জোয়ারের পানিতে প্লাবিত কৃষিজমি-লোকালয়

2

আনোয়ারা প্রতিনিধি

আনোয়ারা উপজেলার চাতরী ইউনিয়নের কান্দরিয়া খালের স্লুইস গেট ভেঙ্গে জোয়ারের পানি ঢুকে প্রতিনিয়ত তলিয়ে যাচ্ছে কৃষি জমি ও লোকালয়। শত শত একর কৃষি জমি তলিয়ে যায় পানির নিচে। ফলে এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে চাষাবাদ হচ্ছেনা। চাষাবাদ না হওয়ায় অনাহারে-অর্ধাহারে দিন পার করছেন শত শত কৃষক।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, এক বছর না যেতেই পানির তোড়ে ভেঙ্গে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্লুইস গেটটি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুর্নীতির কারণে প্রায় চার কোটি টাকায় নির্মিত স্লুইস গেটটি ভেঙ্গে গেছে। এছাড়া সাবেক দুই চেয়ারম্যানের পাড় লাগিয়তের কারণও- স্লুইস গেটটি ভেঙ্গে যাওয়ার অন্যতম কারণ বলে জানিয়েছেন তারা।
জানা যায়, আনোয়ারা উপজেলার চাতরী ইউনিয়নের সিংহরা, চাতরী, কেঁয়াগড় গ্রামের উপর দিয়ে বয়ে গেছে কান্দরিয়া খাল। তিন গ্রামের শত শত একর কৃষি জমিতে চাষাবাদের জন্য একসময় খালটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও ধীরে ধীরে খরস্রোতা খালে পরিণত হয়ে কৃৃষিকাজের জন্য হয়ে উঠে ক্ষতিকারক। ধীরে ধীরে খালটি বড় হয়ে গিলে খাচ্ছিল মানুষের কৃষিজমি। তাছাড়া জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যেতে থাকল মানুষের রোপা ধান। ২০১৮ সালে কান্দরিয়া খালে স্লুইস গেট নির্মাণের কাজ শুরু করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। প্রায় ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে স্লুইস গেটটির নির্মাণ কাজের দায়িত্ব পায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স রহমান ইঞ্জিনিয়ারিং।
স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, এই প্রকল্পের ঠিকাদার ছিলেন পানি উন্নয়ন বোর্ডেরই অবসরপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা। ফলে এইস্লুইস গেট নির্মাণে অনিয়মের ষোলকলাই পূর্ণ করেন ঠিকাদার। ফাইল ভাঙ্গা দিয়ে ব্লক নির্মাণ, নিম্নমানের পাথর, সিলেটি বালির পরিবর্তে স্থানীয় বালির ব্যবহারসহ নানা অনিয়মের মহোৎসব চলে স্লুইস গেটটিতে।
স্থানীয় কয়েকজন ভুক্তভোগী জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের এসও ফজলে এলাহী ছিলেন এসব দেখভালের দায়িত্বে। তিনি রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ায় আজকে বছর না যেতেই স্লুইস গেটটির বেহাল দশা। ঠিকাদার, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের ভাগ-বাটোয়ারার ফলে স্লুইস গেটটির অকাল মৃত্যু হয়েছে। স্লুইস গেট ভেঙ্গে যাওয়ার পর জরুরি বরাদ্দের আওতায় জিও ব্যাগ ফেলে খাল বন্ধ করার জন্য আরো চল্লিশ লক্ষ টাকার বরাদ্দ দেয়া হয়। আর এই টাকাটাও নামমাত্র লোক দেখানো কাজ করে নয়ছয় করার অভিযোগ উঠে ঠিকাদার এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।
এছাড়া স্থানীয় সাবেক দুই ইউপি চেয়ারম্যান কান্দরিয়া খালের পাড় লাগিয়ত করে হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা। পাড় লাগিয়ত নিয়ে দুই চেয়ারম্যানের মধ্যে দফায় দফায় ঝামেলাও হয়েছিল বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
ফলে পাড় লাগিয়ত নেয়া জেলেদের ইচ্ছা মাফিক প্রতিদিন জোয়ার ভাটার পানি উঠানামা করানোর ফলে অনিয়ম দুর্র্নীতির মাধ্যমে করা স্লুইস গেটটি এক বছরের মাথায় ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। আর এর খেসারত দিতে হচ্ছে চাতরী ইউনিয়নের দুই শতাধিক কৃষককে। শত শত একর জমি অনাবাদি পড়ে রয়েছে। অনেকে প্রথম প্রথম চাষাবাদ হওয়ার আশায় ধানের চারা রোপণ করে। কিন্তু জোয়ারের পানিতে ধানের চারা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। বর্তমানে চাতরী ইউনিয়নের দুই শতাধিক কৃষকের পরিবারে হাহাকার চলছে। অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে তাদের।
গতকাল সরেজমিন স্লুইস গেট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, প্রচন্ড গতিবেগে ঢুকছে জোয়ারের পানি। আর এই জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে চাতরী, সিংহরা, কেঁয়াগড় গ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকায় কৃষি জমি, মাছের প্রজেক্ট, রাস্তা, মাঠ-ঘাটসহ সবকিছু।
পূর্ব সিংহরা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, চলাচলের প্রধান সড়ক গড়িয়ে পানি পড়ছে সড়কের অন্য পাশে। জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যাওয়া সড়কে অতি কষ্টে প্রতিদিন স্কুল ছুটির পর চলাচল করে সিংহরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং সিংহরা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
স্থানীয় কৃষক রেজাউল করিম জানান, দীর্ঘদিন ধরে আমরা জোয়ারের পানির জন্য চাষাবাদ করতে পারছিলাম না। ২০১৮ সালে সরকার কান্দরিয়া খালে স্লুইস গেট নির্মাণ করায় আশায় বুক বেঁধেছিলাম। সেই আশা এখন হতাশায় পরিণত হয়েছে।স্লুইস গেট ভেঙ্গে জোয়ারে পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে কৃষি জমি।
চাতরী ইউপি চেয়ারম্যান আফতাব উদ্দিন চৌধুরী সোহেল বলেন, বর্ষার কারণে এখন স্লুইস গেটের কোনো কাজ করা সম্ভব হচ্ছেনা। আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করছি। আশা করি আগামী শুষ্ক মৌসুমে কাজ শুরু করা সম্ভব হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী অনুপম দাশ জানান, চাতরী ইউনিয়নের কান্দরিয়া খালের স্লুইস গেটটি বড় পরিসরে করতে হবে। পানির চাপ বেড়ে যাওয়ায় সেখানে সাধারণ স্লুইস গেট নির্মাণ করলে টিকবে না। এ জন্য আমাদের পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্লুইস গেট এক্সপার্টরা নতুন উন্নত মানের স্লুইসগেট ডিজাইনের কাজ করছে। ডিজাইন হয়ে গেলে আমারা বরাদ্দের জন্য আবেদন করব।