জয়নুল আবেদিন

0

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অসাধারণ প্রতিভাবান শিল্পী। ইনস্টিটিউট অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফ্টস প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশে আধুনিক শিল্প আন্দোলনের তিনিই পুরোধা। ১৯৪৮ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানের (বর্তমান চারুকলা ইনস্টিটিউ) তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। তিনি তাঁর নেতৃত্বের গুণে অন্যান্য শিল্পীদের সংগঠিত করার জন্য সুপরিচিত ছিলেন। তিনি এমন এক স্থানে এটি করতে সক্ষম হয়েছিলেন যেখানে বাস্তবিক পক্ষে অতি নিকট অতীতেও শিল্পের প্রাতিষ্ঠানিক বা পেশাভিত্তিক কোনো ঐতিহ্য ছিল না। জয়নুল আবেদিন ও তাঁর কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী সহকর্মীর অক্লান্ত চেষ্টায় মাত্র এক দশকের মধ্যেই বাংলাদেশে আধুনিক শিল্পকলা তার স্থান করে নেয়। জয়নুল আবেদিনের অসাধারণ শিল্প- মানসিকতা ও কল্পনাশক্তির জন্য তিনি শিল্পাচার্য্য উপাধিতে ভূষিত হন।
জয়নুল আবেদিন ১৯১৪ সালে ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বেড়ে উঠেছেন ব্রহ্মপুত্রের লালিত্যে গড়ে ওঠা সবুজ শ্যামলিমায়। জয়নুল তাঁর প্রথম জীবনেই নদী ও অবারিত প্রকৃতির মাঝে রোমান্টিকতার অনুপ্রেরণা পান। তিনি ১৯৩৩ সালে কলকাতা সরকারি আর্ট স্কুলে ভর্তি হন এবং পাঁচ বছর সেখানে ব্রিটিশ / ইউরোপীয় স্টাইলের ওপর পড়াশুনা করেন। ১৯৩৮ সালে তিনি আর্ট স্কুল অনুষদে যোগ দেন এবং তিনি তাঁর চিত্রাঙ্কন চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৯৩৮ সালে সর্ব ভারতীয় চিত্রকলা প্রদর্শনীতে তাঁর অঙ্কিত জলরঙের ছবির জন্য তিনি স্বর্ণপদক প্রাপ্ত হন। তাঁর অঙ্কনের মূল বিষয়বস্তু ছিল ব্রহ্মপুত্র নদ, যা ছিল তাঁর আশৈশব প্রেরণার বিষয়। এ স্বীকৃতিই তাঁকে প্রথমবারের মতো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে। তিনি নিজস্ব একটি ধারা সৃষ্টির আত্মবিশ্বাস লাভ করেন। আবেদিনের কাছে প্রাচ্যের অঙ্কন ধারা অতিমাত্রায় রীতি নির্ভর ও অপরিবর্তনশীল মনে হয়েছে, যা তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারে নি। অন্য দিকে ইউরোপীয় ধারা তাঁর কাছে সীমাবদ্ধ হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। এসব কিছু মিলিয়ে তিনি রিয়ালিজমের প্রতি আকৃষ্ট হন। রেখা চিত্রের ওপর তাঁর দুর্বলতা অবশ্য থেকেই যায়, এবং দৈনন্দিন জীবনচিত্রের উপস্থাপনায় তিনি এর ব্যবহারে এনেছেন বহু বৈচিত্র্য। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে জয়নুল আবেদিন ধারাবাহিকভাবে একাধিক চিত্র স্কেচ করেন। এ দুর্ভিক্ষে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। সস্তা প্যাকিং পেপারে চাইনিজ ইঙ্ক ও তুলির আচরে ‘দুর্ভিক্ষের রেখাচিত্র’ নামে পরিচিত জয়নুলের এ চিত্রকর্মে ফুটে উঠেছে শব-সওদাগরদের নিষ্ঠুরতা ও নৈতিক কলুষতা, সে সাথে নিপীড়িতের অমানবিক দুর্দশা। চিত্রকর্মগুলি জয়নুলকে ভারতব্যাপী খ্যাতি এনে দেয়। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা এগুলি মানুষের দুর্দশা, কষ্ট ও প্রতিবাদকে সামনে এনে বাস্তবধর্মী চিত্র অঙ্কনে তাঁর স্বকীয়তাকে বিকশিত করে। ‘দ্য রেবেল ক্রো’ (জলরং, ১৯৫১) এ ধারার সবচেয়ে উজ্জ্বল নিদর্শন। উচ্চ মার্গের নন্দনতত্তে¡র মিশেলে সামাজিক অনুসন্ধিৎসা ও প্রতিবাদের সম্মিলিত প্রকাশ রিয়ালিজমের এ নির্দিষ্ট ধারা বিভিন্ন সময়ে জয়নুলকে প্রেরণা জুগিয়েছে: যেমন ১৯৬৯ ও ১৯৭১ এ সময় জয়নুল তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কাজ করেছেন এ স্টাইলে।
১৯৭৫ সালে জয়নুল আবেদিন সোনারগাঁও এ একটি লোকশিল্প জাদুঘর এবং ময়মনসিংহে একটি গ্যালারি (শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা) প্রতিষ্ঠা করেন। এ দুটি প্রতিষ্ঠানে তাঁর অংকিত কিছু চিত্রকর্ম সংরক্ষিত আছে। দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে পুনরুজীবিত করার আন্দোলনে তিনি নিজেকে সংক্রিয়ভাবে জড়িত করেন। তিনি আশংকা করেছিলেন যে, পাশ্চাত্য টেকনিক ও রীতির প্রভাব, যা এখানকার কিছু চিত্রশিল্পীকে অনুপ্রাণিত করেছিল, দেশিয় রীতিকে ধ্বংস করবে। কিন্তু ফুসফুসে ক্যান্সারের কারণে তিনি তাঁর কাজ সম্পন্ন করতে পারেন নি। তাঁর স্বাস্থ্য দ্রæত ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে। ১৯৭৬ সালের ২৮ মে ঢাকায় তাঁর মৃত্যু হয়। সূত্র: বাংলাপিডিয়া