জ্ঞানপ্রদায়িনী শ্রীশ্রী সরস্বতী

10

ঋতু বৈচিত্র্যের এই বাংলায় শীতের পরশ বুলিয়ে দিতে এসেছে কুয়াশা ঘেরা শীত। প্রকৃতি যেন শীতলতায় সমৃদ্ধ। মাঘের শেষে বাতাসে আ¤্র মুকুলের সৌরভে মুখরিত প্রকৃতি। শীতের শূন্যতাকে পূর্ণ করতে জ্যোতির্ময়ী মহাদেবীর মর্ত্যে আগমন। এ যেন আগামী দিনের অরুণ আলোর দিশারী নব নব স্বপ্ন পথের যাত্রী শিক্ষার্থীদেরকে দেবী দান করবেন উজ্জ্বল চৈতন্য। ভক্তের মনোবাসনা পূর্ণ করবেন মা মহাজ্ঞানের আলোয়। দেবী বন্দনা মূলত জ্ঞান শক্তি লাভ করার সাধনা। তাইতো বাংলার প্রতি ঘরে ঘরে, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে মহাসারম্ভরে সনাতনী সম্প্রদায় উদযাপন করে শ্রী পঞ্চমীর শুভলগ্নে সরস্বতী পূজা। মাতৃ আরাধনা তখনই সার্থক যদি মৃন্ময়ী মায়ের মধ্যে চিন্ময়ীর উপলব্ধি আমরা করতে পারি। আর তা কেবল সাত্তি¡¡ক পূজোর আয়োজনের মাধ্যমে সম্ভব। বিভিন্ন নামে এই দেবী পূজিতা। কখনো বাগদেবী, কখনো সারদা, কখনো ব্রাহ্মী, কখনো শতরূপা। এইছাড়া আরো নামে দেবী ভক্তের হৃদয়ে বিরাজ করেন। বুৎপত্তিগতভাবে সরস্বতী শব্দের দুইটি অর্থ রয়েছে। এক অর্থে তিনি জ্যোতির্ময়ী। অন্য অর্থে শতত রসে সমৃদ্ধা অর্থাৎ যাতে জল আছে তাই সরস্বতী। কখনো তিনি দেবী, কখনো তিনি ¯্রােতস্বিনী নদী সরস্বতী। দেবী সরস্বতী যেমন চেতনার প্রতিমা, নদী সরস্বতী তেমনি চেতনার ¯্রােতস্বিনী। যে চৈতন্য দেবী বিগ্রহে পুঞ্জীভূত, সে চৈতন্যই আবার সরস্বতী তটিনীতে বিচিত্র বিলাসে তরঙ্গায়িত। যারা ন¤্রনেত্রে আলোর প্রতিমাকে নিদিধ্যাসন করে হৃদয়কে চেতনার নদীতে রূপান্তরিত করেন, তারাই পারেন জীবনের দুই তীরকে নির্মল কর্মের প্লাবনে সঞ্জীবিত ও সম্পদশালী করে মনুষ্যত্বের মহাসমুদ্রে ছুটে চলতে। দেবী সুভ্রবর্ণা, সুভ্র হলো সত্ত¡গুণের প্রতীক। জ্ঞান অর্জন করতে গেলেই সাধককে তার দেহ, মন ও প্রাণে সুভ্র-শুচি পবিত্র হতে হবে। তবেই তিনি জ্ঞান অর্জন করতে পারেন। শ্রীমদভগবৎগীতায় শ্রীভগবান অর্জুনকে উদ্দেশ্য করে সমগ্র বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে বললেন, “শ্রদ্ধাবান লভতে জ্ঞানং তৎপরঃ সংযতেন্দ্রিয়” অর্থাৎ শ্রদ্ধাবান ও জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তি জ্ঞান লাভ করতে পারে। তাই শিক্ষার্থীদের অবশ্যই ইন্দ্রিয় সংযম এবং ভক্তিপরায়ণ হতে হবে। তবেই তাদের পক্ষে দেবীর কৃপা লাভ করা সম্ভব। দেবীর বাহন শ্বেতহংস। রাজহাঁসের একটি অসাধারণ গুণ রয়েছে। হাঁস জলমিশ্রিত দুধ থেকে শুধু দুধটুকু গ্রহণ করে নিতে পারে। আসলে হাঁসকে রূপক অর্থেই ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ লোকশিক্ষার জন্য তিনি সাথে হাঁস এনেছেন। তাই বলতে হয় একমাত্র প্রকৃত মাতৃসাধকরাই পারেন সংসারের অসার বস্তু ত্যাগ করে সারবস্তু গ্রহণ করতে। দেবী এই বার্তায় আমাদের দিয়েছেন সংসারে নিত্য বস্তু ধরতে আর অনিত্য বস্তু পরিত্যাগ করতে। এইজন্যই তিনি হংসবাহনা। তাই শিক্ষার্থীদেরকে হংসধমী হতে হবে। দেবীর হাতে বীণা। যার ঝংকারে উঠে আসে ধ্বনি বা নাদ। এই সুর অত্যন্ত মধুর। দেবীর সাত্তি¡ক পূজার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জীবনও যাতে মধুর হয় তার জন্যইতো দেবী-বন্দনা। তাই তিনি বীণা ধারণ করেছেন। শিক্ষার্থীদের মূল লক্ষ্যই হলো জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে জীবনকে সুন্দর ও মধুময় করে তোলা। দেবীর আরেক হাতে প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদ। যাতে রয়েছে সঞ্চিত জ্ঞানভান্ডার। পরা ও অপরা এই দুই বিদ্যাই জীবনে প্রয়োজন। একমাত্র তাঁর কৃপা লাভেই আমরা তা অর্জন করতে পারি। দেবী সরস্বতী শ্বেতপদ্মের উপর আসীন। এর কারণ পূর্ণ প্রস্ফুটিত পদ্মফুল হলো সফল ও সমৃদ্ধ জীবনের প্রতীক। তাইতো জ্ঞান পিপাসু শিক্ষার্থীরা মাতৃ সাধনার মাধ্যমেই প্রস্ফুটিত ফুলের ন্যায় তাদের জীবন গড়তে পারে। জীবনের সর্বোমুখী বিকাশ সাধনই হলো শিক্ষা। এখানে বিকশিত পদ্মের সাথে জীবনের বিকাশকে তুলনা করা হয়েছে। মায়ের এই আদর্শকে হৃদয়ে ধারণ করে নিজের জীবনকে বিকশিত করতে পারলে সেই জীবনও ফুলের মতো পবিত্র, সুন্দর, বিকশিত ও সমৃদ্ধ হবে। দেবী মাতৃরূপে বন্দিতা ও পূজিতা। জাগতিক জীবনে ছেলেমেয়েরা পিতার চাইতে মায়ের নিকট বেশী আবদার করে থাকে। মা ও ¯েœহ আদর ভালবাসা দিয়ে ছেলেমেয়ের সেই আবদার পূরণে সচেষ্ট থাকেন। দেবী সরস্বতী ও শিক্ষার্থীদের কাছে নিজের মায়েরই প্রতিচ্ছবি। শুদ্ধভক্তির চর্চায় শিক্ষার্থীদের অন্তুরে প্রকৃত মাতৃভাব জাগরিত হলেই দেবী বসন্ত পঞ্চমীর শুভদিনে তাদের মনোবাসনা পূর্ণ করবেন। দেবী নানা উপাচারে পূজিতা ও বন্দিতা। পূজার সময় অভ্র-আবির, আমের মুকুল, দোয়াত-কলম, পুস্তক, বাদ্যযন্ত্র, যবের শিষ, বাসন্তি রং এর গাঁদা, পলাশ ইত্যাদি মায়ের কৃপা লাভের জন্য দেওয়া হয়। প্রচলিত প্রথা অনুসারে শিক্ষার্থীরা পূজার আগ পর্যন্ত কুল খায় না। দেবীকে নতুন বছরে কুল দিয়েই তবে তারা গ্রহণ করে। দেবী বন্দনা মূলতঃ আমাদের জীবনকে শুভ্র ও পবিত্র রাখার শিক্ষা দেয়। জ্ঞান সাধনায় ব্রতী হয়ে জীবনকে ছন্দময় ও মধুময় করার শিক্ষা দেয়।
পরিশেষে বলবো, শ্রীপঞ্চমীর শুভলগ্নে শ্রীশ্রী সরস্বতী পূজার মাধ্যমে ছোট-বড় সকলে বিদ্যাদেবীর আরাধনায় নিজেকে নিয়োজিত রাখবেন। যাতে জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে সকলে সমাজ ও দেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধ করতে পারি। এবারের বসন্ত পঞ্চমী বিশ্বভূবনে মানব মুক্তির বসন্ত রূপে চিহ্নিত হোক। ঘরে বাইরে, আপন পরে প্রীতির বন্ধনে সকলে আবদ্ধ হোক। দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে শুভ শক্তির চিন্ময় বন্ধন পূর্ণতর হোক। সবার জীবনে হাসির আনন্দধারা বয়ে যাক। জীবন হোক গতিময়।
লেখক : প্রধান শিক্ষক, ধর্মীয় বক্তা ও প্রাবন্ধিক