টিকেট বিক্রির আয়ে ‘শূন্য থেকে হিমালয়ে’

25

পাখিদের কলকাকলিতে মুখর চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা। নানা জাতের পাখির কিচিরমিচির ধ্বনির মাঝখানে বাঘের চোখ রাঙানি। সাহেবী ভঙ্গিতে বাঘের হাঁটাছোটা। স্বশব্দে সিংহের গর্জনময় দৌঁড়াদৌঁড়ি। এ যেন দর্শনার্থীদের অন্য ধরনের বিনোদনের খোরাক। হরিণের দুরন্তপনায় ছন্দের কারুকাজ। বিমোহিত হচ্ছে শিশু-কিশোর মন। শৈল্পিক শরীরের লম্বাটে জেব্রার চাহনি। ভালুকের আয়েশী হাঁটাহাঁটি। বানরের বানরীয় শয়তানি। জলের কুমিরের ডাঙায় শিকারি চোখ। দীর্ঘকায় উটপাখির লম্বা পায়ে গন্তব্য খোঁজার চেষ্টা। ময়ূরের ক্ষণিকের নাচ দেখার অপেক্ষায় থাকা শতশত দর্শনার্থী। সবই আছে এ চিডিয়াখানায়। সঙ্গে নতুন করে যোগ হয়েছে দৃষ্টিনন্দন মনোমুগ্ধকর রঙিন সিঁড়ি। সাজানোগুছানো পাহাড়ি পরিবেশ। চিডিয়াখানার পরতে পরতে চিত্রকলা ও শৈল্পিক আঁকাআঁকি। রয়েছে রংতুলির মেলা। আনন্দের দ্যুতি ছড়ানো পাহাড়িয়া সিঁড়িতে নানা রঙের বাহার। সবমিলে আমূল পরিবর্তন হয়েছে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার। পেয়েছে নতুন অবয়ব। উন্নয়ন হয়েছে অবকাঠামোর। দৃষ্টিনন্দন ও নান্দনিক রূপে পুরো আঙিনা। সম্পন্ন হয়েছে নানা সৌন্দর্য্যবর্ধন কাজ। বেড়েছে পরিধি। পুরো পরিবেশ যেন সবুজ শ্যামলীমার কোলে প্রাঞ্জলতার শিহরণ। ইট পাথরের যান্ত্রিকতায় যেন একদন্ড স্বস্তি। খানিকটা আনন্দময় অনুভূতি।
চিডিয়াখানার এ পরিবর্তনের ফেরিওয়ালা মোহাম্মদ রুহুল আমীন। বর্তমানে হাটহাজারি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। আছেন চিডিয়াখানা ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব হিসেবেও।
তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন ২০১৪ সালের জুন মাসে তার উপর চিড়িয়াখানার দায়িত্ব সপেছিলেন। ফান্ডে ছিল মাত্র ১ লাখ ৪২ হাজার টাকা। কর্মকর্তা কর্মচারিদের বেতনভাতা বন্ধ ছিল। আয়ের সব টাকা তখন কার পকেটে যেত তা খুঁজে বের করার বিষয়। সেই থেকে মাত্র সাড়ে ৬ বছরের পথচলা। চিড়িয়াখানার আজকের অবস্থা যেন শূন্য থেকে মহীরুহ।
বর্তমানে চিডিয়াখানার নামে এফডিআর আছে ২ কোটি টাকা। ফান্ডে জমা আছে আরো ১ কোটি টাকা। ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত শুধু টিকিট বিক্রির অর্থে মোট ৫ কোটি ৭৪ লাখ ৪৯ হাজার ২৫৭ টাকার উন্নয়ন কাজ করা হয়েছে বলে জানালেন মোহাম্মদ রুহুল আমীন। কর্মকর্তা কর্মচারিদের বেতন ভাতা ও আনুষঙ্গিক খরচের টাকাও টিকেট বিক্রি থেকে এসেছে। যা উল্লেখিত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, চিড়িয়াখানার সৌন্দর্য্যবর্ধনে পাহাড়ের সঙ্গে মিশিয়ে তৈরি করা হয়েছে বড় আকারের তিনটি সিঁড়ি। সিঁড়িগুলোর দৈর্ঘ্য দুই হাজার ৪৯৪ ফুট। একই সঙ্গে বৃদ্ধি করা হয়েছে চিড়িয়াখানার আয়তন। সম্প্রসারণ করা হয় বাঘের খাঁচা। আগে বাঘের খাঁচা ছিল প্রায় ৩ হাজার ২০০ বর্গফুট আয়তনের। এখন করা হয়েছে প্রায় ৭ হাজার ৫০০ বর্গফুট। ২০১৫ সালের পর থেকে মূলত চিড়িয়াখানার আমূল পরিবর্তন শুরু হয়। যোগ করা হয়েছে বাঘ, সিংহ, হরিণ, উটপাখি, গয়াল, ভাল্লুক, ইমু পাখি ও ময়ূরসহ বিভিন্ন প্রাণী।
মোহাম্মদ রুহুল আমীন জানান, বর্তমানে এটি কেবল একটি চিড়িয়াখানা নয়, মাত্র ৫০ টাকার টিকিটে বহুমাত্রিক আনন্দ উপভোগ করা যায়। চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা এখন দেশের অন্যতম সমৃদ্ধ এবং সুন্দর চিড়িয়াখানা। যেখানে বিনোদনের সমস্ত অনুষঙ্গ বিদ্যমান। শিশুদের জন্য তৈরি করা হয়েছে কিডস জোনও।
প্রসঙ্গতঃ ১৯৮৯ সালের ২ ফেব্রূয়ারি চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক মানুষের বিনোদন, শিশুদের শিক্ষা এবং গবেষণার জন্য নগরের খুলশিস্থ ফয়’স লেকের পাশে ৬ একর জমির উপর চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা প্রতিষ্ঠা করেন। দেশে প্রথমবারের মতো নিজস্ব প্রযুক্তিতে উদ্ভাবিত ইনকিউবেটরে অজগরের ২৬টি বাচ্চা ফোটানো হয়েছে এ চিড়িয়াখানায়। করোনাকালে জন্ম নিয়েছে বিভিন্ন শ্রেণির শতাধিক প্রাণী। চিড়িয়াখানায় আছে দেশের একমাত্র দুর্লভ সাদা বাঘ। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ৩৩ লাখ টাকা ব্যয়ে আনা হয়েছিল একটি বাঘ ও একটি বাঘিনী। আছে ন্যাচারাল মিনি এভিয়ারি (পক্ষীশালা)। ৬০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ২৫ ফুট প্রস্থের পক্ষীশালায় আছে ৬ প্রজাতির ৩০০ পাখি। পাখির মধ্যে আছে লাভ বার্ড ২০ জোড়া, লাফিং ডাভ ৫০ জোড়া, ফিজেন্ট ১০ জোড়া, রিংনেড পারোট ১০, কোকাটেইল ৫০ ও ম্যাকাও ১ জোড়া। বর্তমানে চিড়িয়াখানায় ৩৬০ প্রজাতির প্রাণী আছে।