জয় বাংলা ধ্বনিতে মুখরিত ভারতের আইনসভা

112

(ইন্দ্রিরা গান্ধী বললেন) আমরা অবশ্যই এ ব্যাপারে তাদেরকে সর্বাত্মক সহায়তা দেব। আমি বিশ্বাস করি যে আগামীতে বাংলাদেশ ও ভারত সরকার, যারা একই নীতি ও ত্যাগে বিশ্বাসী, একে অপরের সার্বভৌমতা, আঞ্চলিক সুরক্ষা, পারস্পরিক সহায়তা ও একে অন্যের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার ভিত্তিতে সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক গড়ে তুলবে। এভাবেই মুক্তি ও গনতন্ত্রের জন্য এক সাথে কাজ করে আমরা সুপ্রতিবেশী হবার ক্ষেত্রে উদাহরণ হয়ে উঠব, এবং এভাবেই শুধু এই অঞ্চলে শান্তি, স্থিতি ও প্রগতি নিশ্চিত করা সম্ভব। বাংলাদেশের প্রতি আমাদের শুভ কামনা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বক্তব্য শেষ না হতেই ভারতের সংসদ সদস্যদের হর্ষধবনি আর ‘জয় বাংলাদেশ’ ধবনিতে ফেটে পড়েন তারা। স্বীকৃতি পেয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জাতির উদ্দেশ্যে এক ভাষণে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মিত্ররাষ্ট্র ভারতের জওয়ানদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘ভারতের সৈন্যবাহিনী জওয়ানরা আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাংলাদেশের মাটি থেকে হানাদার শত্রূদের নির্মূল করার জন্য যুদ্ধ করে চলছে। অন্যদিকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ায় ভারতের সঙ্গে তাৎক্ষণিক কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে পাকিস্তান। পাক-ভারত যুদ্ধের প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন পূর্ব পাকিস্তানে অনুষ্ঠেয় উপ-নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করে। এ নির্বাচন ৭ ডিসেম্বর থেকে অনুষ্ঠিত হবার কথা ছিলো। ভারতের মার্কিন অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ হয়ে যায়। উত্তর ভিয়েতনামে যুদ্ধরত দক্ষিণ চীন সাগরে অবস্থিত মার্কিন ৭ম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের দিকে যাত্রার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু রণাঙ্গণে ততক্ষণে পাকিস্তানিরা পলায়ন শুরু করেছে। মিত্রবাহিনী আকাশ থেকে অবাধ গতিতে বিমান আক্রমণ চালায়। বঙ্গোপসাগরে ভারতের নৌবাহিনী অবরোধ সৃষ্টি করে । ফেনী হানাদার মুক্ত হয়। দশম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ও সাবসেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা কর্নেল জাফর ইমামের নেতৃত্বে ফেনী মুক্ত করেন। মেজর জলিলের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারা তখন সাতক্ষীরা মুক্ত করে খুলনার দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। তিনি লিখেছেন, ‘বেলা ১১টার সময় “অল ইন্ডিয়া রেডিও” মারফত ঘোষণা করা হল যে ভারত বাংলাদেশকে সার্বভৌম রাষ্ট্র বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। দীর্ঘ ন’ মাস যাবত সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালি অধীর আগ্রহে দিনটির জন্য প্রতিক্ষায় ছিল। সংবাদটা শুনে মন থেকে চিন্তা ও উত্তেজনা দূরীভ‚ত হল। হঠাৎ স্বীকৃতির এই ঘোষণা শুনে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির বিধ্বস্ত অন্তর গর্বে ফুলে উঠল। শেরপুরের পানিহাতা,নালিতাবাড়ী,বাওরামারী আগেই মুক্ত হয়েছে। ঝিনাইগাতীর আহম্মদ নগর পাক বাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করেন কোম্পানি কমান্ডার মোঃ রহমতুল্লাহ। তারা পৌঁছার আগেই পাক বাহিনী ঘাঁটি ছেড়ে চলে গেছে। ভোর বেলায় আহম্মদ নগর ক্যাম্প রেড করে শেরপুর সদরে আসার পথে আল বদর কমান্ডার কামরুজ্জামান এর বাড়ী ঘেরাও করা হয় কিন্তু তাঁকে ধরা যায়নি। তারা জানতে পারলেন সে আগের রাতে আহম্মদ নগর ক্যাম্পে পাকবাহিনীদের সাথে জামালপুর চলে গছে। সকাল ৭ ঘটিকায় শেরপুর শহরে পৌঁছান। কিছুক্ষণের মধ্যে হেলিকপ্টার আসল। পদার্পণ করল মিত্রবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেঃ জেঃ অরোরা। রহমতুল্লাহর বাহিনী সহ হাজার হাজার মুক্তিবাহিনী ও মুক্তি পাগল মানুষ তাঁকে অভ্যর্থনা জানাল। মুহুর্তেই আদেশ হলো বিকাল ৫ঘটিকায় জামালপুর আক্রমণ করতে হবে। জামালপুর অভিযানের জন্য রহমতুল্লাহর বাহিনীকে নান্দিনায় ডিফেন্স দেওয়া হল, যাতে হানাদার বাহিনী রেলওয়ে যোগে পালাতে না পারে। পঞ্চগড় ঠাকুরগাঁও মুক্ত করে সেদিন বীরগঞ্জ ও খানসামার পাক অবস্থানের দিকে এগিয়ে চলছিল মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী। এই বাহিনীর একজন ছিলেন গেরিলা কমান্ডার মাহবুব আলম, পরে যিনি লিখেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের এপিকধর্মী সত্যভাষ্য ‘গেরিলা থেকে সম্মুখ যুদ্ধে’। এদিকে লাকসাম, আখাউড়া, চৌদ্দগ্রাম, হিলিতে মুক্তিবাহিনী দৃঢ় অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি বাহিনী যুদ্ধে কুলিয়ে উঠতে না পেরে পিছু হটে বিকল্প অবস্থান নেয়। রাতে আখাউড়া ও সিলেটের শমসেরনগর যৌথবাহিনীর অধিকারে আসে। যৌথবাহিনী পায়ে হেঁটে ঝিনাইদহ পৌঁছে এবং শহরটি মুক্ত করে। মিত্রবাহিনীর বোমাবর্ষণে ঢাকা বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্পূর্ণরুপে ধ্বংস হয়। ভোর থেকেই পাক নবম ডিভিশনের পলায়ন পর্ব শুরু হয়। যশোর-ঢাকা সড়কে ভারতীয় বাহিনী ঘাঁটি করায় বাধ্য হয়ে পাক নবম ডিভিশনের একটি অংশ মাগুরা হয়ে মধুমতি নদী ডিঙ্গিয়ে ঢাকার পথে পালিয়ে যায় । কুষ্টিয়ার দিক দিয়েও পালালো ছোট্ট একটা অংশ। পালাবার পথে সবকটা বাহিনীই রাস্তার ওপরের ব্রিজগুলি ভেঙ্গে দেওয়ার চেষ্টা করে। এইদিন যৌথবাহিনী পায়েহেটে ঝিনাইদহ পৌছে এবং শহরটি মুক্ত করে । এদিন ডঝঅএ-এর বৈঠকে মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (CIA) প্রধান রিচার্ড হেলমসের সমীক্ষায় বলা হয়, দশ দিনের মধ্যে ভারতীয় বাহিনী পূর্বাঞ্চলে এক চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে সক্ষম হবে। মার্কিন স্বশস্ত্রবাহিনীর সেনাধ্যক্ষমন্ডলী (JCS)-এর পক্ষে উপস্থিত জেনারেল ওয়েস্ট মোরল্যান্ড বরং পূর্বাঞ্চল পাকিস্তানের প্রতিরোধের মেয়াদ তিন সপ্তাহ অবধি স্থায়ী হতে পারে বলে অভিমত দেন। এর পরই শুরু হয় সামরিক হস্তক্ষেপের অনুক্ত পরিকল্পনা চ‚ড়ান্তকরণের উদ্দেশ্যে কিসিঞ্জারের সুচিন্তিত প্রশ্নমালা: পূর্ব পাকিস্তানের বিহারীদের হত্যা করা শুরু হয়েছে কি না? এই আসন্ন রক্তপাত বন্ধ করার উপায় কি? যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদ থেকে সাধারণ পরিষদে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা সে দিনের মধ্যে সম্পন্ন হবে কি না? ভারতের নৌ-অবরোধ বেআইনী কি না এবং তার আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদের খসড়া শীঘ্র তৈরী করা যাবে কি না? জর্ডান ও সৌদি আরব থেকে পাকিস্তানে সমরাস্ত পাঠানোর পথে যুক্তরাষ্ট্রের আইনে কোন বাধা আছে কি না? যদি থাকেও প্রেসিডেন্ট নিক্সন যেহেতু পাকিস্তানের পরাজয় রোধ করতে চান, সেহেতু এই বাধাগুলি অপসারণের উপায় কি? ইতাদি। সামরিক হস্তক্ষেপের পক্ষে সম্ভাব্য যুক্তি ও উপায় অন্বেষণই ছিল এই (WSAG) বৈঠকের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য দিক। পাশাপাশি শুরু হয় বাংলাদেশে পাকিস্তানের আসন্ন পরাজয় রোধ করার জন্য সোভিয়েট ইউনিয়নের বিরুদ্ধে তীব্র কূটনৈতিক চাপ। প্রেসিডেন্ট নিক্সন সোভিয়েট নেতা ব্রেজনেভের কাছে প্রেরিত এক জরুরী বার্তায় জানান, সোভিয়েট ইউনিয়ন যদি পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষা করার জন্য ভারতকে সামরিকভাবে নিষ্ক্রিয় না করে তবে পরবর্তী মে মাসে প্রস্তাবিত রুশ-মার্কিন শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয়। ২৫৬ এ ছাড়া সরাসরি ভারতের উপর জাতিসংঘের চাপ প্রয়োগ করার জন্য মার্কিন প্রশাসন Uniting for Peace ধারার অধীনে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রতাহারের প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদ থকে সাধারণ পরিষদে নিয়ে যাবার জন্য তৎপর হন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবিলম্বে পাক-ভারত যুদ্ধ বিরতির প্রচেষ্টা চালানোর জন্য নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব উপস্থাপন করে। নিরাপত্তা পরিষদে পাক-ভারত যুদ্ধ বিরতি সংক্রান্ত মার্কিন প্রস্তাবের ওপর সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বিতীয় দফা ভেটো দেয়। নিরাপত্তা পরিষদের ১১ জন সদস্য মার্কিন প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। পোল্যান্ড সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে ভোট দেয়। বৃটেন ও ফ্রান্স ভোট দানে বিরত থাকে। সোভিয়েত সরকারের একজন মুখপাত্র মস্কোতে বলেন, ভারতীয় উপমহাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন উদাসীন থাকতে পারে না। কারণ, এখানে সোভিয়েত ইউনিয়নে নিরাপত্তার স্বার্থ জড়িত রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ঢাকায় বলেন, ভারতের বিরুদ্ধে বেশ কিছু সময় প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রস্তুত আছে। তিনি বলেন, আমাদের বাহিনী বর্তমান পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তান ধরে রাখতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। লেঃ জেনারেল নিয়াজি রাতে ঝিনাইদহ অবস্থান থেকে সরে এসে তাঁর বাহিনীকে ঢাকা রক্ষার নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী ঢাকার পথে পেছনে এসে মেঘনার তীরে সৈন্য সমাবেশ করার নির্দেশ দেন তিনি। কিন্তু তা আর তাদের পক্ষে করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কারণ ততক্ষণে ঢাকা-যশোর সড়ক মিত্রবাহিনীর নিয়ন্ত্রনে চলে গেছে। মধুমতি অতিক্রম করে মিত্রবাহিনীর একটি দল খুলনার দিকে এবং অপর একটি দল কুষ্টিয়ার দিকে অভিযান অব্যাহত রাখে। বিবিসির সংবাদে বলা হয়, ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ নিয়েছে। ভারতীয় সামরিক মুখপাত্র বলেন, তাদের বাহিনী পনেরটি পয়েন্ট থেকে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। তারা পশ্চিম ফ্রন্টে বিজয় দাবি করেছে। পাকিস্তানও উভয় ফ্রন্টে স্থল ও আকাশপথে সফলতার কথা বলেছে। ভারত বলছে যশোর সেক্টরে প্রচন্ড লড়াই চলছে। তবে কিছু বাহিনী রাজধানী ঢাকা আক্রমণের ব্যাপারে উৎসাহী। একজন সামরিক মুখপাত্র বলেন ঢাকা ও যশোরের মধ্যে সড়ক লিঙ্ক কাটা হয়েছে এবং ক্যারিয়ার বোর্ন প্লেন ঢাকার কেন্দ্রে আঘাত করেছে। তিনি দাবী করেছেন, ঢাকার উভয় বিমানঘাঁটি অচল করে দেয়া হয়েছে। এবং চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংলা ও চালনার পোতাশ্রয়ে আক্রমণ করা হয়েছে। মার্কিন সাময়িকী নিউজ উইক ‘বাংলায় যুদ্ধঃ ভারতীয় আক্রমণ’ শিরোনামের নিবন্ধে বলা হয়, যখন বিভিন্ন দেশ যুদ্ধে নামে তখন তারা প্রত্যেকেই সম্পূর্ণ সৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে যুদ্ধ করছে বলে দাবি করে। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম প্রতিশ্রূতি দেন “যদি আমরা পাকিস্তানি আক্রমণ বন্ধ করতে চাই তাহলে আমরা শুধু সীমান্তেই বসে থাকবো না, বরং আমরা ভেতরে অনুপ্রবেশ করবো। আত্মরক্ষার প্রয়োজনে সীমান্তের যত অভ্যন্তরেই প্রবেশ করা প্রয়োজন হোক না কেন, আমরা তা করবো”। এই আদর্শিক চিন্তাধারা নিয়ে হাজার হাজার ভারতীয় সৈন্য পূর্ব-পাকিস্তান সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করেছে, এবং উপমহাদেশের দুই চিরশত্রæর মধ্যে অনন্ত বৈরিতার তৃতীয় পর্যায়ের সূচনার মঞ্চ এভাবেই প্রস্তুত হয়। হংকং থেকে প্রকাশিত সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট ‘ভারত-পাকিস্তান বিরোধ’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে লিখেন, ভারতীয় উপমহাদেশের বর্তমান গুরুতর পরিস্থিতির জন্য মূলত ইসলামাবাদ দায়ী। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সম্মেলন টেবিলে মিসেস ইন্দিরা গান্ধীকে আলোচনার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন আলোচনা এবং তাদের পার্থক্য কমাতে চেয়েছিলেন এবং সীমান্ত এলাকা থেকে উভয়ের সশস্ত্র বাহিনী প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার মূল কারণ নিয়ে কোন কথা বলেননি যার জন্য ভারতকেও ভোগান্তির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। মিসেস ইন্দিরা গান্ধী কয়েক মাস ধরে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান এবং বিশ্বের অনেক দেশকে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির সমাধান করার ব্যাপারে বলে আসছিলেন যাতে করে ৯ মিলিয়ন শরনার্থি দেশে ফিরে যেতে পারে। শরণার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য, আশ্রয় ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে গিয়ে ভারত নিজেই বড় হুমকির সম্মুখীন। সিডনি থেকে প্রকাশিত দ্যা অস্ট্রেলিয়ান ‘যে যুদ্ধ কেউ থামাল না’ শিরোনামের নিবন্ধ থেকে জানা যায়, মিসেস গান্ধী ঠিকই বলেছিলেন যখন তিনি আসন্ন ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধের কথা বলেছিলেন-অথচ তখন সবাই তাঁকে নিন্দা করেছিল। নয় মাস ধরে আমরা নিশ্চুপ ছিলাম এবং এখন সেটা অনিবার্য আকার ধারণ করেছে। ভারতের নড়বড়ে অর্থনিতির পর নয় মিলিয়ন শরণার্থীদের বোঝা চাপার পরে আমরা কি কেউ কিছু করেছি? প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে চিঠির মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে পূর্ব পাকিস্তানের গণতন্ত্র রক্ষার আবেদন ছাড়া তেমন কিছুই আমরা করিনি। কিছু ধনী শিল্পোন্নত দেশ উদ্বাস্তুদের সাহায্য করার জন্য টাকা পাঠিয়েছে। তারা সবসময় তা করে। আর অস্ট্রেলিয়ায় একটি জন আন্দোলন হল, জনগণকে সেজন্য ধন্যবাদ, কিছু না করার চাইতে এতে অন্তত কিছু কাজ হলেও হতে পারে। দৈনিক যুগান্তর “লাকসামের পতন, লক্ষ্য ঢাকা” শিরোনামের সংবাদ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে ভারতীয় বাহিনীর অভিযানের লক্ষ্য ঢাকা। আজ কলকাতায় ইস্টার্ণ কম্যান্ডের জনৈক মুখপাত্র ভারতীয় ও বিদেশী সাংবাদিকদের বলেছেন যে, বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে ভারতীয় সৈন্যবাহিনী মুক্তিবাহিনী ও সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর সহযোগিতায় বাংলাদেশের রণাঙ্গনে কয়েকটা উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করেছে। টাইমস অফ লন্ডনের খবরে বলা হয়েছে, বলা হয়েছে, “যেহেতু পাকিস্তান বিশ্ব নেতাদের করা সকল আবেদনের সতর্কবানীকে প্রত্যাখান করেছে, ইন্ডিয়া বিশ্বাস করে যে বাংলাদেশের জন্য সমাধান জারি করার জন্য তার আওয়াজ তোলা ব্যতীত ভিন্ন রাস্তা নেই। এখানে আরও বলা হয়েছে যে, পূর্বে ২৫ মার্চ থেকে পাকিস্তানী ব্যবহারের নির্মমতা বিবেচনা করে, শত কোটি শরনার্থীর উপর চাপিয়ে দেয়া দুর্দশা বিবেচনা করে এবং বাংলাদেশের প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসনের পেছনে শক্ত যুক্তির কথা চিন্তা করে পাকিস্তান দুর্বল এবং কলঙ্কিত দলিলের মাধ্যমে এই দ্বন্ধের সৃষ্টি করেছে। টাইমস অফ লন্ডনের পরামর্শ অনুযায়ী, “ এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে উত্তম পন্থা হতে পারে বাংলাদেশে ইন্ডিয়ার একটি আশু বিজয় যাতে ইন্ডিয়া পশ্চিম পাকিস্তানি আক্রমণকে প্রতিহত করতে পারে”।