জুনে পুরোদমে উৎপাদনে যাচ্ছে এসএস পাওয়ার প্ল্যান্ট

75

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাঁশখালীর গন্ডামারায় নির্মিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীর বিক্রম। গতকাল রবিবার দুপুরে বেসরকারি খাতের কয়লাভিত্তিক বৃহত্তম ১৩২০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিদর্শন করেন তিনি। বর্তমানে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ভৌত নির্মাণ কাজ শেষে কমিশনিং কার্যক্রম চলছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হলে ১২২৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করতে সক্ষম হবে। আগামী জুন মাসে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির পুরোদমে উৎপাদন শুরু হবে। এপ্রিল-মে মাসের মধ্যে এর দুটি ইউনিট উৎপাদনে যাবে। এখন অপেক্ষা আমদানিকৃত কয়লার জাহাজ পৌঁছার।
গতকাল বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিদর্শনে এসে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। এসময় তিনি বলেন,সরকার যাদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ নিবে সবগুলোর দাম একই থাকবে। সব কয়লা প্রকল্পের বিদ্যুতের সমান দাম হবে। একমাস আগে ধরলে কয়লার দাম একরকম ছিল, একমাস পরে হলে দাম অন্যরকম। বিদ্যুতে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। এটার একটা সীমা আছে। সাধারণ মানুষের কাছে যাদের বিদ্যুৎ তাদের জন্য লাইফলাইন ট্যারিফ আছে। তাদেরকেই বেশি টাকা দিতে হয়। আর অবস্থাপন্ন যারা আছেন তাদের এখন উৎপাদন খরচ দিতে হবে। উৎপাদন খরচের মধ্যে যেগুলোতে ফুয়েল আমদানি হয় সেগুলো আমাদের হাতে নেই। উৎপাদন খরচ দিতে হবে বলেই আমরা ধাপে ধাপে বিদ্যুতের দাম, গ্যাসের দাম বাড়াচ্ছি। যাতে আমাদের কোনো ভর্তুকি দেয়া না লাগে।
তিনি বলেন, এসএস পাওয়ার ব্যক্তিগত খাতে বড় একটা প্রকল্প। আড়াই বিলিয়ন ডলারের উপরের প্রকল্প। এটি বাংলাদেশের জন্য গর্বের ব্যাপার। সব প্রকল্প এক নয়। কয়লাভিত্তিক প্রকল্পে অনেক ম্যানেজমেন্ট চ্যালেঞ্জ আছে, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ আছে। সারা পৃথিবীতে কেউ কয়লার জন্য অর্থায়ন করতে চায় না। সেখানে উনারা কয়লার অর্থ জোগাড় করেছেন, চায়না ব্যাংকগুলো এগিয়ে এসেছে। আমি মনে করি এটি বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের বিরাট একটি অর্জন।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী পদমর্যাদার এই উপদেষ্টা বলেন, লোডশেডিং হয়ে যাবে, লোডশেডিং হচ্ছে এগুলো ধারণাপ্রসূত। উনারা (এসএস পাওয়ার) যত তাড়াতাড়ি বিদ্যুৎ দিতে পারবেন তত ঘাটতি কম হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম সহনশীল হলে বাংলাদেশে বিদ্যুতের অভাব থাকবে না। এলএনজির দাম সহনীয় হলে, ফুয়েলের দাম সহনীয় হলে, বিদ্যুতের ঘাটতি থাকবে না। আমাদের ২৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ক্যাপাসিটি আছে। লাগবে ১৬ হাজার মেগাওয়াট। পৃথিবী যদি যুদ্ধে মাতোয়ারা হয় তার খেসারত যদি আমাদের মতো দেশকে দিতে হয়, তাতে তো সরকারের কিছুই করার থাকে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেক দূরদর্শীতার সাথে এই সময়টা পার করে নিয়ে যাচ্ছেন। সবাইকে সমর্থন দিতে হবে।
বিশ্ব পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি বলেন, সারা পৃথিবীতে যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে। জ্বালানি ছাড়াও খাদ্যশস্য, ফার্টিলাইজার, ডলারের দাম বেড়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির জন্য আমাদের মতো দেশকে খেসারত দিতে হচ্ছে। কালকে যুদ্ধ বন্ধ হলে কোনো লোডশেডিং হবে না। যুদ্ধ না থামলে সবাইকে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী হতে হবে। নিজেদের প্রয়োজন কমিয়ে আনা সম্ভব হলে বিদ্যুৎ সমস্যা মোকাবেলা করা সম্ভব হবে।
বিদ্যুতের দাম প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, ফুয়েলের দাম যা হবে তার ভিত্তিতে বিদ্যুতের দাম ৭ টাকা হবে নাকি ১০ টাকা, নাকি ১২ টাকা হবে তা হিসেব করতে হয়। ১৪ টাকা তো একমাস আগে ছিল। এখন ৯ টাকার মধ্যে আছে। এরপরেও কিন্তু ৯ টাকা বলতে পারবেন না। কারণ যেদিন যেটি উৎপাদনে যাবে, সেসময় যে ফুয়েলের দাম পড়বে, সব একই দাম হবে।
তিনি বলেন, উৎপাদন শুরুর আগে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয় না। বিনিয়োগের ব্যয় দিতে হবে। রমজান মাসে চাহিদা উঠে যাবে ১৬ হাজার মেগাওয়াট। শীতকালে উঠবে ৯ হাজার মেগাওয়াট। আমাদের ১৬ হাজার মেগাওয়াটের জন্য তৈরি থাকতে হবে। সেটি সারাবছর ব্যবহৃত হবে না। এসএস পাওয়ার প্লান্ট ও মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে গেলে দেশের ক্যাপাসিটি দাঁড়াবে ৩০ হাজার মেগাওয়াট। ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে রিজার্ভ রাখতে হবে ১০ শতাংশ। মেরামতের জন্য ১০ শতাংশ রাখতে হবে। ক্যাপাসিটি থাকলে ২০ শতাংশ বাদ দিতে হবে।
কাপ্তাই বিদ্যুৎকেন্দ্র অযতেœ পড়ে থাকা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর এই উপদেষ্টা বলেন, কাপ্তাইয়ে ড্যাম করে ১০০-১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্য পুরো শহরকে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে। যেটি অন্যায় হয়েছিল। সেটিকে আমাদের সরকার সংশোধন করছে। আমাদের দেশ পানিবিদ্যুৎ উৎপাদনের জায়গা নয়। এটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা দরকার।
এস আলম গ্রæপের ভাইস চেয়ারম্যান ও এসএস পাওয়ার লিমিটেডের পরিচালক আব্দুস সামাদ লাভু বলেন, কয়লাভিত্তিক এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিবেশবান্ধব। আমরা কয়লা এনে এপ্রিলে বিদ্যুৎ দেয়ার চেষ্টা করছি। এপ্রিলের মধ্যে প্রথম ইউনিট, মে’র মধ্যে দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদনে যাবে। সবকিছু যদি ঠিক থাকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন সময় দিবেন তখন উদ্বোধন হবে। কয়লা মার্চের মধ্যে চলে আসবে। প্রথম চালান ইন্দোনেশিয়া থেকে আনা হবে। ১৫ বছর ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা আনার চুক্তি হয়েছে। কয়লা আনায়নে কোনো সমস্যা নেই। প্রথম চালানে ২০ হাজার টন ও পরবর্তীতে দুই লাখ টন কয়লা আসবে। বিকল্প দেশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়া কয়লা দিবে। এই দুই দেশের সাথে আমাদের কর্মী নিয়ন্ত্রণের চুক্তি আছে। কয়লার দাম পড়বে আন্তর্জাতিক হিসেবে। যখন যে দাম হবে সেভাবেই বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ হবে। বর্তমানে বিদ্যুতের দাম পড়বে ৯ টাকা।
তিনি বলেন, মার্চে যেহেতু কয়লা আনার চ্যানেল তৈরি করতে পারিনি সেজন্য এটি বিশ্লেষণ করেই এপ্রিলে নিয়ে গেছি। পুরোদমে দুইটা ইউনিটের সব কাজ জুনের মধ্যে শেষ করে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। সরকারের ৫-৬টি বিভাগ কাজ করছে। বিদ্যুৎ প্রথমে যাবে মদুনাঘাটে। সবকিছু একটি টিমওয়ার্ক করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সবার সাথে আলাপ করেই জুনের মধ্যে প্রকল্পটি উদ্বোধনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
এসময় অন্যান্যের মধ্যে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব মো. হাবিবুর রহমান, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান, চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান, এস আলম গ্রæপের পরিচালক শহিদুল আলম, বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক দীপংকর মজুমদার, মি. ওয়ান জিয়াং, মি. তানজিলিংসহ প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এসএস পাওয়ার ওয়ান লিমিটেড প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বাস্তবায়ন করছে। এই কোম্পানির ৭০ শতাংশ মালিকানায় রয়েছে দেশের খ্যাতনামা শিল্পগ্রæপ এস.আলম এবং চীনের সেপকো থ্রি। আগামীতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিচালন পর্যায়ে ব্যাপক কর্মসংস্থান হবে। বর্তমানে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কাজ করছে দেশি-বিদেশি প্রায় সাত হাজার লোক। বাস্তবায়ন শেষে প্রায় ১২০০ লোকের কর্মসংস্থান হবে এ প্রকল্পে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে। এতে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন তরান্বিত হবে।