জয় জয় বিশ্বনেতা বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা

33

১৭ মার্চ, জাতীয়দিবসটি হচ্ছে একটি প্রতীকী দিন। শিশুদের মানবিক বিকাশে শুভবোধ জাগ্রত হউক ও চেতনায় থাকুক সুন্দরের জায়গা- এই লক্ষ্যে জাতীয় শিশুদিবস পালন করা হয়। যদিও এই দিন ১৭ মার্চ। কিন্তু এই প্রত্যাশী দিনটিই শিশুদের মাঝে ঘটাবে শুভ বোধ। সারাবছর ধরে এই শুভবোধে নিজের পরিচর্যা করবে। নিজেকে তৈরী করবে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে নিজের গুরুত্ব প্রমাণ করবে।
বিশ্ব শিশুদিবসে পৃথিবীর সকল শিশুর জন্য একটি নিরাপদ আবাসস্থল তৈরীর অঙ্গিকার থাকে। ইউনিসেফ ও আন্তর্জাতিক শিশুকল্যাণ ইউনিয়ন কর্তৃক ঘোষিত বিশ্ব শিশু দিবস পালিত হয়েছে ১৯৫৩ সালের অক্টোবর মাসে। এরপর থেকে প্রতিবছর অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার বিশ্ব শিশুদিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বিংশ শতাব্দীতে সংগঠিত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অসংখ্য শিশু এতিম হয়ে পড়ে। পিতা-মাতাকে হারিয়ে এই সব এতিম শিশু অর্থহীন হয়ে পড়ে। ১৯২৪ সালে জেনেভায় অনুষ্ঠিত ‘লীগ অব নেশনস’ এর কনভেনশনে ঘোষণা করা হয় মানব জাতির যা কিছু শ্রেষ্ঠ আর সর্বোত্তমতা পাওয়ার যোগ্য শিশুরা। শিশুদের জন্য নিরাপদ ও আনন্দময় জগত তৈরির জন্য বারবার উদ্যোগ নেওয়া হয়। আগামীর পথ চলাকে সহজ ও সুন্দর করার জন্য সবার মাঝে আসে সচেতনতা। এভাবে চলতে থাকলেও প্রতিটি দূর্যোগ মুহূর্তে শিশুদেরকেই বেশি ভুক্তভোগী হতে হয়। তারই ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আবার অনেক শিশু এতিম হয়ে যায়। অসহায়হীন হয়ে পড়ে, পিতৃমাতৃহীন এক বিভীষিকাময় জীবন যপন করতে থাকে, বিশেষ করে পারমানবিক বোমার তেজস্ক্রিয়তায় লক্ষ লক্ষ শিশুর স্বাভাবিক জীবন বিকাশে আসে বাধা। লক্ষ লক্ষ শিশু বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে। শিশুদের জন্য নিরাপদ আবাসস্থল তৈরীর প্রচেষ্ঠা থেকে ১৯৯৮ সালের ২০ নভেম্বর জাতিসংঘ শিশু অধিকার বিষয়ক সনদটি গৃহীত হয়। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশণে গৃহীত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সাক্ষী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ছিল অন্যতম। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পালিত বিশ্ব শিশুদিবস শিশুদের মাঝে আন্তর্জাতিক চেতনা বিকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।
আর জাতীয় পর্যায়ে পালিত জাতীয় শিশুদিবসটি এদেশের শিশুদের মাঝে জাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে লালন ও ধারণ করতে অনুপ্রাণিত করে। ১৭ মার্চের পালিত জাতীয় শিশুদিবস আমাদের আগামী ভবিষ্যৎ বংশধরকে বিশ্ব দরবারে বাঙ্গালী জাতিসত্ত্বার পরিচয় বহনে উৎসাহ দেয়।
তিনি শুধু বাঙ্গালির নয়, ভারতীয় উপমহাদেশের একজন অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব ছিলেন। তিনি বাঙ্গালির অধিকার রক্ষায় ব্রিটিশ ভারত থেকে ভারত বিভাজন আন্দোলনে অংশ গ্রহণ এবং পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান করেন। তার অসাধারণ নেতৃত্বে শত বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে ছিনিয়ে এনেছিলেন স্বাধীনতা। আমরা লাল-সবুজের পতাকা পেয়েছি, একটি জাতীয় সংগীত পেয়েছি। একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র মানচিত্র পেয়েছি, তাই সারাবিশ্বে যে কয়েকজন বিশ্ব বরেণ্য নেতা ছিলেন তাদের মতে বঙ্গবন্ধু ও একজন বিশ্ব নেতা হিসাবে আমাদের অহংকার। বঙ্গবন্ধু বাঙালির অধিকার রক্ষায় কখনো আপস করেনি। তিনি দীর্ঘ সাড়ে ১৩ বছরে ১৮ বার কারাবরণ করেন। ফাঁসির মঞ্চেও তিনি বাংলা ও বাঙ্গালির জয়গান করেন। একাত্তরে আমাদের যুদ্ধ শুধু পাকিস্তানি অপশাসনের বিরুদ্ধে ছিল না, ছিল একটি গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক বৈষম্যমুক্ত উদারমানবিক এবং অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের জন্য। তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং কারাগারের রোজনামচা তার গণতন্ত্র দর্শনের একটি উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্র। তিনি এই বাংলার মানুষের সকল প্রকার মুক্তির কথা বলেন। অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক মুক্তির কথা বলেন, ধর্ম নিরপেক্ষতার জন্য সকল ধর্মের প্রতি সম্মান বোধের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। সোনার বাংলা তৈরী করার জন্য শুরু থেকে শিক্ষার প্রতি জোড় দেন। ধাপে ধাপে প্রাথমিক শিক্ষাকে সরকারিকরণের পদক্ষেপ নেন। সর্বোপরি এই বাংলার মানুষ যেন একটি সম্মানজনক নাগরিকের সকল অধিকার ভোগ করতে পারেন তার জন্য প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকারকে গুরুত্বসহ বিবেচনায় রাখেন।
বঙ্গবন্ধু একদিনে যেমন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আনতে পারে নাই তেমনি এক দিনেই মহান নেতার মর্যাদা লাভ করে নাই। সেই শৈশবের চলার পথ থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সাধারণ নমানুষের পাশাপাশি বড়মাপের সৎজ্ঞানী ব্যক্তির সংস্পর্শে আসে। তার ব্যক্তিগত জীবনে এই আপামরজন সাধারনের প্রভাব আছে। শৈশব থেকেই বঙ্গবন্ধু তার জীবন দর্শনে দুইটি চেতনাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। একটি হচ্ছে মানুষের প্রতি ভালবাসা আর একটি হচ্ছে অধিকার আদায়ে সচেতনতা। সেই শৈশব থেকে তার মানবিক দিকগুলো আস্তে আস্তে বিকশিত হতে থাকে। তিনি নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে মানুষের অবস্থান বুঝতে পারত। তাই তো মানুষের নূন্যতম প্রয়োজনকে সম্মান দেখিয়ে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতো। ছোট জীবনের বিশাল পরিবর্তনে অনেকের বসবাস। তাই তো আত্মকেন্দ্রিক জীবন পরিহার করে বৃহত্তর পরিসরে নিজেকে সঁপে ছিলেন। মানবিক বোধ ও নৈতিকতাবোধে নিজেকে গড়ে তুলেতে গিয়ে একবারে একটি সাধারণ জীবন বেছে নিয়ে ছিলেন। তাঁর এই অতিসাধারণ বৈশিষ্ট্যটি তাঁকে অনন্য অসাধারণের মহিমায়-মহিমাম্বিত করেছে। সকলের সাথে তিনি একটি মেলবন্ধনে জড়িয়ে যান। জীবনের প্রতিটি ধাপে ধাপে তিনি বিশেষ গুণ সম্পন্ন মানুষের সাহচর্যে আসে। ফলে যৌবনকালে কবি জসীমউদ্দীন, শিল্পী জয়নুল আবেদিন, সরদার ফজলুল করিম, মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সার প্রমুখ বিশিষ্ট ও বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক ও শিল্পী কলাকুশলীদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। তারই ধারা বাহিকতায় সেই সময়ের কাÐারী ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, মোজাফ্ফর আহমদ চৌধুরী, আবুল ফজল প্রমুখ মনীষীকে শ্রদ্ধা ও সম্মানের স্থানে রাখেন। শুধুমাত্র শিক্ষা- চিকিৎসা- সংস্কৃতির সাথে জড়িত ব্যক্তিদের সাথে নয়, গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যে ও ধারক ও বাহকদের সাথেও সৌহাদ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখেন। আব্বাসউদ্দিন, আব্দুল লতিফ, নিমলেছু চৌধুরী, শাহ আবদুল করিম, মহিন শাহ প্রমুখ লোকশিল্পীদের সাথে ছিল আত্মীক সম্পর্ক। রাজনৈতিক জীবনে তিনি এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানীরমত মহান ব্যক্তিদের সাহায্যে এসে নিজেকে তৈরী করেছেন। জীবনের প্রতিটি ধাপে ধাপে মাটি ও মানুষ, রাজনীতি ও রাজা এবং স্বাধীনতা ও স্বাধীকার নিয়ে সংগ্রাম করেছেন। মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষায় এই দেশের মানুষের পাশে এসে সকল অন্যায়, অত্যাচার ও অধিকার রক্ষায় সংগ্রাম করেছেন।
মুজিববর্ষের শুরু থেকেই এদেশের মানুষের মধ্যে একটি চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছিল। এই মহান নেতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের জন্য নানাবিধ অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। অলিতে-গলিতে- পাড়া-মহল্লা-শহর- জেলা-বিভাগীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীরা আয়োজনের মাধ্যমে এই মহান নেতার রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম নিয়ে অনুষ্ঠান করছে। কিন্তু বৈশ্বিক সমস্যা করোনার প্রভাবে সকল ধরনের অনুষ্ঠানে ভাটা পড়ে। অর্থাৎ স্বাস্থ ঝুকির কথা বিবেচনা করে সকল ধরনের কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক সংক্ষিপ্ত ঘোষণা আসে। কিন্তু যারা জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনকে নিয়ে ব্যস্ত ছিল তারা এই করোনা কালে তেমন ব্যস্ততা দেখাতে ব্যর্থ হয়। করোনা কালে আপামার জনসাধারণের পাশে এসে সাহায্য সহযোগিতায় তেমন তৎপরতা দেখাতে পারেনি। এমনকি সরকার কর্তৃক বরাদ্ধকৃত ত্রাণ নিয়ে নিজেদের ঘর গোছাতে ব্যস্ত ছিল। অনেক রাজনৈতিক কর্মীর ত্রাণ আত্মসাৎ সংবাদে সকলেই মর্মাহত হয়। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপ্সোস করে বলেন, আমি যদি কাফনের কাপড় দিতাম, সেই কাপড়ও আত্মসাৎ হত। স্বাধীনতার এত বছর পরেও আমাদের মধ্যে যে শ্রেণী বিভাজন আছে তার মূলে আছে অপরাজনীতি, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে যারা তৎপরতা দেখিয়েছে তাদের অনেকেই মুজিবীয় আদর্শের প্রতিফলন দেখতে ব্যর্থ হয়েছে। সত্যিকার অর্থে মুজিবীয় আদর্শের দীক্ষায় দীক্ষিত কর্মচারীরা শুরু থেকেই অবহেলিত। এদেশের উন্নয়ন ধারাকে অব্যাহত রাখতে হলে মুজিবীয় আদর্শের সত্যিকার চর্চা সকলের জন্য কাম্য।
লেখক: কলামিস্ট ও অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ডা. ফজলুল-হাজেরা ডিগ্রী কলেজ, হালিশহর, চট্টগ্রাম