জুমচাষের জন্য পাহাড়ে নির্বিচার আগুন, প্রাণি-জীববৈচিত্র্য বিপন্ন

15

এম. কামাল উদ্দিন, রাঙামাটি

পার্বত্য চট্টগ্রামে জুমচাষের জন্য বিভিন্ন পাহাড়ে ‘আগুন’ ধরিয়ে ঝোঁপঝাড় পরিষ্কার করা হচ্ছে। এতে করে সেখানকার জীববৈচিত্র্য চরম বিপন্নের হুমকিতে পড়েছে। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ও পাহাড় ধ্বংসের অন্যতম কারণ হওয়া সত্তে¡ও পাহাড়ে সনাতন পদ্ধতিতে অবাধে চলছে জুম চাষ। রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির বিস্তীর্ণ এলাকায় অসংখ্য পাহাড়ে নির্বিচারে অগ্নিসংযোগ করে জুম চাষ অব্যাহত রয়েছে। সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে এক শ্রেণীর জুমিয়া উপজাতি জুম চাষের নামে পাহাড়ে আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ফেলছে মূল্যবান গাছপালা।
জুম চাষে ভালো ফসল ফলাতে হলে আগুন জ্বালাতেই হবে- এই ভ্রান্ত ধারণা থেকেই পাহাড়িরা প্রতি বছরের মার্চ-এপ্রিল ও মে মাসে পাহাড়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এ ৩ মাস প্রকৃতি শুষ্ক থাকায় আগুন এক জায়গায় জ্বালানোর সাথে সাথে বিশাল এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। সেই আগুন নেভানোর কোনো ব্যবস্থাও নেই। আর কেউ তা নেভাতেও চায় না। এতে করে পুড়ে ছাই হয়ে যায় পাহাড়ের পর পাহাড়। ফলে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস ও উপকারি কিট-পতঙ্গ কমে যাচ্ছে। পাহাড় ধ্বস ও নদীসমূহের গভীরতা কমে আসছে। এছাড়াও বিনষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। জুম চাষের জন্য পাহাড়ের পর পাহাড় আগুনে পুড়ে কোটি কোটি টাকার বনজ সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ২৫টি থানায় প্রতি বছর চৈত্র মাস থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত জুম চাষের লক্ষ্য নির্ধারিত হয়। নির্ধারিত মাসের আগেই প্রতিযোগিতামূলকভাবে পাহাড় নির্ধারণ করা হয়। এরপর উপজাতি জুমিয়ারা বাঁশ, গাছ, ছন ও লতা-গুল্ম ভরপুর পাহাড়গুলোতে নির্বিচারে জ্বালিয়ে দেয় আগুন। একই স্থানে একবার জুম চাষ করলে সেখানে ৩-৪ বছরের মধ্যে আর কোনো শস্য উৎপাদন হয় না। তাই পাহাড়ের ১০টি উপজাতি গোষ্ঠী প্রতি বছর নতুন নতুন পাহাড়ে জুম চাষের জন্য শত’ বছরের পুরনো ও মূল্যবান সেগুন, গর্জন, গামারী, চাপালিশ, বড়ইসহ বিভিন্ন প্রজাতির ছোট বড় গাছ পুড়িয়ে ধ্বংস করে থাকে।
চাষের জন্য প্রথমে পাহাড়ের মূল্যবান গাছপালা কেটে ফেলা হয়, পরে প্রচন্ড রোদে শুকিয়ে গেলে আগুনে পোড়ানো হয়। এরপর পাহাড়ের মাটিগুলোকে কুপিয়ে চাষাবাদের জন্য জমি তৈরি করা হয়। এসময় গাছপালার শিকর পর্যন্ত তুলে ফেলতে হয়। বৃক্ষ শূন্য পাহাড়ে বৃষ্টি পড়ার সাথে সাথেই জমি জুম চাষের জন্য পাহাড় প্রস্তুত করে শুরু হয় জীবন ও জীবিকা নির্বাহের চাষাবাদ।
বর্তমানে পাহাড় কেটে অবৈধ ভাবে বাড়িঘর ও ইটের ভাটা নির্মাণ, ক্ষতিকারক তামাক চাষ করা হচ্ছে। জুম চাষ করার নামে লক্ষ লক্ষ টন কচি কচি মূল্যবান গাছগাছালি কেটে জ্বলানী কাঠ হিসেবে পোড়ানো হচ্ছে ইটভাটায়। বর্তমানে তিন পার্বত্য জেলার সবুজে শ্যামল উঁচু নিচু পাহাড়ের আগের সৌন্দর্য আর নেই। পাহাড়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করতে হলে কৃত্রিমভাবে বনায়ন করতে হবে- এমনটাই দাবি পরিবেশপ্রেমীদের।
রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি কৃষি বিভাগের মতে, প্রতি বছরের মত এবারও পার্বত্য অঞ্চলে পায় ৫০ হাজার একর পাহাড়ি জমিতে জুম চাষীরা অগ্নিসংযোগ করে জুম চাষের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর মধ্যে খাগড়াছড়িতে ১৭ হাজার একর পাহাড়ি জমিতে জুম চাষের প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন।

জুম চাষে পাহাড়ের মাটির সমস্যা :
জুম চাষ হলো পুরাতন পদ্ধতিতে চাষাবাদ যা আগের দিনে বেশিরভাগ আদিবাসীরা করতো। বর্তমানে ও অনেক জায়গায় জুম চাষ প্রচলিত আছে। জুম চাষ পদ্ধতিতে চাষ করার মানে একটা জায়গার জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে জঙ্গলটা পরিষ্কার করে ওই জায়গায় চাষবাস করা এবং চাষাবাদের পরে ওই জায়গাটা ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যাওয়া। যখন জঙ্গলে আগুন লাগানো হয় তখন অনেক উপকারী মাইক্রোঅর্গানিজমস মারা যায় যে মাইক্রোঅর্গানিজমস গুলি নিউট্রিয়েন্ট ট্রান্সফরমেশন এর জন্য দরকারি। এছাড়া জুম চাষের ফলে জমি নগ্ন হয়ে অথবা মাটির ওপরের আবরণ সরে যায় যা ভূমিক্ষয় এ সাহায্য করে। ভূমিক্ষয় এর ফলে মাটির নিউট্রিয়েন্ট অথবা উর্বর উপাদান এর ক্ষয় হয় এবং এক জায়গা থেকে সরে অন্য জায়গায় চলে যায় এর ফলে মাটির উর্বরতা নাশ হয়
এক সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম চাষই ছিল একমাত্র কৃষিব্যবস্থা। সে সময় লোক সংখ্যা কম থাকায় জুমের আবর্তনকাল ছিল দীর্ঘ। ফলে ফলনও হতো অত্যধিক। এক মৌসুমের ফসলে দেড়-দুই বছরের খোরাকি হয়ে যেত জুমিয়া পরিবারের। এ জুম চাষই ছিল এখানকার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবন-জীবিকার অন্যতম ক্ষেত্র এবং এ বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ‘ফুড ব্যাংক’ বা খাদ্যভান্ডার। শুধু তা-ই নয়, জুম চাষকে ঘিরে রয়েছে তাদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, আবেগ-আনন্দ, ধর্মীয় অনুভূতি। পার্বত্য চট্টগ্রামের (খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, রাঙামাটি) ১০টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রতিটি স¤প্রদায়ই জুম চাষ করে। তবে একেক উপজাতি ভিন্ন ভিন্ন নামে আখ্যায়িত করে তাদের ঐতিহ্যবাহী জুম চাষকে। যেমন চাকমা ভাষায় ঝুম, মারমা সম্প্রদায় ইয়াঁ, ত্রিপুরারা হুগ, ম্রো ভাষায় উঃঅ, খিয়াংরা লাই, বম ভাষায় লাও। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে শুধু নয়, বিশ্বের নানা দেশে নানান নামে জুম চাষের প্রচলন রয়েছে। জুম চাষের উৎপত্তি মূলত সুইডেন থেকে। ভারতের মেঘালয়, আসাম, অরুণাচল, নাগাল্যান্ড, মণিপুর ও ত্রিপুরা রাজ্যে জুম নামে, মিয়ানমারে টংয়া, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় লাডাং, আফ্রিকায় জান্তে, মধ্য আফ্রিকায় মিলপা, ব্রাজিলে রোকা, মধ্য ভারতে ধাইয়া ও পেন্দা নামে আখ্যায়িত করা হয় পাহাড়ের এ জুম চাষকে। জুমচাষিরা পৌষ-মাঘ মাসে পাহাড়ের ঢালে বন-জঙ্গল পরিষ্কার করে শুকানোর পর ফালগুন-চৈত্র মাসে সেসব জঙ্গল আগুনে পুড়িয়ে জুমের খেত তৈরি করেন।

পুরাতন জুমিয়াদের তথ্য ভান্ডার ও তখনকার জুম চাষ :
১৯৬১ সালে জুমিয়া পরিবারের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৯ হাজারেরও বেশি। ২০০৩ সালে প্রকাশিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম চাষ’ বইয়ে বলা হয়েছে, ২০০০ সালে তিন পার্বত্য জেলায় জুমিয়া পরিবারের সংখ্যা ছিল ৩০-৩৫ হাজার। রাঙামাটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ২০২০ সালের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়, তিন পার্বত্য জেলায় জুমিয়ার সংখ্যা ৪২ হাজার ৯৩৭ জন। এর মধ্যে রাঙামাটিতে ২৩ হাজার ৫০০, বান্দরবানে ১৫ হাজার ৪৮ ও খাগড়াছড়িতে ৪ হাজার ৩৯০। জুমিয়া পরিবারের সংখ্যা বাড়লেও কমেছে জুম ভ‚মি ও জুমের ফলন। একসময় একরে ধান উৎপাদন হতো প্রায় ২০-২৫ মণ। এতে চলে যেত জুমিয়া পরিবারের দেড়-দুই বছরের খোরাকি।
আর এখন আবহাওয়া অনুক‚লে থাকলে পাওয়া যায় একরে মাত্র ১০-১১ মণ ধান। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জুম ভূমির পরিমাণ কমে যাওয়া, জুমের আর্বতনকাল দুই-তিন বছরের মধ্যে চলে আসা। আগে এক পাহাড়ে একবার চাষ করার পর ১৫-১৬ বছর পর পুনরায় ঐ পাহাড়ে চাষ হতো। আর এখন দুই-তিন বছর পরই চাষ করতে হয় বাধ্য হয়ে। ঘনঘন চাষ করার কারণে ঊর্বরতা হারিয়ে গেছে পাহাড়ের। ফলে উৎপাদন অনেক কমে গেছে। ফলন কমে যাওয়ার আরেকটি কারণ জলবায়ুর পরিবর্তন। অনাবৃষ্টি ও অতিবৃষ্টির ফলেও জুমের হ্রাস পেয়েছে। ভূমি ও ফলন কমে যাওয়ার পাশাপাশি জুমিয়ারা এখন অনেক জাতের ধান ও সাথি ফসলের আবাদও ছেড়ে দিয়েছেন। আগে জুমে মুম্বই, কবরক, গেলং, রেঙ্গুই, গুড়ি চিনেল, পাট্রিকি, রাঙ্গাগেলন, সোনালি চিকনসহ বিভিন্ন প্রকারের আঠালো বিন্নি ধানের চাষ হতো।
এখন জুম ভ‚মি ও ফলন কমে যাওয়ায় এগুলোর চাষ হয় না বললেই চলে। জুন থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত জুমচাষিদের আপৎকালীন। একসময় এ আপৎকালীন খাদ্যসংকট মোকাবিলার জন্য জুমের নতুন ধান ঘরে তোলার পর সবাই মিলে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ধান সংরক্ষণ করে রাখত একটি ঘরে। খাদ্যসংকটে পড়লে সেখান থেকে ১০-৫০ হাঁড়ি পর্যন্ত ধান ধার নিতে পারত যে কেউ। পরের বছর জুমের ধান তোলার পর ১০ হাঁড়ির বিপরীতে ১৩ হাঁড়ি করে ধান শোধ করতে হতো। পরবর্তী সময় এ প্রথা কাজে লাগিয়ে গঠন করা হয় ‘রাইস ব্যাংক’। কিন্তু জুমের আবাদ কমে যাওয়ায় সেই রাইস ব্যাংকও বিলুপ্তির পথে। এখন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী এ জুম চাষ নিয়ে গবেষণাও চলছে। অবৈজ্ঞানিক সনাতনী পদ্ধতির পরিবর্তে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষ করার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে।
কৃষিবিদরা বলছেন, অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের ফলে মৃত্তিকা ক্ষয় হচ্ছে। এতে মাটি অনুর্বর হয়ে পড়ে এবং প্রকৃতির ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষ হলে জুমে উৎপাদন যেমন বাড়ানো সম্ভব, তেমনি পরিবেশ ও প্রকৃতিও সুরক্ষিত থাকবে।