টিকিট বিক্রি করে আয় সাড়ে ৫ কোটি টাকা

47

মনিরুল ইসলাম মুন্না

চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা। নগরীতে শিশু-কিশোরদের সঙ্গে বন্যপ্রাণির পরিচয় করে দেওয়ার একমাত্র মাধ্যম। জনপ্রতি ৭০ টাকা মূল্যের টিকিট কেটে প্রবেশ করতে হয় এখানে। শুধুমাত্র টিকিট বিক্রি করে চিড়িয়াখানাটি গত ১১ মাসে আয় করেছে ৫ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।
গত মঙ্গলবার চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার ভারপ্রাপ্ত কিউরেটর ডা. শাহাদাত হোসেন শুভ পূর্বদেশকে এসব তথ্য জানান।
তিনি বলেন, শুধু টিকিট বিক্রি করে আমরা জানুয়ারি থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত আয় করেছি ৫ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। বর্তমানে আমাদের এফডিআর আছে ২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা এবং কারেন্ট একাউন্টে আছে ২ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এর আগে ২০২১ সালে করোনা মহামারির মধ্যেও আমাদের টিকিট বিক্রি হয়েছিল ৬ লাখ ৬২ হাজার। এতে আয় হয়েছিল ৩ কোটি ৩১ লাখ টাকা।
জানা যায়, এক সময় অব্যবস্থাপনা ও এলোমেলো অবস্থায় থাকলেও বর্তমানে এটি অনেকটা গোছানো এবং পরিপাটি। নতুন নতুন প্রাণি যুক্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সম্প্রতি যুক্ত হল ক্যাঙ্গারু আর লামা। সামনে আরও যুক্ত হতে যাচ্ছে ম্যাকাও, সিংহ, ওয়াইল্ডবিস্টসহ নানা প্রাণি।
আজ থেকে মাত্র সাড়ে তিন বছর আগেও নানান অনিয়ম দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে পড়েছিলেন দর্শনার্থীরা। সেই সঙ্গে দিন দিন কমছিল দর্শনার্থীও। চিড়িয়াখানার এই দুর্দশার নেপথ্যে ছিল চরম অব্যবস্থাপনা। সেই অব্যবস্থাপনা কাটিয়ে চিড়িয়াখানা এখন বন্যপ্রাণির কলকাকলিতে মুখরিত। দর্শনার্থী বাড়ছে দিন দিন। এখন আর দুর্গন্ধযুক্ত বাতাসে হাঁটতে হয় না, প্রকৃতি উজাড় করে রেখেছে নির্মল বাতাস। সেই নির্মল বাতাসে বুকভরা নিঃশ্বাস গ্রহণের সুযোগ অবারিত।
জানা যায়, প্রতিমাসে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার আয় প্রায় ৫০ লাখ টাকা। তার মধ্যে পশুপাখির খাবার, রক্ষণাবেক্ষণ, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন পরিশোধে খরচ হয় ২০ লাখ টাকা। অবশিষ্ট ৩০ লাখ টাকা প্রতিমাসে চিড়িয়াখানার ব্যাংক হিসাবে জমা হয়।
দেশের সব চিড়িয়াখানা ও সাফারি পার্কগুলো সরকারি ভর্তুকিতে চললেও পরিকল্পিত উন্নয়ন, পশুপাখির সংখ্যা বৃদ্ধি ও সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ১৯৮৮ সালে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন তৎকালীন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ও বর্তমান পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তার হাত ধরেই ১৯৮৯ সালের ২৮ ফেব্রæয়ারি নগরীর ফয়’স লেক পাহাড়ের পাদদেশে মাত্র ২ একর জায়গায় অল্পকিছু প্রাণি নিয়ে যাত্রা শুরু করে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা। সেই থেকে সর্বসাধারণে জন্য এটি উন্মুক্ত করা হয়। বর্তমানে চিড়িয়াখানাটির পরিধি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০.২ একরে। যেখানে রয়েছে ৭২ প্রজাতির সাড়ে তিনশ’র বেশি প্রাণি। যার মধ্যে ৩০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৮ প্রজাতির পাখি ও চার প্রজাতির সরীসৃপ।
চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় স্তন্যপায়ী প্রাণির মধ্যে রয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, ভারতীয় সিংহ, এশীয় কালো ভালুক, আফ্রিকান জেব্রা, মায়া হরিণ, চিত্রা হরিণ, সাম্বার হরিণ, প্যারা হরিণ, মুখপোড়া হনুমান, উল্লক, বিভিন্ন প্রজাতির বানর, মেছো বিড়াল, বন বিড়াল, চিতা বিড়াল, গন্ধগোকুল (হিমালয়ান), গয়াল, খরগোশ, সজারু, শিয়াল ইত্যাদি।
চিড়িয়াখানার বিভিন্ন জাতের পাখির মধ্যে তিতির, ময়ূর, রাজধনেশ, কাকধনেশ, শকুন, মদনটাক, সাদা বক, নিশি বক, তিলাঘুঘু, ভুবন চিল, কোকিল, ময়না, খঞ্জনা পাখি ও তার্কি মুরগি উল্লেখযোগ্য।
গত ৬ বছরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিবিড় তত্ত¡াবধানে ক্যাপটিভ ব্রিডিং বা নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে প্রজননের মাধ্যমে ১৪টি বাঘ শাবকের জন্ম হয়েছে চিড়িয়াখানাটিতে। এরমধ্যে ৫টিই শাবকই বিরল প্রজাতির সাদা বাঘ। আর সাদা বাঘ দেখতেই দিনদিন দর্শনার্থীদের ভিড় বাড়ছে।
২০০৩ সালে ঢাকা চিড়িয়াখানা থেকে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় ২টি বাঘ আনা হয়। ২০০৬ সালে বাঘ চন্দ্র মারা যায়। পরে ২০০৯ সালে তার সঙ্গী পূর্ণিমার ক্যান্সার ধরা পড়ে। পরে ২০১২ সালের ৩০ অক্টোবর প‚র্ণিমার মৃত্যু হয়। এরপর থেকে দীর্ঘ ৮ বছর বাঘ শ‚ন্য ছিল চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে রয়েল বেঙ্গল টাইগার প্রজাতির বাঘ রাজ-পরীকে আমদানি করা হয়। বাঘগুলোর বৈজ্ঞানিক নাম ‘প্যানথার টাইগ্রিস টাইগ্রিস’। ২০১৮ সালের ১৯ জুলাই রাজ-পরীর ঘরে জন্ম নেয় বিরল সাদা বাঘ, যার নাম রাখা হয়েছিলো শুভ্রা। শুভ্রাই ছিল বাংলাদেশের প্রথম সাদা বাঘ।
চলতি বছরের ৩০ জুলাই কালো ডোরাকাটা কমলা রঙের বাঘ দম্পতি রাজ-পরীর সংসারে একইসাথে ৪টি সাদা বাঘ শাবকের জন্ম হয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি দেখা দিয়েছে। এদের মধ্যে ৩টি বাঘ, ১টি বাঘিনী শাবক। দেশের চারটি নদী পদ্মা, মেঘনা, সাঙ্গু ও হালদার নামে এদের নামকরণ করা হয়েছে।
তবে কালো ডোরা কাটা কমলা রঙের বাঘের ঘরে সাদা বাঘের জন্ম যেমন আলোড়ন সৃষ্টি করেছে তেমনি এ নিয়ে আলোচনাও হয়েছে সর্বত্র। ঠিক কি কারণে একইসাথে ৪ টি সাদা বাঘ শাবকের জন্ম তা জানার কৌত‚হল অনেকেরই। গবেষণা বলছে, প্রতি ১০ হাজারে একটি বাঘ সাদা হয়ে জন্মগ্রহণ করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সাদার মধ্যে কালো রঙের ডোরাকাটাযুক্ত এ ধরনের বাঘের জন্ম প্রাণিবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে খুবই ব্যতিক্রমী ঘটনা।
চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার ভারপ্রাপ্ত কিউরেটর ডা. মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন শুভ পূর্বদেশকে বলেন, ‘সাদা বাঘগুলোর বাবা-মা রাজ-পরী। এ দম্পতির পূর্ব-পুরুষদের কেউ একজন সাদা বাঘ থাকার কারণে এমনটি হতে পারে। অথবা কন্টিনিউয়াস ইনব্রিডিংয়ের কারণেও এমনটি হতে পারে। জিনগত গবেষণার মাধ্যমেই একই সাথে ৪টি সাদা বাঘের জন্মের সঠিক কারণ জানা সম্ভব হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, বাঘের ক্যাপটিভ ব্রিডিংয়ের সাফল্য ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতে বাঘের সংখ্যা আরো বাড়িয়ে তা দেশের অন্যান্য চিড়িয়াখানায় সরবরাহের পাশাপাশি সুন্দরবনে অবমুক্ত করার পরিকল্পনাও রয়েছে। সেই সাথে চিড়িয়াখানায় পশুপাখীর সংখ্যা ও দর্শনার্থীদের আকর্ষণ আরও বাড়াতে ম্যাকাও, ওয়েল্ডবিস্টসহ বেশ কয়েকটি পশুপাখি সংগ্রহের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।