জুমার নামাজের পর আন্দরকিল্লায় উত্তেজনা

86

নিজস্ব প্রতিবেদক

কুমিল্লা শহরের একটি পূজামন্ডপে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার জের ধরে শারদীয়ার বিজয়া দশমীর দিনে গতকাল শুক্রবার জুমার নামাজের পর আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ থেকে বের হয়ে একদল লোক বিক্ষোভ করেছে। এ ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির দাবি জানিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শনের পর মিছিল করে তারা রহমতগঞ্জের জে এম সেন হলের দিকে এগিয়ে যায়। একপর্যায়ে মিছিল থেকে কয়েকজন লোক আলাদা হয়ে জেএমসেন হলের বাইরে সড়কের ওপর স্থাপিত পূজা মন্ডপের তোরণ ভাঙ্গার চেষ্টা চালায়। পূজা উপলক্ষে মন্ডপের বাইরে টাঙানো বিভিন্ন ধরনের ব্যানার-ফেস্টুন টেনে ছিঁড়ে ফেলে। এরপর তারা জেএমসেন হলের ভেতরে প্রবেশ করতে চাইলে প্রধান ফটকে পুলিশের বাধার মুখে পড়ে। খবর পেয়ে অতিরিক্ত পুলিশ ফোর্স দ্রুত ঘটনাস্থলে এসে টিয়ার শেল ছুঁড়ে ধাওয়া দিলে তারা সেখান থেকে মোমিন রোড হয়ে চেরাগী মোড়ের দিকে পালিয়ে যায়। এ সময় পুলিশ ঘটনাস্থল ও আশপাশের এলাকা থেকে অন্তত ৭০ জনকে আটক করে।
বিকালে এ ঘটনার প্রতিবাদে জেএমসেন হলের ভেতর থেকে আরেক দল লোক তাৎক্ষণিকভাবে মিছিল নিয়ে সড়কে বেরিয়ে আসে। বিভিন্ন শ্লোগান দিয়ে তারা আন্দরকিল্লা মোড়ে গিয়ে অবস্থান নেয় এবং বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। এতে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। ততক্ষণে আন্দরকিল্লা মোড় থেকে জে এম সেন হল পর্যন্ত সবকটি সড়ক ও অলিগলির মুখে বিপুল সংখ্যক পুলিশ অবস্থান নেয়। বেলা গড়ানোর সাথে সাথে সেখানে পুলিশের অতিরিক্ত ফোর্স বৃদ্ধির পাশাপাশি জলকামানসহ বিক্ষোভ মোকাবেলায় নানা পুলিশি সরঞ্জামও এনে জড়ো করা হয়। একপর্যায়ে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন, নগর পুলিশের দক্ষিণাঞ্চলের উপ-কমিশনার (ডিসি) বিজয় বসাক, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট রাণা দাশগুপ্তসহ পূজা উদযাপন পরিষদের শীর্ষ নেতারা একে একে জে এম সেন হল পূজা মন্ডপ পরিদর্শনে আসেন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতে বিক্ষোভরতদের কেউ কেউ সড়কে খড়কুটো জড়ো করে অগ্নিসংযোগ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চাইলে পুলিশ ধাওয়া দিয়ে তাদের নিবৃত্ত করে। পূজা উদযাপন পরিষদের নেতারা এসময় পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করলে প্রতিমা বিসর্জন না দেয়ার ঘোষণাও দেন। তবে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে পুলিশি নিরাপত্তায় জেএমসেন হল পূজামন্ডপের প্রতিমা নিরঞ্জনের ব্যবস্থা করা হয়। রাত আটটা নাগাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসলে পুলিশ সদস্য ও বিক্ষোভ মোকাবেলার সরঞ্জামাদি প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।
দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পুরো আন্দরকিল্লা-মোমিন রোড এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করলেও পুলিশ ও প্রশাসনের কঠোর এবং তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের কারনে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। পাল্টা-পাল্টি মিছিল শ্লোগানের সময় আন্দরকিল্লা-মোমিন রোড এলাকায় দীর্ঘসময় যান চলাচল ও দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। সন্ধ্যার পর তা স্বাভাবিক হয়ে আসে।
রাতে পূজা মন্ডপের ব্যানার-ফেস্টুন ছেঁড়া ও তোরণ ভাঙার চেষ্টার প্রতিবাদে আজ শনিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত চট্টগ্রামে হরতাল আহব্বান করেছে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদ। হরতাল পালন শেষে প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে দেশব্যাপী পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণার কথা রয়েছে।
রাত নয়টায় এ প্রতিবেদন লেখার সময় যোগাযোগ করা হলে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট রাণা দাশগুপ্ত পূর্বদেশকে বলেন, আমাদের ঘোষিত শনিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত চট্টগ্রামে হরতাল কর্মসূচি ঠিক থাকবে। হরতাল পালন শেষে দুপুর সাড়ে ১২টায় আমরা প্রেসক্লাবে গিয়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে দেশব্যাপী পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
কোতোয়ালি থানার ওসি মো. নেজাম উদ্দিন পূর্বদেশকে বলেন, বিশৃঙ্খলা ও অপরাধমূলক কার্যকলাপে সম্পৃক্ত সন্দেহে ঘটনাস্থল ও আশপাশের এলাকা থেকে মোট ৭০ জনকে আটক করা হয়েছে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী কেউ কিংবা পুলিশ বাদী হয়ে থানায় মামলা করবে। আমরা এখনও থানার বাইরেই রয়েছি। পরবর্তীতে এ ব্যাপারে আইনি পদক্ষেপ চূড়ান্ত করা হবে।
উল্লেখ্য, কালের পরিক্রমায় উপমহাদেশে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবে পরিণত হওয়া শারদীয় দুর্গাপূজা চলার মধ্যেই গত ১৩ অক্টোবর মহাষ্টমীর দিন সকালে কুমিল্লা শহরের নানুয়া দিঘীর পাড় পূজা মন্ডপে পবিত্র ধর্মীয় গ্রন্থ অবমাননার অভিযোগে স্থানীয়দের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। পরে তা রীতিমত ধর্মীয় উন্মাদনায় রূপ নিলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষ ও প্রতিমা ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এ ঘটনাকে উপজীব্য করে বানানো একটি ভিডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়লে তার জের চাঁদপুরেও পূজা মন্ডপে ভাংচুর ও সংঘর্ষ হয়। সেখানে প্রাণহানিও ঘটে। পূজামন্ডপে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে জেলার বাঁশখালী ও কর্ণফুলী উপজেলা, কক্সবাজারের পেকুয়া, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ ও কুলাউড়া এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জেও। এরপর জেলা প্রশাসকদের চাহিদাপত্রের ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত ১৩ অক্টোবর রাত নয়টা থেকে সারাদেশের ২২ জেলায় বিজিবি মোতায়েনের নির্দেশ দেয়। আজ শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বিজিবি সদস্যরা দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় মোতায়েন থাকবে।