টাকা মেরে দেয়ার নানা কৌশল

57

তুষার দেব

নগরীতে ছলে-বলে নানা কৌশলে টাকা মেরে দেয়া বা হাতিয়ে নেয়ার মত অপরাধের ঘটনা বাড়ছে। সপ্তাহখানেকের ব্যবধানে এ ধরনের পৃথক তিনটি অপরাধের ঘটনা পুলিশের হাতে উদ্ঘাটিত হয়েছে। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠান কর্মীর ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলনের পর তা আত্মসাতে ছিনতাইয়ের নাটক সাজানো, গভীর রাতে এটিএম বুথে ছিনতাইয়ের চেষ্টা এবং চলতি পথে ছিনতাইয়ের ঘটনা রয়েছে। এসব অপরাধের ঘটনা সংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগী পক্ষসহ সাধারণ নাগরিকদের ভাবিয়ে তুলেছে।
তবে পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, অভিযোগ পাওয়ার পর দ্রুততম সময়ের মধ্যেই টাকা আত্মসাৎ ও ছিনতাই বা ছিনতাইয়ের চেষ্টার ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার ও রহস্য উদঘাটন করা হয়েছে। জব্দ করা হয়েছে হাতিয়ে নেয়া টাকার বড় অংশ। পুলিশের কার্যকর তৎপরতার কারণে জনমনে উৎকণ্ঠা তৈরি হওয়ার কোনও কারণ নেই। অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার কোনও সুযোগ পুলিশ দিচ্ছে না।
দশ লাখ টাকা আত্মসাতে ছিনতাইয়ের নাটক : তৈরি পোশাক শিল্পখাতের একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব থেকে চেকের মাধ্যমে দশ লাখ টাকা উত্তোলনের পর আরেকটি ব্যাংক হিসাবে জমা না দিয়ে আত্মসাতের পরিকল্পনা করেন বিশ্বস্ত কর্মচারী। বন্ধুর সাথে মিলে টাকা আত্মসাতের ঘটনাকে আড়াল করতে পরিকল্পিতভাবে সাজিয়েছিলেন ছিনতাইয়ের নাটক। তবে, শেষ পর্যন্ত তারা সফল হতে পারেন নি। কোতোয়ালি থানা পুলিশের হাতে দু’জন গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের মধ্য দিয়ে ব্যাংক থেকে উত্তোলিত টাকা উদ্ধারসহ ঘটনার জারিজুরি ফাঁস হয়ে গেছে।
গ্রেপ্তার দু’জন হলেন, আব্দুর রহিম রিপন (৩১) এবং মো. সেলিম (৩৫)। এদের মধ্যে রিপন নগরীর জুবিলি রোডে একটি বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয়ে অফিস সহকারী হিসেবে কর্মরত। তার গ্রামের বাড়ি সিলেটে। নগরীর ডবলমুরিং থানার মতিয়ারপুল এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন। আর বন্ধু সেলিমের বাসা নগরীর টাইগারপাস এলাকার রেলওয়ে কলোনিতে। রিপনকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে গত বুধবার দিবাগত রাতে তার দেয়া তথ্যে সেলিমের বাসায় অভিযান চালিয়েই পুলিশ ব্যাংক থেকে উত্তোলিত নগদ ১০ লাখ টাকা এবং রিপনের মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ জব্দ করেছে।
সিএমপির কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন জানান, রিপন পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠান ক্লিফটন গ্রæপের খুবই বিশ্বস্ত কর্মী ছিলেন। বিভিন্ন সময় অফিস থেকে বড় অংকের চেক নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন ব্যাংকে প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব টাকা থেকে উত্তোলন ও জমা দেয়ার দায়িত্ব পালন করেছেন। বরাবরের মত গত ১২ সেপ্টেম্বর দুপুরে প্রতিষ্ঠানের হিসাবরক্ষক মো. সাহেদের দেয়া ব্র্যাক ব্যাংকের একটি চেক নিয়ে তার পরামর্শমত সংশ্লিষ্ট শাখায় কোম্পানির হিসাব থেকে ১০ লাখ টাকা উত্তোলন করেন। উত্তোলিত ওই টাকা নুপুর মার্কেট এলাকার স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংকের শাখায় কোম্পানির আরেকটি হিসাবে জমা দেয়ার কথা থাকলেও রিপন তা না করে নিজের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনের সুইচ অফ করে দিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান। এ ঘটনায় কোম্পানির হিসাবরক্ষক সাহেদ ওইদিনই কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। মামলা তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোমিনুল হাসানকে।
এসআই মোমিনুল হাসান জানান, মামলার হওয়ার পর তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় ওইদিন রাতেই নগরীর মেহেদিবাগে ন্যাশনাল হাসপাতালে রিপনের অবস্থান শনাক্ত করা হয়। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, রিপন প্রায় আধমরার মত অবস্থায় পড়ে আছেন। কর্তব্যরত চিকিৎসক বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তার শরীরে অস্বাভাবিক কিছুই পাওয়া যায়নি বলে পুলিশকে জানায়। তাতে রিপনের ওপর পুলিশের প্রাথমিক সন্দেহ তৈরি হয়। রিপনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলে তিনি ভনিতার আশ্রয় নিয়ে পুলিশকে বিভ্রান্তিতে ফেলার কৌশল অবলম্বন করেন। হাসপাতাল থেকে রাতে তাকে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে রিপন দাবি করেন, ব্র্যাক ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলনের পর তিনি নুপুর মার্কেটে স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংকে জমা দেয়ার জন্য সিএনজিচালিত অটোরিক্শা করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু বিআরটিসি মার্কেট এলাকায় ডিবি পুলিশ পরিচয়ে দু’জন লোক অটোরিক্শায় উঠে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে বলে ভয় দেখিয়ে হাত থেকে টাকাভর্তি ব্যাগটি কেড়ে নেয়। এরপর তাকে ভাটিয়ারি লিংক রোডে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে রিপন পানি পান করতে চাইলে তাকে এক গøাস পানি দেয়া হয়। সেই পানি পান করার পর রিপন অজ্ঞান হয়ে পড়েন। সন্ধ্যায় জ্ঞান ফিরলে তিনি নিজেকে লিংক রোড এলাকায় একটি ঝোপের মধ্যে আবিষ্কার করেন। চেতন অবস্থায় ফিরে তিনি রিপন বুঝতে পারেন, তার কাছ থেকে ১০ লাখ টাকাভর্তি ব্যাগ, নিজের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ ডিবি পুলিশ পরিচয় দেয়া সেই দুই ব্যক্তি নিয়ে গেছে। অসুস্থ অবস্থায় বাসায় ফেরার পর পরিবারের লোকজন তাকে হাসপাতালে ভর্তি করেন।
রিপনের এই বক্তব্যের পর তার ওপর পুলিশের সন্দেহ আরও ঘনীভ‚ত হয় উল্লেখ করে এসআই মোমিনুল জানান, দিনে-দুপুরে বিআরটিসি-স্টেশন রোডের মত ব্যস্ততম এলাকা থেকে ডিবি পরিচয়ে কেউ তাকে বহনকারী সিএনজিচালিত অটোরিক্শায় হঠাৎ করে চেপে বসে ভাটিয়ারি লিংক রোডে নিয়ে যাওয়ার কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। তাকে মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করে একদিনের রিমান্ডে নিয়ে ফের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে তিনি স্বীকার করেন যে, ব্র্যাক ব্যাংক থেকে চেকের বিপরীতে উত্তোলিত ১০ লাখ টাকা তিনি তার বন্ধু সেলিমের বাসায় রেখেছেন। এরপর গত বুধবার রাতে সেলিমের বাসায় অভিযান চালিয়ে ব্যাগভর্তি ১০ লাখ টাকা, রিপনের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ জব্দের পাশাপাশি সেলিমকেও গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর সেলিম নিজেও টাকা আত্মসাতে ছিনতাই নাটক সাজানোর পরিকল্পনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন।
এদিকে, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে রিপন পুলিশকে আরও জানান, কিছুদিন আগে তিনি রাজীব নামে এক বন্ধুর সঙ্গে থাই এলুমিনিয়ামের ব্যবসা শুরু করেন। তাতে প্রায় ১০ লাখ টাকার মত লোকসান হয়। সেই লোকসান পুষিয়ে নিতে কোম্পানির ব্যাংক হিসাব থেকে উত্তোলিত ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের পরিকল্পনা করেছিলেন। আর সেলিমের সাথে মিলে আত্মসাতের ঘটনা আড়াল করতে ডিবি পুলিশের হাতে ছিনতাইয়ের শিকার হওয়া গল্প সাজিয়েছিলেন।
লুণ্ঠিত সাত হাজার টাকাসহ তিনজন গ্রেপ্তারঃ সিএমপির পাঁচলাইশ মডেল থানা পুলিশ ছিনতাইয়ের অভিযোগে লুণ্ঠিত নগদ সাত হাজার টাকাসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন, মো. সাগর (২০), মো. ফয়সাল (২০) এবং মো. শহিদুল হক কিরণ (২৪)।
থানার ওসি জাহিদুল কবির জানান, গত ৮ সেপ্টেম্বর রাত আনুমানিক নয়টার দিকে মো. সাইদুল ইসলাম মানিক (১৯) বিভিন্ন দোকানে ভ্যানে করে আইসক্রিম ডেলিভারি দেয়ার কাজ শেষ করে বাসায় ফিরছিলেন। ফেরার পথে হামজার খাঁ লেন তিন রাস্তার মোড়ের মান্নান সওদাগরের চায়ের দোকানের সামনে পৌঁছলে অজ্ঞাতপরিচয় তিন-চারজন ব্যক্তি ছোরার ভয় দেখিয়ে তার গতিরোধ করে। এরপর মারধর করে সঙ্গে থাকা নগদ আট হাজার টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। ঘটনার শিকার হওয়া মানিক গত বুধবার থানায় এসে মামলা করলে পুলিশ ঘটনাস্থলের আশপাশে থাকা সিসি ক্যামেরায় ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে। ফুটেজে অপরাধীদের পরিচয় ও অবস্থান শনাক্তের পর গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টার দিকে হামজারবাগ হামজা খাঁ লেনের গাউছিয়া আবাসিকের প্রবেশ মুখে রেলক্রসিং এলাকায় অভিযান চালিয়ে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। তাদের কাছ থেকে লুণ্ঠিত আট হাজার টাকার মধ্যে সাত হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়েছে।
এটিএম বুথ থেকে টাকা ছিনতাইয়ের চেষ্টাঃ এর আগে গত মঙ্গলবার ফিরিঙ্গিবাজার মোড়ে ইউসিবিএলের এটিএম বুথ থেকে টাকা ছিনতাইয়ের চেষ্টার অভিযোগে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে কোতোয়ালি থানা পুলিশ। তারা ছিনতাইয়ের চেষ্টাকালে বুথের নিরাপত্তারক্ষীকে মারধর করে।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন, নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ি থানার ওয়াসেকপুর গ্রামের ডা. গিয়াস উদ্দিন সেলিমের ছেলে মো. আনোয়ার হোসেন বাবু (৩২), কর্ণফুলী থানার মহালখান বাজার এলাকার প্রয়াত আফছু মিয়ার ছেলে মো. জহির আলম (৩৪) এবং একই থানার দক্ষিণ বন্দর গ্রামের মো. ইউনুছের ছেলে আদনান (৩৭)। তাঁদের ব্যবহৃত একটি মোটরসাইকেলও পুলিশ জব্দ করেছে।
পুলিশ জানায়, দিবাগত রাত দেড়টায় ওই তিনজন মোটরসাইকেলে করে বুথের সামনে যান। কিন্তু রাত ১২টার পর বুথ থেকে টাকা উত্তোলনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞার কথা জানান নিরাপত্তারক্ষী মো. নাজিম উদ্দিন। এরপরও বুথের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করলে নিরাপত্তারক্ষী বাধা দেন। তারা নিরাপত্তারক্ষীকে মারধর করার খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে তিনজনকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে। পরে মামলা করে তাদেরকে আদালতে পাঠানো হয়।