টেকনাফের বন্যহাতি চুনতি অভয়ারণ্যে!

131

সরকার ঘোষিত ২০১০ সালের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী টেকনাফ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের আয়তন ছিল ১১ হাজার ৬১৫ হেক্টর। সাত বছরের মাথায় ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা বসতি গড়ে উঠলে টেকনাফ ও উখিয়ার প্রায় ছয় হাজার একর পাহাড় কেটে ফেলা হয়। যা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের উপর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। আবাসস্থল ও বিচরণক্ষেত্র হারায় বিখ্যাত এশিয়ান হাতি। সেখানকার পরিবেশ, বনভূমি ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ায় পথ পরিবর্তন করে হাতিগুলো দিকবিদিক ছুটছে। সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রামের দক্ষিণ বন বিভাগের আওতাধীন চুনতি অভয়ারণ্য হয়ে বাঁশখালী ও আনোয়ারার লোকালয়ে ঘুরপাক করা হাতিগুলোর প্রকৃত বিচরণক্ষেত্র টেকনাফ-উখিয়া ছিল নিশ্চিত হয়েছে বন বিভাগ।
চুনতি-জলদী অভয়ারণ্যের বাঁশখালী অংশের রেঞ্জার আনিসুজ্জামান শেখ পূর্বদেশকে বলেন, ‘বাঁশখালী-লোহাগাড়ার পাহাড়ি এলাকা নিয়ে গঠিত চুনতি অভয়ারণ্যে বর্তমানে ৩০-৩৫টি হাতি আছে। এরমধ্যে আনুমানিক চার থেকে পাঁচটি হাতি টেকনাফ অভয়ারণ্য থেকে চলে আসছে। সেখানে রোহিঙ্গা বসতি হওয়ায় হাতিগুলো বিচরণক্ষেত্র হারিয়ে চুনতিতে চলে আসে। বাঁশখালীর পুকুরিয়া, কালীপুর, সাধনপুর এবং আনোয়ারা এলাকায় যে হাতিগুলো লোকালয়ে আসছে সেগুলোই মূলত টেকনাফের হাতি। চুনতি অভয়ারণ্যের হাতি ও টেকনাফ অভয়ারণ্যের হাতির আচরণে পার্থক্য আছে। আনোয়ারা ও বাঁশখালীর কিছু অংশের পাহাড় ন্যাড়া হওয়ায় হাতি লোকালয়ে আসছে বেশি।’
উখিয়ার স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, উখিয়ার থাইংখালী তাজনিমারখোলা ১৯নং ক্যাম্প এলাকাটি একসময় বন্যহাতির আবাসস্থল ছিল। এখন সেখানে রোহিঙ্গা ক্যাম্প গড়ে উঠায় বন্যহাতির দল অন্যত্র পাড়ি জমিয়েছে। এর আগে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের আওতায় টেকনাফ-শিলখালী-বাহারছড়া-রঙ্গিখালী-হরিখোলা-মনখালি-ইনানি-পানেরছড়া এলাকায় হাতির বিচরণ ছিল। এখন সেখানেও হাতির দেখা মিলে না। টেকনাফ-উখিয়া এলাকায় একসময় ৩৫-৫০টি হাতির বিচরণ ছিল।
২০১৮ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে চালানো ইউএনইইচসিআর ও আইইউসিএন এর পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্প হওয়ায় কুতুপালং এলাকায় হাতির উপস্থিতি ধীরে ধীরে কমে গেছে। উখিয়ায় ২০১৫ সালের করিডোর ব্যবহারকারী হাতির সংখ্যা ছয়টি থাকলেও ২০১৮ সালে সেখানে কোন হাতি দেখা যায়নি। অথচ ইনানীতে ২০১৫ সালে ১২টি হাতি করিডোর ব্যবহার করলেও ২০১৮ সালে ১৮টি হাতি করিডোর ব্যবহার করে। একইভাবে উখিয়ার হাতিগুলো টেকনাফ সদর, শিলখালী, হোয়াইকংয়ের দিকে ছুটেছে বেশি।
জানা যায়, গত এক বছরে বাঁশখালীর সাধনপুর, পুকুরিয়া এলাকায় প্রতিনিয়ত দলছুট হাতি হানা দিয়েছে। বন ছেড়ে আসা হাতিগুলো মানুষের ঘর ভাঙচুর করেছে। ঘরে প্রবেশ করে গোলায় রাখা ধান খেয়েছে। আক্রমণেও মারা গেছে তিনজন। একইভাবেই তৈলারদ্বীপ সেতু পার হয়ে আনোয়ারার বৈরাগ ইউনিয়নের কোরিয়ান ইপিজেড এলাকায় হাতি বিচরণ করেছে। ইপিজেড এলাকায় বনাঞ্চল থাকায় হাতিগুলো সেখানেই প্রতিনিয়ত বিচরণ করে। পরে বন বিভাগের লোকজন গিয়ে হাতি সরিয়ে দেয়। কিছুদিন যেতে না যেতেই আবারো হাতি লোকালয়ে ফিরে আসে। একইভাবে গত শুক্রবার রাঙ্গুনিয়ার সরফভাটা ইউনিয়নে দুটি হাতি লোকালয়ে ঘুরপাক করে। এতে এলাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট সায়েন্সের সহযোগী অধ্যাপক ও হাতি গবেষক ড. রায়হান সরকার পূর্বদেশকে বলেন, ‘আইনানুযায়ী ফরেস্টের এক কিলোমিটার বসতি থাকবে না। এখন বনের মধ্যে প্রচুর ঘর হচ্ছে। বনের ভেতর ঘর করলে সেটিকে আমরা লোকালয় বলতে পারি না। হাতির হোমল্যান্ড অনেক বড়। বনের ভেতর খাদ্য সংকট হলেই হাতি দিকবিদিক ছুটবে। টেকনাফের রিজার্ভের সাইজ ঠিক নাই। একসময় টেকনাফের করিডোর বার্মার সাথে সংযুক্ত ছিল। হাতির বিচরণক্ষেত্রে খাদ্য সংকট দেখা দিলেই হাতি মায়ানমারে চলে যেতো। যখন গাছপালা উঠতো আবার চলে আসতো। এখন সেখানে হাতির করিডোর ব্লক করে রোহিঙ্গা ক্যাম্প হয়েছে। সীমান্তে কাঁটাতার ও ল্যান্ড মাইন বসানো হয়েছে। যে কারণে হাতি রুট পরিবর্তন করতে চাইলেও পারছে না। এরমধ্যে কিছু হাতি রুট পরিবর্তন করে চুনতি অভয়ারণ্যে ঢুকে পড়েছে। যেগুলো চুনতি অভয়ারণ্য থেকে তৈলারদ্বীপ হয়ে বৈরাগ পর্যন্ত চলে আসছে।’