টুকা কাহিনী’র বুলবুল চৌধুরী

48

ড. আহমেদ মাওলা

দীর্ঘদিন মরণঘাতি ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে অবশেষে বিদায় নিলেন সত্তরের উজ্জ্বলতম কথাশিল্পী বুলবুল চৌধুরী (১৯৪৮-২০২১) । আজন্ম বহেমিয়ান, বৈষয়িক উদাসীন, আড্ডাবাজ, আসক্তি প্রবণ বুলবুল চৌধুরী খুব সাদামাটা জীবন-যাপন করতেন। প্রথম জীবনে সিনেমার পারিচালক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এফডিসিতে ঘুরেছেন। সিনে পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছেন,পরে কবি আবুল হাসান,মাসুদ রানা খ্যাত আব্দুল হাকিম,কবি নির্মলেন্দু গুণ, কায়েস আহমেদ প্রমুখের সাথে বিউটি বোডিংয়ে আড্ডায় মিশে লেখক হতে গিয়ে সরকারি চাকরি ছেড়ে দেন। তিরিশের অধিক চাকরি বদল করেছেন, ব্যবসা করেছেন কিছুদিন, না কিছুতেই তিনি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেন নি। লেখালিখির জমিনই তাঁর অস্থির জীবনে স্থায়ী হলো। কপট ভাষা কিংবা বানিয়ে তোলা গল্প নয়, গ্রামীণ, লোকায়ত অভিজ্ঞতা, সহজাত খোলা চোখে প্রবহমান জীবনকে দেখা চালচিত্র নিয়েই বুলবুল চৌধুরী গল্প লেখেন। তাঁর টুকা কাহিনী (১৯৭৭) প্রকাশের পর সবার দৃষ্টি পড়েছিল এই নতুন লেখকের ওপর। বিশেষত, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে রাজধানী ঢাকার নগর কেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনের গল্প প্রধান হয়ে ওঠার পটভূমিতে বুলবুল চৌধুরীর গ্রামজীবন নির্ভর গল্প পাঠক রুচিতে ভিন্ন এক আবহের সৃষ্টি করে। টুকা কাহিনী বাংলাদেেশর গল্প-সাহিত্যের চমক সৃষ্টিকারী একটি গ্রন্থ। সবগুলো গল্পের পটভূমি গ্রামীণ, লোকজ শব্দ-অনুষঙ্গ নিয়ে তাঁর ভাষাভঙ্গি বিস্ময়কর। তাঁর পর্যবেক্ষণে, গ্রামীণ সমাজের যে সারল্য ধরা পড়ে, তা অকৃত্রিম। তাঁর গল্পে বাংলাদেশের লোকায়ত জীবনের সৌরভ পাওয়া যায়। কবি জসীমউদ্দীন যেমন কবিতায় নতুন করে গ্রাম-জীবন ও লোকসংস্কৃতিকে তুলে ধরেছিলেন, তেমনি বুলবুল চৌধুরী স্বাধীনতা পরবর্তী গল্পে গ্রাম-জীবনকে নতুন করে উপস্থাপন করে ভিন্ন ঘরানার লেখক হয়ে ওঠেন। কথাসাহিত্যিক ইমাদাদুল হক মিলন তিয়াসের লেখন’ প্রকাশনা উৎসবে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেছেন-‘ আমি একসময় লেখালেখি করে বুলবুল চৌধুরী হতে চেয়েছিলাম। গ্রাম্যজীবন বর্ণনার ক্ষেত্রে আমাদের লেখকদের মধ্যে তাঁর ধারেকাছে কেউ নেই। আমি তাঁর কাছে অনেক কিছু শিখেছি।’ একেবারে নতুন আদলে, লোকজ শব্দনির্ভর আধুনিক ভাষায় গাঁথুনিতে তাঁর গল্প-উপন্যাস হয়ে ওঠে অসাধারণ। আবহমান বাংলার নিসর্গ, ব্রাত্য জীবনকে বুলবুল চৌধুরী তাঁর গল্প-উপন্যাসে খুলে-মেলে ধরেন। পাঠকদের কাছে, তাঁর লেখা পাঠ মানে ভিন্ন এক ভূগোলে পরিভ্রমণ। প্রান্তবাসী, মাটিবর্তী নরনারীর প্রেম, কাম, অনুরাগের ছবি তিনি আঁকেন আন্তরিক দরদ দিয়ে। তাঁর সৃষ্ট চরিত্ররা ক্ষেতেখোলায় গতর খাটে, মাছ ধরে, কামলা দেয়। বিচিত্র পেশার এবং নেশায় পতিত, স্খলিত, উন্মূল মানুষ বুলবুল চৌধুরীর লেখায় এসে ভীড় জমিয়েছে। বার বার পেশা বদল করেও তাদের দারিদ্র্য ঘুছেনা, স্থল কূল পায়না, তবু সেসব নরনারীরা জীচবনসংগ্রামে স্পন্দিত, সদা তৎপর। জীবনকে তারা যেন লেভ্য-চুষ্যর মতো করে চেটেপুটে দেখতে চান। বুলবুল চৌধুরীর গল্প-উপন্যাসের পাত্রপাত্রিরা ব্যর্থ হয় কিন্তু পরাজিত হয়না। এই হার না মানা জীবনমুখিতাই বুলবুল চৌধুরীর কথাসাহিত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, এখানেই তাঁর অনন্যতা। কথাশিল্পী বুলবুল চৌধুরীর জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৬ আগস্ট গাজীপুর জেলার দক্ষিণবাগ গ্রামে। কে.এম.জুবলী হাই স্কুল, ঢাকা থেকে ১৯৬৫ সালে মাধ্যমিক, জগন্নাথ কলেজ থেকে ১৯৬৭ সালে উচ্চমাধ্যমিক এবং স্নাতক পাস করেন ঐ একই কলেজ থেকে ১৯৭০ সালে। লেখালেখির শুরু ছাত্রজীবনে। তাঁর অসামান্য গল্প গ্রন্থ টুকা কাহিনী’ (১৯৭৭) দিয়ে পাঠকদের মনে জায়গা দখল করে নিলেও সত্তরের পর দীর্ঘ সময় তাঁকে সাহিত্যের মাঠে দেখা যায়নি। এক সাক্ষাৎকারে (৯জুলাই,২০১৬, মাহফুজ) তিনি বলেছেন- ‘পেশাগত কারণে আমি কোথাও স্থির হতে পারিনি। আমার জীবনে ৩০টিরও বেশি চাকরি বদল করেছি ‘জোনকী’ ‘ঝিনুক’ ‘নিপুণ’ ‘রোমাঞ্চ’ ‘চিত্রকল্প’ এসব বিনোদন পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছি। সিনেমার পরিচালক হওয়ার স্বপ্নে ১৯৭৪ সালে সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি।’ বুলবুল চৌধুরীর মতো কোনো লেখক ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে এত নিরীক্ষা করেছেন বলে আমার জানা নেই। ষাটের দশকে ঢাকার বাংলাবাজারের বিউটি বোর্ডিং কেন্দ্রিক সাহিত্য আড্ডায় তাঁর বন্ধু ছিলেন কায়েস আহমেদ, আবুল হাসান, নির্মলেন্দু গুণ, শেখ আব্দুল হাকিম প্রমুখ। তাঁর বিচিত্র ও বোহেমিয়ান জীবনে কিছু হদিশ পাওয়া যায় তাঁর অতলের কথকথা’ (২০১৪) গ্রন্থের ‘আমার প্রথম বন্ধু’ ‘প্রথম পলায়ন’ ‘সাধু হে আনন্দ পেতে দাও’ ‘ডেকে ফিরি’ ‘আমার সংসার’, ‘এই ঘরে লক্ষী থাকে’ ইত্যাদি লেখায়। দীর্ঘ বিরতির পর নব্বই দশকের শেষ দিকে তিনি আবার লেখালেখিতে সক্রিয় এবং নিয়মিত হয়ে ওঠেন।
শক্তিমান কথাশিল্পী বুলবুল চৌধুরী ব্যক্তিজীবন কিছুটা ‘আউপাতালি’ শব্দের অর্থ এলোমেলো, আউলা ধরণের। শব্দটা প্রচ্ছদ শিল্পী ধ্রুবএষের দেয়া। বাউলস্বভাবী বুলবুল চৌধুরী ব্যক্তি হিসেবে নির্লিপ্ত, প্রচারবিমুখ, নিজেকে লুকিয়ে রাখতে, আড়াল করতে বেশি পছন্দ করেন। এজন্য তাঁকে কখনো মিডিয়াতে দেখা যায়নি। তাঁর প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: টুকা কাহিনী (১৯৭৭) পর মানুষ (১৯৯৭) নির্বাচিত গল্প (১৯৯৭) গল্প সমগ্র (২০১৬) মাছের রাত, চৈতার বউ গো,। বুলবুল চৌধুরীর গল্পের ভুবনে প্রবেশ করলে দেখা যায়, তাঁর বর্ণনাভূমি গ্রাম হলেও গ্রাম শেষ পর্যন্ত কেবল পটভূমি হিসেবে থাকেনা। জল, মাটি, ঘাস, বৃক্ষলতার সঙ্গে নরনারীর প্রেম-বিচ্ছেদ, দুঃখ-দারিদ্র্য, দহন-যন্ত্রণায় একাকার হয়ে যায়। সেখানে তাঁর গ্রামীণ অভিজ্ঞতাই প্রধান হয়ে ওঠে। ফলে তাঁর গল্পের বিষয়বস্তুই কেবল ভিন্ন হযে উঠে না, স্বকীয় ভাষাভঙ্গি ও লোকজ শব্দের যুতসই প্রয়োগে স্বতন্ত্র হয়ে ওঠে। ‘টুকা কাহিনী’র আটটি গল্পে সেই স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় স্পষ্ট হয়।
‘টুকা একফালি কাপড়ের লেংটি পরেই নিড়নি হাতে বসেছিল। ……….তখন দেখল আইনুল আসছে মাছের রাশ মাথায়। কাছাকাছি হয়ে আইনুল বাঁ হাতে টুকার দিকে আধখাওয়া বিড়ি এগিয়ে দিল, টুহা কা, খাও।
আবেইলডায় নিড়ান দেও কেরে?
আবেইল কই, ঘাস অইছে, দেহছ না, বাদাইল্লায় কেমুন জোর ছাইতাছে?
তোমার যেমুন কাম। হ,তয় মার না, হেজা মার না, মাস কয় ধইরাই না জ্বালাইতাছে।
আসলেও, সজারুটা মাস দুই থেকে জ্বালাচ্ছে। মাচানের কুমড়ো কাঁছে, ঢেঁড়শ গাছের ডগা কাঁছে, কলা, বেগুন কাঁছে। ইনুচ মোল্লার বাঁশঝাড়ের কড়ুল সব শুইয়ে দিয়েছে সজারুটা। এ বছর বাঁশ কি আর পাবে ইনুচ?
কোফাই থাহে হেজাডা? টুকা প্রশ্ন শেষে পোড়া বিড়ির শেষ অংশ নিড়ন দেয়া মাটিতে ঢুকিয়ে দিল।
আইনুল রেগে যায়, আমার চেডে জানে। বাঁশ খাইব, তরহারি খাইব, বিনাশ অইলে তোমাগো অইব। আমার ত কান্দা জমিন নাই। হেজা মারনের ঠেহা অইলো তোমাগো।’ (টুকা কাহিনী)
‘নিড়ান দেও কেরে’ ‘বাদাইল্লা’ ‘হেজা’ ‘কড়ুল’ ‘চেডে জানে’ ‘কান্দা জামিন’ ‘ঠেহা’ এসব লোক-উচ্চারিত শব্দের সঙ্গে বর্ণিত পরিবেশ অবিচ্ছেদ্য। আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োগে, বাক্যবন্ধনের মধ্যে বুলবুল চৌধুরীর নিজস্বতা প্রনিধানযোগ্য। এগল্পে টুকার জীবনের যে পরিচয় ফুটে উঠেছে, সেখানে আমরা দেখি, টুকার বাবা ছিলো বাজারের আড়তে পাট ওজনদার। প্রায় মাকে ধরে মারতো বাবা। এরকম এক বিবাদের পর নায়েব সাহেবের বিচারে বাবা-মা’র বিচ্ছেদ হয়ে যায়। সেই থেকে গ্রামের নায়েবের ওপর টুকার খুব রাগ। সে সীম গাছে নিড়ানী দেয়, মাছ ধরে। আইনুল বাজারে মাছ নিয়ে যাওয়ার সময় একটা ক্ইুচ্ছা দিয়ে যায়। মায়মুনার বাটনাবাটা দিয়ে সে কুইচ্ছা দোপেজা করে খায়। সেবার বানবর্ষায় সব ভাসিয়ে নিয়ে গেলে গঞ্জে রিলিফ দিচ্ছিল। রিলিফ নিয়ে ফেরার পথে ভরসন্ধ্যায় কালীতলায় বটগাছের নিচে একমেয়ে মানুষকে জড়সড় হয়ে বসে থাকতে দেখে, তাকেই বউ করে ঘরে তোলে। ডোঙ্গায় নদী পার হতে বড় ভাই একুব জিজ্ঞেস করেছিল সাথে কে? বউ। ছোট উত্তর। ভাইয়ের বউ মায়মুনা ঘরে তুলে নেয়। টুকার বউ টুকি তাকে শীতকালে ওম, গরমকালে পাখার বাতাস দিয়েছে, রেঁধে বেড়ে খাইয়েছে। একদিন রাগের মাথায় টুকীকে পেটালে বউটা চিরতরে পালিয়ে যায়। টুকা তাকে আর খুঁজে পায়না। তাই পরস্ত্রী মায়মুনার সঙ্গে দুএকটা রসের কথা বলতে তার ভাালো লাগে। টুকার একগুঁয়ে স্বভাব। নায়েবের অবিচার বাড়াবাড়ি পর্যায়ে গেলে সে কোঁচের খোঁচার নায়েবের ঘোড়াকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়। বেহুল ডাঙ্গা যাবে টুকা কামলা দিতে কিন্তু যেতে পারে না। মৃত ঘোড়ার বাচ্চাটা ক্ষেত নষ্ট করলে টুকা ধরে নিয়ে নায়েব বাড়িতে যায়। নায়েব তখন চেয়ারে বসে জিজ্ঞাস করে, আমার ঘোড়াটা গাঁইয়া মারছে কে? সন্ধ্যার অন্ধকারে টুকা বলে- ‘আমি অই’ তখনই মেঘ গর্জন করে নায়েব লাথি মারে।
‘টুকা জোর লাথি খেয়ে ছিটকে পড়ল। মাটিতে হাঁটু গেঁড়ে উপুড় হয়ে পড়ে থাকে টুকা। কনুইয়ে শরীরের ভর।…….ঘরের কোণায কুনো ব্যাঙটা আছে। বাইরে ফেলে দিয়েছিল সে । আবার ফিরে এসেছে। টুকা উঠেেত চাইল। পারল না।’ (টুকা কাহিনী)
ব্যাঙের প্রতীকে টুকার জীবন বর্ণনায় বুলবুল চৌধুরীর শিল্পচৈতন্যের পরিচয় পাওয়া যায়। নায়েবের লাথি খেয়ে কনুইয়ে শরীরে ভর দিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা টুকা যেন সেই কুনো ব্যাঙ সদৃশ। এই প্রতীকায়নই গল্পটিকে শিল্পোত্তীর্ণ করেছে।
‘পরমানুষ’ গল্পে ধনীখোলা হাটের নটীবাড়ির নটী কইতরীর প্রতি আরমানেরে দুর্নিবার আকর্ষণ। চেয়ারম্যানের পোলা মিনহাজের সঙ্গে প্রথম নটী বাড়িতে গিয়ে মিষ্টি মুখশ্রী কইতরীকে দেখেই মনে মনে প্রশ্ন জেগেছিল- এমেয়ে বেশ্যা হয় কি কারণে? তারপর তপন বিক্রেতা বাবাকে সিনেমা দেখার কথা বলে ফাঁকি দিয়ে কইতরীর জন্যএকটা হাতঘড়ি কিনে নটীবাড়িতে যায় আরমান। কিন্তু আরমান অন্য কাস্টমারের মতো ‘বসে’ না। পকেট থেকে সযতনে রাখা ঘড়িটা হাতে দিতেই কইতরী বলে ‘না’। আরমান বলে, আমারে তুমি পর ভাবতে পার কিন্তু আমি তোমারে আপন করেই নিছি। চিৎকার করে উঠে কইতরী- ‘আমারে ঘড়ি পিন্দানের কেডা তুমি? ঘড়িটা ছুঁড়ে ফেলে দরজার খিল খুলে বেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে কইতরী এগিয়ে এসে দুহাত জড়িয়ে ধরে বলে- ‘তুমি ক্যান বোজ না আমি পরমানুষ?’ গল্পের শেষটি বড়ই করুন। কইতরী গোসলের সময় সাঁতরে নদী পার হয়ে নটীপাড়া থেকে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে। পাইন্না হারামি তাকে বুকে ছুরি ঢুকিয়ে হত্যা করে। প্রেম, কাম, বেঁচে থাকর মানবিক আর্তিতে ‘পরমানুষ’ গল্পটি হৃদয়ে দাগ কাটে। ‘চৈতার বৌ গো’ গল্পেও দেখা যায়, জিয়া, কাজল নতুন বিয়ে করে ট্রেনে কমলাপুর স্টেশন থেকে ঘোড়াশাল নেমে নদী পেরিয়ে খলাপাড়া গ্রামে যায়। বাড়িতে চাচা সবুর আলী, চাচী তাদেরকে খুব আদর যতœ করে। গ্রামে এক পাখির ‘ফল পাকো’ ডাক শুনে কাজল জিজ্ঞাসা করে কি নাম পাখিটার? জিয়া তখন বলে পাখিটার নাম ‘চৈতার বউ’ পাখি। পাখির এই নাম করণের পেছনে একটা মিথ আছে। অনেক আগে বোবা ছেলের জন্য গরীব ঘরের সুন্দরী মেয়েকে বউ করে আনা হয়েছিল। গ্রামে এলো একতারা হাতে এক গায়েন। ভারী মিষ্টি তার গলা। গান শুনে চৈতার বউ বশ মানে। গায়েনের সঙ্গে চৈতার বউ পালিয়ে যেতে চেয়েছিল। চৈতার মা তা টের পায়। সে তন্ত্রমন্ত্র জানত। বউ পালিয়ে গেলে বংশের কলঙ্ক হবে জেনে বুড়ি মন্ত্র পাঠ করে গায়েন আর ছেলে বউকে পখি বানিয়ে আকাশে উড়িয়ে দেয়। চৈতার বউ পাখির বৃত্তান্ত শুনে কাজল আর জিয়া দুজনের প্রেমের কথা স্মরণ হয়। দুজনের অন্তরে অন্য মানুষ। কামে মত্ত হবার পরও সেই স্মৃতি অন্তরে থেকে যায়। আঞ্চলিক জীবন, গ্রামীণ লোকায়ত সংস্কৃতি বুলবুল চৌধুরীর গল্পে এভাবে নতুন মাত্রা লাভ করে। ‘মাছের রাত’ ‘মাছ’ ‘খরা’ ‘ঘর ছিল’ ‘সংসার’ ‘নিরবধিকাল’ ‘অচেনা নদীর ঢেউ’ ‘দ্বিতীয় বাসর’ প্রভৃতি গল্পে বুলবুল চৌধুরীর বিষয়Ñভাবনা, চরিত্র-চিত্রন, লোকজ শব্দের যুঁতসই প্রয়োগ বেশ প্রশংসনীয়। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের গল্প-সাহিত্য বুলবুল চৌধুরী নতুনভাবে গ্রামীণ সমাজ ও লোকায়ত জীবনকে আন্তরিক দরদ দিয়ে এঁকেছেন। জীবনবোধ ও পর্যবেক্ষণের অন্তর্দৃষ্টির ভিন্নতা নিয়ে বুলবুল চৌধুরীর গল্পের শৈল্পিক রূপটি উজ্জ্বল হয়ে আছে।