ঝিকিমিকি তারা আনন্দে ভরা

47

বেশ কিছুদিন বন্ধের পর স্কুল খুলেছে। ক্লাস রুমের বেঞ্চে পাশাপাশি বসেছে ইমন আর অভিজিত। যতোক্ষণ স্কুলে থাকে একজন আরেকজনকে ছাড়া থাকেনা বলে সবাই বলে মানিকজোড়। লম্বা ছুটির পর দেখা দু’জনের। খুশির রেখা বিজলির মতো আলোয় ছড়িয়ে আছে দুই কিশোরের চোখ মুখে। ক্লাস এখনো শুরু হয়নি। বন্ধুকে খুশির খবরটা বলার জন্য টিফিন ছুটি পর্যন্ত অপেক্ষা করার ধৈর্য্য নেই অভিজিতের। টিচার আসছে কি-না একপলক দেখে নিয়েই কথা শুরু করে,
– ছুটি কেমন কাটলো রে?
-খু-উ-ব মজা করে। গ্রামের বাড়িতে। মাঠে গিয়ে বল খেলেছি। ঘুড়ি উড়িয়েছি। ইমনের চোখ যেন সাঁতার কাটছে মাঠের সবুজে আর আকাশের নীলে।
-তুই কেমন কাটিয়েছিস? ইমনের কথায় চোখ দুটোতে খুশির ঝিলিক খেলে যায় অভিজিতের।
-বাবার সঙ্গে দাবা খেলেছি। আর কয়বার যে হারিয়েছি! হিহি। জয়ের আনন্দে ভুলেই যায় সে ক্লাসরুমে বসে আছে। ইমন অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে অভিজিতের দিকে।
– তুই আঙ্কেলের সঙ্গে দাবা খেলিস!
-হ্যাঁ। খেলি তো। বাবা বলে দাবা খেললে ব্রেইন শার্প হয়। বুদ্ধি বাড়ে।
অভিজিতের কথা শুনতে শুনতে মুখ থেকে খুশির রেখাগুলো মিলিয়ে যায় ইমনের। বাতাসে ভেসে ছাই রঙা মেঘ এসে বসে মুখ জুড়ে।
– কি রে! তোর কী হলো হঠাৎ! ইমনের দিকে তাকিয়ে হাসি থেমে যায় অভিজিতের।
-কিছু না তো! আমি তো বাবাকে ভীষণ ভয় পাই। তুই আঙ্কেলের সঙ্গে দাবা খেলিস। শুনে অবাক হলাম। ইমনকে কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায় অভিজিত। টিচারকে ক্লাসে ঢুকতে দেখে।
টিফিন ছুটিতে আজ ইমনকে তেমন হাসিখুশি দেখা যাচ্ছে না।
-হাওয়া থেকে মুঠোভরে কিছু নিয়ে অভিজিত মেখে
দেয় ইমনের মুখে।
-কী করছিস! অভিজিতের দুষ্টুমিতে একচিলতে হাসি ফোটে ইমনের মুখে।
-এই যে! তোর মুখে দিলাম! বাবা বলে, বাতাসে নাকি প্রজাপতিরা হাসি মিশিয়ে রাখে। আমার মন খারাপ হলে,এভাবে বাতাসের কাছে থেকে আমার মুখে হাসি মেখে দেয়।
-আঙ্কেল তো তোর বন্ধুর মতো!
-বাবা তো আমার বন্ধুই। তোর মতো। কিন্তু পড়াশোনায় ফাঁকি দিলে ছাড়ও নেই। অভিজিতের মুখের হাসির দিকে তাকিয়ে ইমন ভাবে,
-আমার বাবাটাও যদি এমন হতো!
ঢংঢং করে দপ্তরি চাচা বেল বাজিয়ে জানান দিলেন সময় শেষ। সবাই ফিরছে যার যার ক্লাসে।
বিজিএস ক্লাসে স্যার পড়াচ্ছেন,আহ্নিক গতি,বার্ষিক গতি। আলোচনা করছেন পৃথিবীতে দিন-রাত কীভাবে হয়। জোয়ার-ভাটা হয় কীভাবে। কিন্তু আজ কেন জানি মন বসে না ক্লাসে। মন চলে যায় গ্রামে। চোখে ভাসে, মাঠে ইমন ঘুড়ি ওড়াচ্ছে বাবার সঙ্গে। দু’জনের দুটো ঘুড়ি। লাল, নীল দুটো ঘুড়ি। ইমনের লাল ঘুড়ি বাতাসে সাঁতার কেটে কেটে উড়ে যাচ্ছে আকাশের দিকে। আবার নীল ঘুড়ি কিছুতেই উড়তে চায় না। কিছুটা গিয়েই নেমে আসে মাটিতে। বিরক্ত বাবা বকা দিচ্ছে ঘুড়িটাকে। তাই দেখে হাসির দোলায় ঢিল পড়ে ইমনের লাটাইয়ে। পাশ থেকে কেউ চিৎকার করে ডেকে বলে, ইমন,তোর ঘুড়ি পড়ে যাচ্ছে! তাড়াতাড়ি নিজের ঘুড়ি সামলায় সে।
– ইমন, বলতো গোলক দিয়ে কীভাবে পরীক্ষা করবে, দিন-রাত কেমন করে হয়? স্যারের কথায় চমকে ফিরে আসে কল্পনার জগত থেকে। চোখ থেকে মুহুর্তে মিলিয়ে যায়, গ্রামের মাঠ, ঘুড়ি স-ব। স্যার বুঝেছেন ক্লাসে মন নেই ইমনের। মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে থাকে সে।
– বুঝতে পেরেছি। ছুটির আমেজ এখনো কাটেনি। তাই ক্লাসে মন বসছেনা। কাল কিন্তু আমি এই অধ্যায়ের ওপর ক্লাস্ট টেস্ট নেবো।
লজ্জা পেয়ে ইমন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। বাইরে ছুটির বেল দিচ্ছেন দপ্তরি চাচা।
– সবাই এই অধ্যায় ভালো করে পড়ে আসবে। ইমন, ঘরে গিয়ে ভালো করে পড়ে নেবে।
স্যার বেরিয়ে যেতেই সবাই হৈচৈ করে বেরিয়ে পড়ে ক্লাস থেকে। ছুটির বেলটা ভীষণ রকম আনন্দের। সবাইকে যেনো ঢং..ঢং করে জানান দেয়,চলো…বাড়ি ফেরার সময় হলো..
-আচ্ছা তোর হয়েছে কী বলতো? হঠাৎ কেমন মন মরা হয়ে গেছিস। ক্লাসেও মন ছিলোনা।
অভিজিতের প্রশ্নে হালকা হেসে বলে,
-কই! কিছু না তো! চল্। ঐ যে স্কুলের গাড়ি হর্ণ বাজিয়ে ডাকছে।

রাত দশটা বেজে গেছে। পড়ার টেবিলে বসে নিজের ওপর মেজাজ খারাপ হচ্ছে ইমনের। ক্লাসে মনযোগ না থাকায় কিছুই ঢুকছেনা মাথায়।
‘কাল কিচ্ছু পারবোনা ক্লাসে।’ নিজেকে নিজেই বলে।
-কী হয়েছে ইমন? কেন ক্লাসে পড়া পারবিনা?
-পড়াটা বারবার পড়ছি। তবু শিখতে পারছিনা। স্যার বলেছেন কাল টেস্ট নেবেন।
-বাবার কাছে বই নিয়ে যা। বুঝে নে।
– বাবাকে ভয় লাগে। অংক না বুঝলে কী বকাটাই না দেয়! আচ্ছা মা, আমার বাবা এমন রাগী কেন? জানো অভিজিতের বাবা ওর বন্ধুর মতো। আজ ক্লাসে পড়া বুঝিনি কেন জানো?
– কেন?
– বাবার সঙ্গে বাড়ির মাঠে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিলাম। হি হি হি..
-কী!! ক্লাসে বসে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিলি!!
– কল্পনায়। একগাল হেসে দিয়ে বলে ইমন।
– কী পড়া দেখিতো? বাবার আওয়াজ শুনে ভয় পেয়ে ইমন মায়ের দিকে তাকায়। ইমন ভয়ে জড়োসড়ো। বাবা ততোক্ষণে বইটি হাতে নিয়ে পড়ছে।
– এ তো একদম সোজা! কেন পারবিনা? আয় তোকে আমি দেখিয়ে দেই। চল্ আমার সঙ্গে। বলটা নিয়ে আয়।
খাবার টেবিলে একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে বলটা ধরে আলোর সামনে।
-বলতো কী দেখছিস?
– বলটার একপাশে আলো। পেছনে অন্ধকার। ইমন উত্তর দেয়।
-এটাই তো দিন-রাত! মাঝখানে যে ছায়াটা আছে ওটা কী বলতো?
ইমন চুপ করে থাকে। বাবা বলে,
এই অংশ ছায়াবৃত্ত। এই অংশ ঘুরে আলোর দিকে আসতে থাকলে পৃথিবীর ওই অংশে সকাল হয়। যেদিক অন্ধকারে যায় সেদিকে সন্ধ্যা নামে। বলটা মোমবাতির আলোয় ঘুরিয়ে দেখায় বাবা।
-এতো একদম সহজ! খুশিতে বাবাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে। ভয় আর জড়তার জন্য পারেনা। কিন্তু চোখে ঠিকই ঝিকমিক করছে আনন্দ।
-কী? কাল স্কুলে টেস্ট দিতে পারবি তো?
-খু-উ-ব ভালো পারবো।
-গুড। এবার নিজে নিজে করতো দেখি। বল আগুনের বেশি কাছে যেনো নিয়ে যাসনে। হাত পুড়ে ফেলবি। বলে বাবা নিজের কামরার দিকে যেতে যেতে বলে,
-আর হ্যাঁ, আগামী শুক্রবার আমরা বাড়ি যাবো। ঘুড়ি ওড়ানোয় তুই আমাকে হারাতে পারিস কি-না দেখবো।
বাবা কামরায় ঢুকে যেতেই ইমন খুশিতে পায়ের আঙ্গুলে এক পাক ঘুরে যায়।
বাবা যেনো দিয়ে গেলো এক ঝুড়ি খুশি! ইমনের কাÐ দেখে হাসছে মা। বলটা মোমবাতির আলোয় ধরে দেখতে পায় পেছনের অন্ধকারে অনেক তারা ঝিকঝিক করছে। কী আশ্চর্য! তারাগুলো হাসছে!