জীবন বাঁচাতে জীবন সাজাতে চাই বৃক্ষ

34

এমরান চৌধুরী

বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। নিকট অতীতে বছরে ছয় ছয়টি ঋতুরই অপরূপ পালাবদল এদেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। উপভোগ করেছে এক এক ঋতুর বৈচিত্র্যময় রূপ। কবি নজরুল তাই লিখেছেন,
এ কি অপরূপ রূপে মা তোমার হেরিনু পল্লী জননী
ফুলে ও ফসলে কাদা মাটি জলে ঝলমল করে লাবনি\
রৌদ্রতপ্ত বৈশাখে তুমি চাতকের সাথে চাহ জল,
আম কাঁঠালের মধুর গন্ধে জৈষ্ঠ্যে মাতাও তরুতল।
ঝঞ্জার সাথে প্রান্তরে মাঠে কভূ খেল লয়ে অশনি \

কেতকী-কদম-যুথিকা- কুসুমে বর্ষায় গাঁথ মালিকা.
পথে অবিরল ছিটাইয়া জল খেল চঞ্চলা বালিকা।
তড়াগে পুকুরে থই থই করে শ্যামল শোভার নবনী \

শাপলা শালুক সাজাইয়া সাজি শরতে শিশির নাহিয়া,
শিউলি-ছোপানো শাড়ি পরে ফের আগমনী গীত গাহিয়া।
অঘ্রাণে মা গো আমন ধানের সুঘ্রাণে ভরে অবনি \

শীতের শূন্য মাঠে তুমি ফের উদাসী বাউল সাথে মা,
ভাটিয়ালি গাও মাঝিদের সাথে গো, কীর্তন শোনো রাতে মা।
ফাগুনে রাঙা ফুলের আবিরে রাঙাও নিখির ধরণী \

কিন্তু বাংলাদেশের সেই সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য এখন ইতিহাসের পাতায় স্থান নিয়েছে। এখন যদি কেউ গ্রীষ্মের দুপুরে গাছতলায় বসে গাছ থেকে ঠুস করে মাটিতে পড়া পাকা আম কুড়োতে চান, বর্ষার রাতে কাঁঠারচাঁপার গন্ধ শুঁকতে চান, শরতে কাশফুল খুঁজতে যান, হেমন্তে শিশিরে পা ছুঁয়ে পুলকিত হতে চান কিংবা শীতে গাছে বাঁধা রসের হাঁড়ি দেখতে চান আর বসন্তে শুনতে চান কোকিলের ডাক তাহলো তাকে বাংলাদেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ঘুরে বেড়াতে হবে। কেননা এ দৃশ্যগুলো এখন অনেকটাই হারিয়ে গেছে। শুধু তাই নয় ষড়ঋতুর অনেক ফুল,যার সৌন্দর্যে থমকে দাঁড়াত পথিক, অনেক ফল, যার গন্ধে জিভে জল আসত মানুষের, অনেক শাকসবজি, যা ছিল পুষ্টি ও রোগ প্রতিরোধের অনিবার্য উপাদান, কৃত্রিম ও দ্রæততম উৎপাদন প্রক্রিয়ার কাছে প্রকৃতির এ অনন্য উপহারগুলো আজ কুপোকাত।
কেন এই পরিবর্তন? এই ভারসাম্যহীনতা? কেন এই বদলে যাওয়া? রূপের জায়গার অরূপের ছড়াছড়ি? কারণ একটাই জলবায়ুর পরিবর্তন। তবে জলবায়ুর এই পরিবর্তনে শুধু আমাদের দেশ বা দেশের মানুষ নয়, সারা পৃথিবীর মানুষই আজ বিপন্ন। ধনী গরিব নির্বিশেষে পৃথিবীর সব দেশই আজ জলবায়ুর বৈরী আচরণে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও হুমকির সম্মুখিন। তবে বেশিরভাগ ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকির মুখে পৃথিবীর আয়তনের তুলনায় বেশি মানুষের দেশগুলো। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই সবচেয়ে কম আয়তনের দেশ। ১,৪৭,৫৭০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দেশটিতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ১ হাজার ১৫ জন মানুষ। পক্ষান্তরে আমাদের প্রতিবেশি দেশ ভারতের প্রতিবর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব মাত্র ৪ শত ৫৫ জন। ভারতের থেকে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় আড়াই গুণ বেশি মানুষের বাস বাংলাদেশে। জনসংখ্যার এই ঘনত্বের ভারে বাংলাদেশের যে কী অবস্থা তা সহজেই অনুমেয়। আমরা জানি, প্রত্যেক মানুষের বয়ে বেড়ানোর একটা ক্ষমতা আছে। তার অতিরিক্ত ভার যদি তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয় তাহলে তার গতি মন্থর কিংবা থেমে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এ অবস্থায় একজন মানুষের পক্ষে সময়ের কাজ সময়ে করা হয়ে ওঠে না। একইভাবে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে আমাদের দেশে যে ঋতু যে সময় আসার কথা সে সময়ে আসে না। হয়তো দেখা যায় বর্ষা আসার আগেই বর্ষাকাল শুরু হয়ে গেছে। অনেক সময় দেখা যায় আষাঢ়-শ্রাবণ মানে নাতো মন
ঝর ঝর শুধু ঝরছে
তোমাকেই মনে পড়ছে
এই গানের মধ্যেই বর্ষাকাল সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। প্রেমিকার আবেগের সেই বর্ষা এই বৃষ্টি ঝরা রাতে চলে যেও না’ বাস্তবে ধরা দেয় না। এভাবে বর্ষার সময় বর্ষা, শীতের সময় শীত না নামলে দেশে প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসা স্বাভাবিক।
পৃথিবীর যে কোনো দেশে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের একটি প্রধান কারণ বৃক্ষনিধন। নির্বিচারে গাছপালা কেটে বনভূমি উজাড় করা তথা গাছপালা কমে যাওয়া। উল্লেখ যে, একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। আজ থেকে শতবর্ষ আগে এ দেশে মোট আয়তনের এক তৃতীয়াংশ বনভূমি ছিল। বড় দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় নির্বিচারে গাছপালা কর্তন, এক শ্রেণির মানুষের অর্থলিপ্সা আর কাÐজ্ঞানহীন আচরণের প্রেক্ষিতে এই অমূল্য রতœ দিনে দিনে ঘ্রাস পাচ্ছে। ‘জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থা ( ঋঅঙ) ২০১৯ সালের জুলাই মাসে বন বিষয়ক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশে মোট ভূখÐের ১৩ শতাংশ বনভূমি। তবে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের মতে দেশের মোট আয়তনের ১৭ শতাংশ বনভূমি (বন ও বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা)। বনভূমি পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা গেøাবাল ফরেস্ট ওয়াচ ( জিএফও) এবং ওয়াল্ড রিসোর্স ইন্সটিটিউটের মতে গত সাত বছরে বাংলাদেশে ৩ লক্ষ ৩২ হাজার একর বনভূমি উজাড় হয়েছে। রোহিঙ্গা বসতি স্থাপনের জন্য ২০১৮ সালের প্রথম ছয় মাসে উখিয়া ও টেকনাফে উজাড় হয়েছে ৫ হাজার একর বনভূমি( সূত্র : প্রথম আলো অনলাইন)। এভাবে বনভূমি উজাড় হতে থাকলে, গাছ না লাগিয়ে অবাধে গাছ কাটা অব্যাহত থাকলে সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন আমাদের বনভূমির পরিমাণ হবে ২/৩ শতাংশ।
আমরা জানি, মানব জীবনে বৃক্ষের মতো উপকারী বন্ধু আর দ্বিতীয়টি নেই। ফুল যেমন নিজের জন্য ফোটে না, বৃক্ষও তেমনি। বৃক্ষ সৃষ্টির সেরা জীব মানুষকে ক্ষুধা নিবারণে খাদ্যের যোগান দেয়, প্রখর রৌদ্রে ছায়া দেয়, বন্যপ্রাণি আর ঝড়-বৃষ্টি থেকে বাঁচতে আশ্রয়ের উপকরণ দেয় সর্বোপরি মানুষের বেঁচে থাকার অপরিহার্য উপাদান অক্সিজেন সরবরাহ করে। এক কথায় জীবন বাঁচাতে আর জীবন সাজাতে বৃক্ষের কোনো তুলনা নেই। কারণ প্রাণি মাত্রই অক্সিজেন ছাড়া বাঁচতে পারে না। খাবার ছাড়া মানুষ দু’চার সপ্তাহ বেঁচে থাকতে পারে, কিন্তু অক্সিজেন ছাড়া এক মিনিটও বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। একটি পূর্ণ বয়স্ক বৃক্ষ বছরে যে পরিমাণ অক্সিজেন সরবরাহ করে, তা কমপক্ষে ১০ জন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের বার্ষিক অক্সিজেনের চাহিদা মিটায়। আমরা আমাদের শ্বাসক্রিয়ায় অক্সিজেন গ্রহণ করি আর ত্যাগ করি কার্বন ডাই অক্সাইড। এই কার্বন ডাই অক্সাইড মানব শরীরের জন্য একটি মহা ক্ষতিকর উপাদান। যদি বৃক্ষ না থাকত তাহলে সমস্ত বায়ুমÐল কার্বন ডাই অক্সাইডে ভরে যেত। ফলে অভাব হতো অক্সিজেনের। আর অক্সিজেনের অভাব মানে প্রাণের বিলোপ। বৃক্ষ আমাদের ছেড়ে দেওয়া কার্বন ডাই অক্সাইড শুষে নেয়। আর বাতাসে যোগান দেয় অবিরাম অক্সিজেন। ফলে বিষাক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড দূরীভূত হয় এবং প্রকৃতিতে বিদ্যমান থাকে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন। শুধু তাই নয়, একটি পূর্ন বয়স্ক বৃক্ষের অর্থনৈতিক মূল্য রীতিমত চমকে ওঠার মতো। ভারতের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টি এম দাস ১৯৭৯ সালে পূর্ণ বয়স্ক একটি বৃক্ষের অবদান বিবেচনা করে দেখান যে, ৫০ বছর বয়সী একটি বৃক্ষের অর্থনৈতিক মূল্য প্রায় ১ লক্ষ ৮৮ হাজার মার্কিন ডলার।
পৃথিবীর সমস্ত প্রাণিজগৎ বৃক্ষের ওপর নির্ভরশীল। বৃক্ষ তাদের খাদ্যের যোগান দিয়ে পৃথিবীর আলো বাতাসে বিচরণ করার সুযোগ করে দিচ্ছে। পৃথিবীর কোনো প্রাণিই শর্করা জাতীয় খাদ্য ছাড়া বাঁচতে পারে না। শর্করা ভেঙে শক্তি উৎপন্ন হয়, তার সাহায্যে আমরা চলাফেরা করি। এক বিশেষ পদ্ধতিতে সূর্যের আলোকে কাজে লাগিয়ে বৃক্ষ এই খাদ্য উৎপাদন করে। এই খাদ্য উৎপাদনে প্রয়োজন হয় ক্লোরোফিল নামের এক ধরনের সবুজ জিনিস। আর এই সবুজ জিনিস থাকে গাছের সবুজ পাতায়। পৃথিবীতে যদি বৃক্ষ না থাকত সেই কবে প্রাণিজগৎ বিলুপ্ত হয়ে যেত। শুধু তাই নয়, বৃক্ষ পৃথিবীকে নানাভাবে বসবাসের উপযোগী করে রেখেছে। যেখানে বৃক্ষ নেই, সেখানে সৃষ্টি হয় মরুভূমির। আর মরুভূমিতে বসবাস যে কত দুর্ভোগ আর কষ্টের তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তাই আসুন বৃক্ষরোপণ করি, বছরের যে কোনো সময় বৃক্ষরোপণ করা গেলেও বর্ষাকালই গাছ লাগানোর উত্তম সময়। কেন বৃক্ষরোপণ করব? করব নিজের ও পরিবারের জন্য। মনে রাখতে হবে আজকের চারা গাছ ভবিষ্যতের একটি বিশাল বিনিয়োগ, পরিবারের জন্য বীমা ও নিরাপত্তার প্রতীক। সমাজকে সুন্দর তথা ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্যে একটি সুন্দর ও বাসযোগ্য, নিরোগ পৃথিবী নির্মাণের জন্য আমাদের সবাইকে গাছ লাগাতে হবে। গাছ শুধু পরিবেশের সৌন্দর্য বৃদ্ধিই করে না, পাশাপাশি নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহ ও কার্বন ডাই-অক্সাইড চুষে নিয়ে পরিবেশকে করে তোলে সতেজ ও সজীব। তাছাড়া বৃক্ষরোপণ সওয়াবের কাজ। মহাগ্রন্থ পবিত্র আল কোরআনসহ সকল ধর্মগ্রন্থে বিষয়টির প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। পবিত্র আল কোরআনের সুরা সাজদা এর ২৭ সংখ্যক আয়াতে পরম করুণাময় আল্লাহপাক বলেছেন, ‘তারা কি লক্ষ্য করে না, আমি উষর ভূমির ওপর পানি প্রবাহিত করে তার সাহায্যে উদগত করি শস্য, যা থেকে তাদের গবাদি পশু এবং তারা নিজেরা আহার গ্রহণ করে’। হাদিস শরীফেও বৃক্ষরোপণে উৎসাহ ও তাগিদ দিয়ে বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো মুসলমান একটি বৃক্ষরোপণ করে অথবা কোনো শস্য উৎপাদন করে এবং তা থেকে কোনো মানুষ কিংবা পাখি অথবা পশু ভক্ষণ করে, তবে তা উৎপাদনকারীর জন্য সদকা (দান) স্বরূপ গণ্য হবে’। (বুখারি, হাদিস ২৩২০) অর্থাৎ বৃক্ষের ফল যতদিন পর্যন্ত মানুষ বা পশুপাখি খাবে, ততদিন পর্যন্ত বৃক্ষরোপণকারীর সওয়াব জমা হতে থাকে আল্লাহর দরবারে। বৃক্ষের সবুজ শোভা শুধু সৌন্দর্যই বর্ধন করে না মানুষের স্বাস্থ্য ও চরিত্রে প্রভাব ফেলে। ফলে মানুষ পরস্পরের প্রতি দয়াশীল হয়। ভালোবাসতে শেখে।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক