জি-২০সম্মেলনে বিশ্ব বাণিজ্য যুদ্ধই ছিল প্রবল

46

১৯৫২ সালের পর থেকে বিশ্ব দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। বিশ্ব রাজনীতি ব্লক নির্ভর হয়ে পড়েছিল। সোভিয়েট ব্লক আর আমেরিকার ব্লকে বিশ্ব দ্বিধা বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু, মিশরের প্রেসিডেন্ট, জামাল আব্দুল নাসের, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুকার্ণু এবং যুগো স্লোভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো সহ আরও বেশ তৃতীয় বিশ্বের কিছু দেশের সমন্বয়ে একটি জোট গঠন করেন যাকে তখন জোট নিরপেক্ষ বা ঘড়হ-অষরমহবফ জোট বলে আখ্যায়িত করা হতো। তাঁদের ঘোষণা ছিল আমেরিকা বা সোভিয়েট রাশিয়ার সাথে জোট বদ্ধ না হয়ে বিশ্ব-রাজনীতিতে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবেন এবং বিশ্ব শান্তির জন্য কাজ করে যাবেন। কিন্তু তখনও দেখা যেত জোট নিরপেক্ষ অনেক দেশ রাশিয়ার প্রতি দুর্বল ছিল। কারণ হিসেবে তারা বলতেন সোভিয়েট রাশিয়া বিশ্বের সর্বহারাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে আর যুক্তরাষ্ট্র পুঁজিবাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে। এইভাবে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত বিশ্ব ব্যবস্থা চলে আসছিল। ১৯৯২ সালে সোভিয়েট ইউনিয়ন ভেঙ্গে শুধু রাশিয়ায় পরিণত হয়। ১৯৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ঐতিহাসিক চীন সফর অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
বিশ্বের ইতিহাসে এরকম ফলপ্রসু সফর কদাচিৎ দেখা যায়। এই সফরের পর থেকে চীনের জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ বিশেষ করে চীনের জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য পদ লাভ এবং সাথে সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্যের দ্বার খুলে যাওয়া সব এক সাথে ঘটতে থাকে। এর পর থেকে চীনকে আর পিছনের দিকে থাকাতে হয় নাই। মাত্র ৪৮ বৎসরের মধ্যে চীন বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী এবং বিশ্বের অন্যতম সামরিক পরাশক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে আমেরিকার এবং চীনের মধ্যে সম্পর্ক বিশেষ করে বাণিজ্য সম্পর্কের টানাপোড়ন শুরু হয়।
বর্তমানে তাদের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ চলছে। এই বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে সারা বিশ্বই আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। বিশ্বের দুই পরাশক্তি সৃষ্ট এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে জি-২০ এর অন্তর্ভুক্ত দেশ সমূহের শীর্ষ সম্মেলন জাপানের ওসাকায় জুন মাসের ২৮-২৯ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল।
১৯৯৯ সালে বিশ্বের সবচাইতে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত এবং সামরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী দেশসমূহ এবং দ্রুত উন্নয়নশীল রাষ্ট্র সমূহের সমন্বয়ে জি-২০ গঠন করা হয়েছিল। জি-২০ এর সম্মিলিত জি.ডি.পি. হল সারা বিশ্বের প্রায় ৮৫ শতাংশ, আর সারা বিশ্বের প্রায় ৭৫ শতাংশ এই দেশগুলি নিয়ন্ত্রণ করে এবং জি-২০ এর দেশগুলিতে বিশ্বের সর্বমোট জনসংখ্যার ৬৫ ভাগ বাস করে।
দুইদিনব্যাপী অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে চলমান বাণিজ্য যুদ্ধ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। চলমান এই বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে বিশ্ব বাণিজ্যে যে উত্তেজনা এবং অস্থিরতা চলছে এবং এর ফলে বিশ্ব অর্থনীতি যে সাময়িক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে তা নিয়ে সম্মেলনে যোগদানকারী প্রত্যেক দেশের প্রতিনিধিরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট জন ক্লাউড এই বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে বিশ্ব অর্থনীতি যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা বিস্তারিতভাবে সম্মলনে উপস্থাপন করেন। এই বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে শক্তিধর দেশগুলির মধ্যে বাণিজ্য ছাড়াও নিজ নিজ দেশের সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আন্তর্জাতিক সমস্যাবলিও মাথা ছাড়া দিয়ে উঠেছে এবং তাতে বিশ্ব শান্তি বিঘিœত হওয়ার প্রবল সম্ভবনা দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যেই আমেরিকায় আমদানীকৃত চীনা পণ্যের উপর ২৫০ বিলিয়ন ডলারের মত শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়ে তা কার্যকর করা হয়েছে এবং চীনা পণ্যের উপর আরো ৩৫০ বিলিয়ন ডলারের মত শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়েছে। এই পদক্ষেপ নিলে আমেরিকায় আমদানীকৃত সমস্ত চীনা পণ্য শুল্কের আওতায় চলে আসবে।
ইতিমধ্যে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায় জড়িত কোম্পানীগুলি বিলিয়ন, বিলিয়ন ডলার লোকসান দিয়েছে। সম্প্রতি আই.এম.এফ এর এক সমীক্ষায় দেখা যায়, যে উভয় দেশের মধ্যে এই বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে ২০২০ সালে বিশ্বের জি.ডি.পি. ০.৫ শতাংশ কমে যাবে। জাপানে অনুষ্ঠিত জি-২০সম্মেলনের ফাঁকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এবং চীনের প্রেসিডেন্টের মধ্যে বেশ কয়েক দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। সে বৈঠকে বাণিজ্য যুদ্ধ আপাততঃ স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। উভয় রাষ্ট্র আরও পণ্যের উপর শুল্ক আরোপ করার যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিল তাও স্থগিত রাখার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চীনের সাথে বাণিজ্য আলোচনা শুরু করার ঘোষনা নিজেই দিয়েছেন। তিনি চীনের সাখে বাণিজ্যের ব্যাপারে একটি সমঝোতায় পৌঁছা গড়হঁসবহঃধষ বলে নিজেই ঘোষণা করেছেন। চীন এবং আমেরিকার মধ্যে পুনঃবার আলোচনা শুরু করার সিদ্ধান্তই জি-২০ সম্মেলনের সব চাইতে বড় সাফল্য বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
জাপানের প্রধানমন্ত্রী শীন জো আবে তাঁর বক্তৃতায় বিশ্ব শান্তি এবং উন্নয়নের জন্য বিশ্বে মুক্ত অর্থনীতির প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। চীনের প্রেসিডেন্ট ও একইভাবে তাঁর বক্তৃতায় গঁষঃরষধঃবৎধষরংস এবং মুক্ত বিশ্ব বাণিজ্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি ইতিমধ্যেই চীনের বাজার বিশ্বের উদ্যোক্তাদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি উন্ম্ক্তু বিশ্ব বাণিজ্য এবং উন্মুক্ত অর্থনীতির উপর জোর দেন।
বিদেশি উদ্যোক্তাদের জন্য চীনে বিনিয়োগের জন নূতন নূতন সুযোগ সুবিধা দেওয়ার কথা তিনি ঘোষণা করেন। আগে যে সব ক্ষেত্রে চীনে বিদেশী বিনিয়োগ নিষিদ্ধ ছিল, সে সব ক্ষেত্রে চীন নিষেধাজ্ঞা দ্রুত প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। যেমন বর্তমানে গ্যাস অনুসন্ধান ও কৃষিতেও বিদেশি বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে অথচ অল্প কিছুদিন আগেও এই সব ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল।
জি-২০ দেশগুলি বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রশমনের জন্যও যথেষ্ট প্রয়াস চালিয়েছেন। বিশেষভাবে মধ্য-প্রাচ্যে আমেরিকা এবং ইরানের মধ্যে উত্তেজনা প্রশমনের জন্য যথেষ্ট কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো হয়েছে। জি-২০ নেতৃবৃন্দ ইরান এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি উদাত্ত আহব্বান জানিয়েছেন। তারা যেন আলাপ আলোচনার মাধ্যমে পারস্পরিক সমস্যাবলি সামাধান করেন। জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরানের মধ্যে সৃষ্ট উত্তেজনা প্রশমনে সবার সহযোগিতা কামনা করেছেন।
বিশ্বের আবহাওয়া চুক্তি বাস্তবায়নে সর্বপ্রকার পদক্ষেপ নিয়ে জি-২০ এর সদস্যের মধ্যে বিস্তারিত এবং গঠনমূলক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কেও বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত প্যারিস আবহাওয়া চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যাপারে শুধু যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্যান্য দেশ সমূহ ভবিষ্যতে করণীয় সম্পর্কে বাস্তবমুখী অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের বাণিজ্য যুদ্ধের ব্যাপারে তাৎক্ষণিক কোন সামাধান করা না গেলেও, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে উত্তেজনার ব্যাপারে কোন ফলপ্রসু ব্যবস্থা করা না গেলেও, বিশ্বের অন্যান্য সমস্যাবলি এবং সেসবের সমাধানের ব্যাপারে জি-২০ সম্মেলন মোটামুটি একটি সফল আলোচনা এবং গঠনমূলক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়েছে।

লেখক : কলামিস্ট