জীবনকে অমূল্য ভেবে নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে যেতে কী করণীয়

16

পারভীন আকতার

জগতে যে যার জায়গায় শ্রেষ্ঠ হতে কে না চায়? ধন সম্পদের শ্রেষ্ঠত্বের দৌড়ে নয় বরং একজন ভালো মানুষ হওয়া তার চেয়ে বেশি জরুরি। কথায় আছে, ‘আপন ভালো তো জগত ভালো।’ আমাদের ক্ষণে ক্ষণে কত শত চাহিদা নিত্য নতুন যোগ হয়। কিন্তু ভালো মানুষ হওয়ার গুণাবলি অর্জনে আমরা কেন জানি এখনো পরিপুষ্ট ভাবনায় পিছিয়ে। কয় দিনের দুনিয়া এটা? একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিয়েই আমাদের পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে। এরপর নিঃশ্বাস বন্ধ হবে চিরতরে। ভাবা যায় এসব আগাম জানা সত্তে¡ও পৃথিবীতে আমরা কত না দাপট দেখিয়ে বেড়াই! ক্ষমতার জৌলুস দেখাতে আমাদের কাটতি কম নাই।
উইলিয়াম শেক্সপিয়ার বলেছেন, ‘অভাব যখন দরজায় এসে দাঁড়ায় ভালোবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়। আর আমাদের বাংলার কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্য তার একটি কবিতায় লিখেছেন, ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় আর পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।’ এসব উক্তি আমি মনে করি তাঁদের জীবনের ব্যক্তিগত ও সামগ্রিক কঠিন সংগ্রামের অভিধা থেকে অনুভব করা ন্যায্য ও খাঁটি কথা। অনেকেই ভাবেন কেবল প্রেমিক প্রেমিকার প্রেমের ধরণ বুঝাতে মনিষীগণ এসব বলে গেছেন। কিন্তু তা একেবারেই ভুল কথা।
সংসারের অভাব অনটনে মা, বাবাকে ছেড়ে চলে যায়, সন্তান মাতৃহীন হয়। ছন্নছাড়া হয়ে পড়ে পুরো পরিবার। এসব ভাবনায় আনতে হয় যে বর্তমান অতি গতির দৌড়ঝাঁপের জীবনে নতুন প্রজন্মকে। এসব বাস্তব চিত্র অবলোকন করে কী সিদ্ধান্ত নেবে তারস জীবন নিয়ে? তারা বসে বসে পার্কের আড়ালে আবডালে প্রেম করবে, মা বাবার কষ্টার্জিত অর্থ কড়ি নষ্ট করে হেলায় জীবনাচরণ করবে নাকি জীবন নিয়ে গঠন মূলক কিছু ভেবে সেই অনুপাতে এগিয়ে যাবে তাদের তা ভাবনার সময় এসেছে এখন। কারণ সামনের যে ভবিষ্যৎ সময় আসছে তা আরো ভয়াবহ ও কঠিনতর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে বর্তমান এই প্রজন্মকে।
ধীরে ধীরে উতপ্ত হচ্ছে পৃথিবী। জলবায়ু পরিবর্তনের মহাসমারোহ শুরু হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই। পৃথিবীর কোথাও কঠিন তাপ আবার কোথাও প্রবল বৃষ্টিতে ঘর, বাড়ি, গাড়ি, প্রকৃতির নানা উপকারী উপাদান ও জানমাল ভেসে যাচ্ছে। এখন এই পরিস্থিতিতে পৃথিবীর সমস্ত কিছুর আমূল-পরিবর্তন হবে। এ নিয়ে বর্তমান প্রজন্মের ভাবা উচিত। এড়িয়ে গিয়ে বন্ধুবান্ধব নিয়ে হৈহুল্লোড় করে জীবন কাটিয়ে দিলেই সবকিছুর সমাধা হবে না। শিক্ষা দীক্ষা, উন্নয়ন ও দক্ষতা নির্ভর পেশাদার মনোভাব নিয়ে নূতন প্রজন্মকে ভাবতেই হবে। কেউ কেউ বলতে শুনি, ‘কপাল গুণে এমন পরিবার, মা বাবা পেয়েছি। তাঁরা আমাদের কোন অভাব রাখেন না। নিজের সর্বস্ব দিয়ে আমাদের প্রকৃত মানুষ গড়ার চেষ্টা করছেন।’ কিন্তু কয়দিন মা বাবার কষ্টার্জিত অর্থ ও প্রতিপত্তি নিয়ে চলবে বর্তমান প্রজন্ম। আর সবার কপালে তো অর্থবান ও ক্ষমতাশালী মা বাবা, মামা খালুর জোর নেই।
আজকাল মোবাইল ইন্টারনেটে যে পরিমাণ বর্তমান প্রজন্ম সময় ও শ্রম নষ্ট করছে তা যদি পড়াশোনা, বৃত্তিমূলক কাজে ব্যয় করত তাহলে এমন বিষম পৃথিবীর রোষানল হতে হয়তো কিছুটা পরিত্রাণের পথ নিজেরাই খুঁজে পেতো। বর্তমান এই প্রজন্ম যেন হাওয়ায় ভেসে ছোট্ট মোবাইলের পর্দাকেই শেষ সফল স্বপ্ন ভেবে বসে আছে। এসব তো একসময় বন্ধ হয়ে যাবে।পৃথিবী তার আদি রূপে ফিরবে তখন কী হবে এই প্রজন্মের? তাই এখনই দরকার সঠিক পথে চলার রাস্তা খোঁজা। কাদা মাটির গড়নে প্রকৃত রূপ দেয়া। পৃথিবীর আকাশ মাটি ছুঁয়ে দেখা সবারই দায়িত্ব। দুনিয়াতে সফল মানুষের পাশে সবাই থাকে। অসফল মানুষের জীবনে থাকে কেবল অবহেলা, নিন্দেমন্দ কথা আর কুচক্রীদের দৌরাত্ম্য।
একমাত্র নৈতিকতার পথে চলে সঠিক উপলব্ধির মাধ্যমে জীবনে চলতে হয়। এর জন্য দরকার কঠোর সাধনা ও পরিশ্রম। পেটের ক্ষুধা মিটে খাবারে আর মনের ক্ষুধা মিটে মানুষের ভালোবাসা, মায়া আর সফলতার শান্তির বাস্তব মহৎ অনুভবে। মানুষকে এগিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে যেতে হবে অবশ্যই এবং তা হতে হবে নিঃস্বার্থ ও পরোপকারী মনোভাব নিয়ে। জীবনে ভুল হবেই, অতীত যথেষ্ট খারাপ গেছে তাই বলে ওটা নিয়ে ভেবে অযথা সময় নষ্ট করা যাবে না। মনে রাখতে হবে মানুষের বর্তমানটাই আসল। আজ যে কর্ম ও ভাবনাগুলো আমরা করে যাই আর সেই মতে চলব আগামীতে। তখন তা হবে ভবিষ্যৎ ও সাথে ফেলে আসা অতীত। আমাদের গঠনমূলক কাজেই মনোযোগী হতে হবে। কারোর উপর ভরসা করা চলবে না। আর বিশ্বাস করে নিজেকে অন্যের উপর ছেড়েও দেয়া যাবে কোনভাবেই। নিজের পৃথিবী নিজেরই সুন্দর সাজানো গুছানোর জন্য নিজেকেই দায়িত্ব নিতে হবে। কাজের প্রতি কমিটমেন্ট থাকতে হবে আমাদের।
বর্তমান প্রজন্মের উচিত চলমান নকল স্রোতে ভেসে না গিয়ে আত্ম চেতনার স্রোতে ভাসা। আত্মোন্নতির জন্য সময় নষ্ট না করে জ্ঞান বিজ্ঞান, অর্থনৈতিক, ইতিহাস ঐতিহ্যের পথে হাঁটা। মানুষ বাঁচে তার কর্মে। হাড় মাংসতো মরলে মাটিই খেয়ে নেবে। তাই ছোট্ট এই জীবনটা সফলভাবে ও আনন্দগণভাবে পরিবার পরিজন এবং সমাজ সংস্কৃতির বাহনে নীতি নৈতিকতায় থেকে উপভোগ্য করে তুলতে হবে। হিংসা, দলাদলি আর উশৃংখলতা থেকে নিজেদের দূরে রাখতে হবে। জীবনটা খুবই ছোট। তাই যতটা সম্ভব অসৎ ভাবনা, অপরিকল্পিত উশৃংখল চলাফেরা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখাই শ্রেয়। সময়ের সৎ ব্যবহার করা আমাদের নৈতিক দায়িত্বও বটে। বতর্মান প্রজন্মের প্রতি সদা আহ্বান, তোমরা ভালো পথে সুষ্ঠু পরিকল্পনায় এগিয়ে যাও। এতেই মিলবে মুক্তির পথ ও শান্তি। সফলতার চাবিকাঠি কেবল প্রচেষ্টা, শ্রম আর সাধনায় আনায়ন হয়। জীবনকে সুন্দর ও মসৃণ করতে কোন ঠকানোর হোঁচট খাওয়ার ছক তৈরি করা যাবেই না। একবার না পারিলে দেখো শতবার। হাল ছেড়ে দেয়া যাবে না কোনমতেই।
পরীক্ষায় গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ পাওয়াই জীবনের সব সফলতা নয়। নৈতিক পন্থায় পাসের খাতায় নাম লিখিয়ে তাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে ভালো মানুষ হওয়ার প্রচেষ্টা করতে করতে একদিন লক্ষ্যে ঠিকই পৌঁছে যাবে তোমরা নূতন ও বর্তমান প্রজন্ম। কথায় আছে, ‘গেছে দিন ভাল আর আসছে দিন খারাপ।’ তার মোকাবেলা করার জন্য এখনই সময় কঠোর সাধনা করে নিজেদের অবিচল রেখে এগিয়ে যাওয়া। বর্তমান মেধাবী প্রজন্ম আশা করি সময়ের সৎ ব্যবহারে অন্যথা করবে না। তোমরা বিশাল আকাশের পানে তাকাও, চিন্তাকে সমৃদ্ধ করো আর মনিষীদের জীবনী পড়ে যথাযথ শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যাও। বাস্তবতাকে চোখ মেলে দেখো, কল্পনার পথে হেঁটো না। নিজেকে নিজেই এগিয়ে নেয়ার শক্তি সঞ্চয় করো।
লেখক: শিক্ষক, কবি ও প্রাবন্ধিক