জিহাদ কী ও কেন

13

ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী

মহান আল্লাহর মনোনীত ধর্ম ইসলামে জিহাদের গুরুত্ব ব্যাপক। ‘জিহাদ’ শব্দটি শুনলে আজ মানুষ ভয় পায়। জিহাদের কথা শুনলে শুধু অমুসলিমদের মাঝে নয় মুসলমানদের কাছেও ভীতির সঞ্চার করে। অধিকাংশ মানুষ মনে করেন যে, ‘জিহাদ মানে যুদ্ধ আর যুদ্ধ মানেই লাশ আর মৃত্যুর মিছিল। অথচ যে কোন বিষয়ে যুদ্ধ করলে সেটাকে জিহাদ বলা যায় না। জিহাদ শব্দটি আরবী ‘জাহাদাহ’ থেকে এসেছে। আভিধানিক অর্থ চেস্টা করা, উদ্যমী হওয়া। ইসলামের পরিভাষায় ‘জিহাদ’ অর্থ কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করতঃ সংগ্রাম করা। যুদ্ধ ক্ষেত্রে আত্মরক্ষাকেও জিহাদ বলে। কোন মানুষ সফলতার জন্য অবিরাম চেষ্টাকে আরবীতে বলা হয় লোকটি জিহাদ করছে। কোন কাজ সর্বশক্তি দিয়ে সাধনা করা সেটাকে জিহাদ বলে।
আমাদের দেশের মানুষের ধারণা শুধু মুসলমান সম্প্রদায়ই জিহাদ করে। সত্যি হলো অমুসলিমরাও জিহাদ করে থাকেন। সেটা আমার কথা নয়, আল্লাহর মহান বাণী পবিত্র কোরআনে কথা। আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ‘যারা ঈমান এনেছেন তারা আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করে এবং যারা কুফুরী করেছে তারা তাগুতের পথে সংগ্রাম করে। সুতরাং শয়তানের সাথীদের বিরুদ্ধে তোমরা সংগ্রাম কর। (সূরা নিসা, আয়াত : ৭৬)
এখানে বলা হয়েছে শুধু মুসলমান নয় অমুসলিমরাও জিহাদ করে। জিহাদ দুই প্রকার। ভালোর জন্য সংগ্রাম আর খারাপ কিছুর জন্য সংগ্রাম করা। ন্যায়সম্মত যে সংগ্রাম করা হয় তাকে বলা হয় ‘জিহাদে ফি সাবিলিল্লাহ’ আল্লাহর পথে সংগ্রাম আর মন্দ কিছুর জন্য সংগ্রামকে বলা হয় ‘জিহাদে ফি সাবিলিস শয়তান’ বা শয়তানের পথে সংগ্রাম করা।
জিহাদ মানে পবিত্র যুদ্ধ নয়। পবিত্র কোরআনে কোথাও ‘পবিত্র যুদ্ধ’ কথাটা নেই। সহীহ কোন হাদিসেও ‘পবিত্র যুদ্ধ’র কথা উল্লেখ নেই। ‘পবিত্র যুদ্ধ’ কথাটার প্রবর্তক পশ্চিমা লেখকরা। দুর্ভাগ্য এই যে আজ মুসলমান লেখকগণও ‘পবিত্র যুদ্ধ’ কথা লেখা শুধু করেছেন।
পবিত্র কোরআনে ‘কিতাল’ শব্দটি যুদ্ধ ও হত্যা করা অর্থে ব্যবহৃত হলেও জিহাদের কথা বহুভাবে বর্ণিত হয়েছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক ঘোষণা করেছেন এবং আল্লাহর পথে প্রচেষ্টা করো, যে ভাবে করা উচিত’। (সূরা হজ্জ : আয়াত : ৭৮)
পবিত্র কোরআনে আরো ইরশাদ হয়েছে এবং যে ব্যক্তি জিহাদ করে সে নিজের জন্যই করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক কারো মুখাপেক্ষী নন। (সূরা আনকাবুত : আয়াত : ৬)
এখানে পবিত্র কোরআনের বর্ণনা দ্বারা আত্মস্থ হয় যে, কেউ যদি আল্লাহর রাস্তায় চেষ্টা করে সে নিজের জন্যই করে। তা আল্লাহর জন্য নয়।
মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) জিজ্ঞাসা করলেন, আমার কি জিহাদে যাওয়া প্রয়োজন ? তিনি বললেন, তোমার জন্য সর্বোত্তম জিহাদ হলো একটি নির্ভুল হজ্ব। (সহীহ বোখারী)।
অন্য এক হাদিসে বর্ণনা আছে, এক লোক মহানবী (দ.) এর কাছে হাজির হয়ে বললো, আমাকে জিহাদে যেতে হবে ?
প্রিয় নবী (দ.) জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার কি বাবা-মা আছে ? সে বললো, ‘হ্যা’। মহানবী (দ.) বললেন, তোমার জন্য সর্বোত্তম জিহাদ হলো তাদের সেবা করা। (বোখারী শরীফ)
হাদিসে আরো ইরশাদ হয়েছে ‘আল মোজাহেদু মিন জিহাদীস্ সাইয়াত’ অর্থাৎ মন্দ কাজ হতে বিরত যিনি থাকেন তিনি মোজাহিদ (জিহাদকারী)।
আরেকটি হাদিসে উল্লেখ আছে, ‘আল মোজাহেদু মিন জিহাদীন্ নাফস’ যিনি নিজের নফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন তিনি জিহাদকারী। তাবুকে যুদ্ধে মুসলমান পক্ষ বিজয়ী হয়েছিলেন। যুদ্ধ হতে ফেরার পথে প্রিয় নবী (দ.) বললেন, ‘আমরা ছোট যুদ্ধ হতে বড় যুদ্ধের দিকে ফেরত যাচ্ছি’।
বিজয়ী যুদ্ধকে তিনি বড় যুদ্ধ বলেননি। কারণ যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করা ২ মিনিটের ব্যাপার কিন্তু সারা জীবন নফসের সাথে যুদ্ধ করে পরিশুদ্ধ জীবন চলা এক কঠিন কাজ। সেটাকেই প্রিয় নবী (দ.) বলেছেন বড় যুদ্ধ। মানুষ পরিশুদ্ধ না হলে মানুষ কর্তৃক কোন যুদ্ধই পরিশুদ্ধ হতে পারে না।
ইসলামের একটি শ্রেষ্ঠ জিহাদ হলো সত্যের বাণী, ইসলামের বাণী যেখানে পৌঁছেনি সেখানে পৌঁছিয়ে দেওয়া। অমুসলিমদের নিকট ইসলামের দাওয়াত প্রদান করা। অনেকে জিহাদের নামে অমুসলিম শূন্য রাষ্ট্র করতে চায়। রাষ্ট্র যদি অমুসলিম শূন্য হয় তাহলে ইসলামের দাওয়াতের জিহাদ বন্ধ হয়ে যাবে। পাকিস্তানে উল্লেখযোগ্য অমুসলিম না থাকলেও জিহাদের নামে এক মুসলিম আরেক মুসলিমকে হত্যা করে চলছে। জিহাদের নামে বোমা হামলার ভয়ে জুমার নামাজ অনেক মসজিদে পড়তে পারে না। জঙ্গিরা বুঝতে পারে না দাওয়াতি কাজের জিহাদই এক বড় জিহাদ। আল্লাহ পাক-পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের শ্রেষ্ঠ জাতি করা হয়েছে যাতে তোমরা মানুষের কল্যাণ কর’। (সুরা আলে ইমরান : আয়াত : ১১০)।
কোন সম্মান তো দায়িত্ব গ্রহণ ব্যতীত অর্জন হয় না। তাই প্রত্যেক মুসলমানের উচিৎ ইসলামের বাণী সত্যের বাণী মানব জাতির কাছে পৌঁছে দেয়া। এটাই ‘জিহাদে ফি সাবিলিল্লাহ’ আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ।
আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে বলেছেন, শত্রæরা যখন তোমাকে মারতে আসবে তখন তাদের মারতে ভয় পেয় না’। ইসলামে আত্মরক্ষা মূলক যুদ্ধের কথা আছে, স্বপ্রণোদিত হয়ে নয়। প্রিয় নবী (দ.) জীবনে ৮০ যুদ্ধে অংশে গ্রহণ করেন এবং ২৭টি যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। সবগুলো যুদ্ধই ছিল আত্মরক্ষা মূলক। তিনি যে য্দ্ধুনীতি ঘোষণা করেছেন তাতে উল্লেখ আছে, অমুসলিম মহিলা, শিশু, বাড়িতে অবস্থানরত বৃদ্ধ এবং তাদের গাছ, ক্ষেত, পশুপাখির ক্ষতি সাধন করা যাবে না এবং তিনি অমুসলিম ধর্মগুরুদের শ্রদ্ধা করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
রামকৃষ্ণ রাও একজন হিন্দু লেখক। তিনি মহানবী (দ.)র জীবন সম্পর্কে লিখেছেন, ‘তাঁর জীবনের ২২ বছর যতগুলো যুদ্ধ হয়েছে তাতে সর্বমোট একহাজার আঠার জন মানুষ হত্যা হয়েছে। অথচ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মারা গেছে ২ কোটি মানুষ। এক কোটি সৈনিক, এককোটি সাধারণ মানুষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মারা গেছে তিনকোটি মানুষ আর আহত হয়েছে সাড়ে তিন কোটি। এই সাধারণ তথ্যের ও সত্যের চিন্তার ভার এবং তুলনা করার দায়িত্ব পাঠকের হাতে অর্পণ করলাম।
লেখক : কলাম লেখক, রাজনীতিক