ঝরাপাতার শেকড়

121

-দেহের নিন্মাংশই শুধু ব্যবহার করতে পারবেন, অন্য কোথাও হাত পর্যন্ত ছোঁয়াতে পারবেন না। এই শর্তে রাজি হলে আমি যেতে পারি আপনার সঙ্গে।
– রেস্টুরেন্টটার পরিবেশ বড় অস্বস্থিকর। বেশিক্ষণ এভাবে এখানে বসে থাকাটা উচিত হবে না। চেনা-জানা অনেক লোকের নিত্য অনাগোনা এখানে। কাজেই চলুন আগে হোটেলে গিয়ে উঠি। তারপর না হয় শোনা যাবে আপনার শর্তটর্তের কথা।
– যাবো তো নিশ্চয়ই, তবে আমার এই শর্তে রাজি হলে তারপর। এছাড়া আর কোন শর্ত আপনাকে মানতে হবে না।
– আপনার শর্তে রাজি, এবার চলুন।
– শহরে এত জমজমাট হোটেল থাকতে পুরোনো ধাঁচের এউ ম্যাড়ম্যাড়ে হোটেলটায় কেন?
– এটা একটু পুরোনো হোটেল বলে লোকজন কম আসে এখানে, তাই নির্ঞ্ঝাট। তাছাড়াও আমরা তো এখানে থাকতে আসিনি। কাজ সেরে চলে যাবো।
– তাও অবশ্য ঠিক, এসিটা দেখছি মান্দাতার আমলের, বুঝাই যাচ্ছে চলবে না। ফ্যানের সুইচটাতো অন্তত চালু করেন। এমন শরতেও যে গরম রে বাবা। প্রকৃতির চরিত্রটা আসলে ঠিকই পাল্টে গেছে।
– মানুষের চরিত্র কি ঠিক আছে? প্রকৃতির বা কি দোষ!
– মন্দ বলেননি। তবে সময় আমার একদমই কম, অন্যখানে এপোইনমেন্ট আছে। যা করার তাড়াতাড়ি করুন।
– জানেন; আমার না অনেক দুঃখ, সেই দুঃখ স্মৃতি মাথায় চাড়া দিলেই শুধু মাঝে মাঝে এসব করতে মন চায়, নয় একাজ আমি সবসময় করি না। কিন্তু আপনাকে দেখে আমার কাম-বাসনা উঠে গেছে। টাকা আমি পুরোটাই আপনাকে দিবো, তবে অন্য কিছু না করে যদি কিছু কথাবার্তা বলি তাতে আপত্তি নেই তো?
– যা করি টাকার জন্যই তো, আপত্তি থাকার তো কথা নয়।
– আমার মতো বুড়ো মানুষদের সাথেও ওসবে সুখ পান? আগে বলে রাখি, আমার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে কথা নেই, ইচ্ছে না হলে এড়িয়ে যেতে পারেন। আর একটি কথা- আমি যদি একটা সিগারেট ধরাই আপত্তি করবেন না তো?
– তা টানতে পারেন। আমাকেও একটা দেন। মাঝে মাঝে বেশ লাগে টানতে। আর যে বললেন সব প্রশ্নের উত্তরের ব্যাপারে ওতে কোন সমস্যা দেখছি না। আপনাকে কেন জানি বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে আমার। সুখের কথা জিজ্ঞেস করছিলেন, ওর জন্য তো আর একাজ করি না, টাকার জন্যে করি। টাকা পেলে বুড়ো কেন ভূতের সাথেও আমি ওকাজ করতে পারি, বুঝলেন? কই সিগারেট দিলেন না?
– এই নেন পুরো প্যাকেটটাই দিলাম, যত খুশি টানুন তবে আরেকটা প্রশ্ন, আপনি শুধু একটা বিশেষ অঙ্গের কথা বলে তা ব্যবহারের শর্ত দিলেন, বাকি সব নয় কেন?
– দিলেন তো ঝামেলায় ফেলে? ভুলে যেতে চাওয়া অতীত বেদনার কথা মনে করিয়ে দিয়ে দিনটা একবারে মাটি করে দিলেন।
– ওহ্ নাহ্! না বলতে চান তো বাদ। এ যদি আপনার বাজে স্মৃতি হয়ে থাকে তাহলে বলবেন না। আমি বরং দুঃখিত, স্মরণ করিয়ে দেবার জন্য।
– তা হবে কেন? কথা যখন তুলেছেন অবশ্যই শুনতে হবে। কিন্তু ব্যাপারটা বড় বেশি বেদনার। আপনাকে দেখে তো খুব বেশি ইমোশনাল মানুষ বলেই মনে হয়েছে আমার। পারবেন তো ধরে রাখতে নিজেকে?
– আপনার মুখের এক্সপ্রেশান তো বলছে ভিন্ন কথা, ব্যাপারটা যে বেদনার কি করে বুঝবো? তা ছাড়া আমিও কম কিছু দুঃখী নই। হাবভাবে যদিও উৎফুল্ল, ভেতরটা জ¦লন্ত আগ্নেয়গীরী, মেহিদী পাতার মতো অনেকটা; উপরে সবুজ, ভেতরে রক্তজবা।
– ওই যে বললেন হাবভাব, সেটা আমিও বেশ খানিকটা পাল্টিয়ে নিয়েছি বলেই এক্সপ্রেশান দেখে বুঝা যায় না, পেট চলবে কি করে বলুন?
– তা আমি বুঝতে পারছি, দুঃখী চেহেরার কারো সাথে তো আর কেউ নিজের দুঃখ ভুলতে ও-কর্ম করতে আসবে না। তা পুষে রাখা দুঃখটা এবার শোনা যাক।
– আমি আসলে বাংলাদেশি নই, আরাকানি মানে রোহিঙ্গা।
– কি বলেন! বাংলাদেশি নন, রোহিঙ্গা?
– হ্যাঁ, বলছি কি তবে, শুনুন! আপনি চমকে উঠলেন যে? ভাবছেন রোহিঙ্গা হয়ে বাংলাদশে কি করে আছি? সে এক বিরাট কাহিনী, অন্যদিন শুনবেন।
– না, ঠিক তা না, ভাবছি অন্যকিছু, আচ্ছা তারপর বলুন।
– আমি এসেছি চার বছর আগে। বর্মি সেনাদের অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়েই আসা। আমার সাথে এমন কিছু করেছে ওরা ভেবেছিলাম চিরতরে শেষ করে দিব নিজেকে। কেন জানি আবার মরতে ইচ্ছে করলো না। জলে থেকে কুমিরের সাথেও বা যুদ্ধ কি করে করি? তাই শেষমেশ দালাল ধরে এদেশে পালিয়ে আসা।
– এমন কিছু কি করেছিল ওরা? বলা যাবে কি? এখনও বুঝি ভরসা করতে পারছেন না!
– না, না ঠিক তা নয়, বলতে তো পারি, আগেও বলছি, আপনার ওপর কেন জানি ভরসা করতে ভয় করছে না আমার। তবে শুনুন, গভীর শীতের রাত, মা আর আমি কাঁথা মুড়ি দিয়ে গভীর ঘুমে অচেতন। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। এত রাতে কেউ আসার কথা না। আমার বাবা নেই, ভাইও নেই। ইহ জগতে মা ছাড়া আমার আর কেউ নেই। কাজেই কড়া নড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে গেলে ভয়ে কুকড়ে যেতে থাকি আর একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে থাকি অনেকক্ষণ।
– বাবা নেই মানে- উনি কি মারা গেছেন?
– সে আরেক কাহিনী। পরে একদিন শুনবেন।
– পরে কখন? আর তো দেখা নাও হতে পার কোনদিন। পরে বলবেন বলে এ পর্যন্ত দুটো ব্যাপার এড়িয়ে গেলেন কিন্তু!
– আচ্ছা বাবা বলছি; আগে শুনুন ওই রাতের কাহিনী! অনেকক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করার পরও যখন দরজা খুলছি না ওরা দরজা ভেঙেই ঢুকে পড়ে। আট-দশজন অস্ত্রধারী বর্মি সেনা। ঢুকেই দু’জন এসে হামলে পড়ে আমার উপর। মা বাঁধা দিতে গেলে ওরা চটে যায়। আমি হাউমাউ করে কাঁদতে আরম্ভ করি। ওদের একজন মাকে গুলি করে ওখানেই খুন করে। আমাকে টেনে হিঁছড়ে ওদের গাড়িতে নিয়ে তুলে। আরেকজন আগুন দিয়ে আমার মার লাশটা শুদ্ধ ঘরটা জ্বালিয়ে দেয়।
– ওহ মাই গড! তারপর?
– ওদের গাড়িতে কখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম জানি না। জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে আবিষ্কার করি একটা ক্যাম্পে। পাশেই ওরা গোল করে বসে তাস খেলছে আর একের পর এক সিগারেট টেনে টেনে দমবন্ধ একটা পরিবেশ তৈরি করলো। আমার জ্ঞান ফিরতেই একজন গিয়ে ওদের খবর দিলো, ও বোধহয় পাহারায় নিয়োজিত ছিলো, যেন জ্ঞান ফিরতেই খবর দেয়া যায়। গাছ থেকে পাতা ঝরে মাটিতে পড়তে দেরী হয়, জ্ঞান ফেরার খবর পেয়ে শুয়োরের পালের মতো হুড়মুড় করে আমার কাছে চলে আসতে ওদের দেরী নেই। শুরু হয় ধর্ষণের পালা। একবারে গণধর্ষণ। সে রাতে আমি পুনরায় মুর্ছা যাই। ভোর হতে আর বেশি দেরী নেই। পূর্বাকাশে আলোর রেখা একটু একটু করে ফুটছে। জ্ঞান ফিরতেই দেখি আমি ক্যাম্পে নেই, জঙলামতন এক পাহাড়ী নির্জন স্থানে শোয়া। মারা গেছি মনে করে হয়ত এখানে এনে ফেলে গেছে ওরা। নড়তে গিয়ে দেখি পুরো শরীর চুনচুনে ব্যথা। জামা পুরোটাই রক্তে রঞ্জিত। পরক্ষণেই ব্যথা অনুভব করি বুকে। সে কি যন্ত্রণা। নরক যন্ত্রণার কথা শুনি, আমার মনে হয়েছে নরক যন্ত্রণা এরচেয়ে বেশি হতে পারে না। দশটা পশু পালাক্রমে ধর্ষণ করার পর আমার বাম স্তনটা ওরা কেটে রেখে দিয়েছে।
– কি জঘণ্য, কি পৈশাচিক। এরপরও বাঁচলেন কি করে?
– একে তো ঠান্ডার মরণ কামড়, তার উপর অতিরিক্ত ব্যথা। নিজের অজান্তেই আমি গগনবিদারী চিৎকার করতে আরম্ভ করি। অদূরেই হয়ত কোন বসতবাড়ি ছিলো। এক পর্যায়ে জনা কয়েক নারী পুরুষ ফেরেস্তা হয়ে এগিয়ে আসে। ওরা আমার খুব দ্রুত হসপিটালে নিয়ে যায়। মাস কয়েক চিকিৎসার পর কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলে লজ্জায় অপমানে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হয়। আবার কেন জানি মরতে ইচ্ছে হলো না। পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠার পর ওখানে আর থাকতে ইচ্ছে হলো না।
– আপনার বাবার কথা বলবেন বলেছিলেন।
– সময়টা আজ থেকে ২৫-২৬ বছর আগে, আমার মা তখন যুবতী। পূর্ণিমার চাঁদের মতন উপচে পড়া যৌবন। তাকে দেখে পাশের বাড়ির এক যুবক নাকি খুব বেশি প্রলুদ্ধ হয়ে নানা ছুতোয় মায়ের বাড়িতে যাতায়াত শুরু করে। আাকার ইঙ্গিতে তার যে আমার মাকে পছন্দ তা বুঝবার চেষ্টা করে। মাও এক পর্যায়ে তার প্রেমে মজে যায়। আমার মায়ের বাবা-মাকে যুবকটি কথা দিয়েছিলো আমার মাকে সে বিয়ে করবে। তাই তারাও ওকে একটু আধটু লায় দিয়েছিলো বুঝা যায়। এক পর্যায়ে ওই যুবকটির সাথে মায়ের শারীরিক সম্পর্ক হয়ে যায়। সে সুবাধে মায়ের গর্ভে চলে আসি আমি। এদিকে হঠাৎ বর্মি সেনাদের আক্রমণ শুরু হলে ওই যুবককে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। শুনেছিলাম বর্মি সেনারা তাকে খুন করেছে। আমার মা সমাজের রক্তচক্ষুর জ¦ালা সয়ে আমাকে প্রসব করে, লালন পালন করে বড় করে তুলে। এই কি; আপনি ঘেমে যাচ্ছেন যে? দুঃখ আমার আর অস্থির দেখাচ্ছে আপনাকে, ব্যাপার কি বলুন তো মশাই?
– ওহ্ না; কই অস্থির কই দেখলেন? আমি ঠিক আছি। আচ্ছা আপনাদের গ্রামের নাম কি বুচিডং?
– হ্যাঁ; তবে আপনি জানলেন কি করে বলুন তো? ফকিরী জানেন নাকি?
– ফকিরী-টকিরী কিছু নয়। রাখাইন রাজ্যের কিছু জায়গা আমার চেনা, আন্দাজ করে বললাম, তাতেই মিলে গেল, এই আর কি! কাকতাল! এতক্ষণ কথা বললাম অথচ আপনার নামটা এখনো জানা হলো না।
– আসল নাম জমিলা বেগম। এখানে সবাই লাকী নামে চেনে।
– আপনার মায়ের নামটা কি বলা যায়?
– অবশ্যই, ছলিমা খাতুন। হঠাৎ খাবি খেলেন যে? ও নামের কাউকে চেনেন নাকি?
– সত্য কথাটা বলবো?
– সত্য মিথ্যার কি হলো এখানে?
– হয়েছে অনেক কিছু। যে যুবকের ঔরসের সন্তান জমিলা বেগম ওরফে লাকী, সে যুবকটা আর কেউ নয়, তোমার সামনে বসে থাকা এই হতভাগা রইস উদ্দিন।