পনা নিবে তিন বাহিনী।