জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর স্মরণে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার নীরব প্রস্থান

19

মো. মাসুদ পারভেজ চৌধুরী

৭১ রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। বোয়ালখালীর এই কৃতিসন্তান একাধারে একজন কবি, সাহিত্যিক, গীতিকার, সুরকার, ছড়াকার, নাট্যকার হিসেবে সুপরিচিত ও বহুল সমাদৃত। সবচেয়ে বড় কথা- একজন নিরহংকার, বন্ধু বৎসল, প্রাণবন্ত ও সাদা মনের আলোকিত মানুষ ছিলেন প্রয়াত জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। ব্যক্তি জীবনে বাংলাদেশ পুলিশবাহিনীর একজন সৎ, নির্ভীক ও চৌকষ অফিসার হিসেবে সুপরিচিত। সর্বশেষ চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটান পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন অত্যন্ত নিষ্ঠা ও সততার সাথে। পেশায় পুলিশ অফিসার হলেও লেখালেখির নেশাটা ছিল ছাত্রজীবন থেকেই। বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথেও জড়িত ছিলেন ওতপ্রোত ভাবে।
কর্মময় এক বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন প্রয়াত কবি ও সাহিত্যিক জনাব জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। ছাত্রজীবনে বাম রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। প্রগতিশীলত রাজনীতির হাতে খড়িটা সেখান থেকেই। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ কলেজে অধ্যয়ন কালীন ১১ দফা আন্দোলনের উদ্যোগী ও সক্রিয় কর্মী ছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশ মাতৃকার মুক্তি সংগ্রাম মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিয়ে দেশ পুনর্গঠনে ও দেশের মানুষের প্রতি দায়িত্ব পালনে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার দৃপ্ত শপথ নেন। সদ্য স্বাধীন একটা দেশের বিশৃঙ্খল সমাজ থেকে চুরি-ডাকাতি-রাহাজানিসহ সকল প্রকার অন্যায়-অবিচার নির্মূলে সংকল্পবদ্ধ হয়ে কাজ করতে থাকেন দেশ মাতৃকার জন্য। বরাবরই একটু ব্যতিক্রমী ও ভিন্ন চিন্তা ধারার মানুষ ছিলেন তিনি। ‘পুলিশ’ বলতেই গতানুগতিক যে নেতিবাচক চিত্র আমাদের মনে ভেসে উঠে তার বিপরীতে তিনি ছিলেন এক অনন্য ও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ‘দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন’ এই ব্রতে আক্ষরিক অর্থেই আন্তরিক ভাবে বিশ্বাস করতেন। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ছিলেন সদা তৎপর ও খুবই কঠোর। অন্যদিকে পুলিশীক্ষমতার অপব্যবহারে যেন কোন নিরপরাধ সাধারণ মানুষ কষ্ট না পায় এবং ক্ষতির শিকার না হয় সেই ব্যাপারেও ছিলেন সদা সতর্ক। অধঃস্তন পুলিশ সদস্যদেরও সব সময় এইসব নৈতিক বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করতেন যেন ব্যক্তি বিশেষের কারণে পুরো বাহিনী কলঙ্কিত না হয়। তিনি মনে করতেন হাজারো সীমাবদ্ধতার পরও পুলিশবাহিনী আমাদের একটা গৌরবের জায়গা। এমনকি স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে যে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে ছিল তৎকালিন পুলিশ সদস্যরা সে কথা তিনি গর্বভরে স্মরণ করতেন এবং নতুন প্রজন্মের কাছে এইসব বীরত্ব গাঁথা বর্ণনা করতেন অসীম আগ্রহ ভরে।
চাকুরী জীবনে কখনো অন্যায়-অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলাকে প্রশ্রয় দেননি এবং কোন ধরনের চাপের কাছে মাথানত করেন নি। সকল প্রকার দুর্নীতির ব্যাপারে ছিলেন সোচ্চার। তাইতো দীর্ঘ ৪০ বছর পুলিশবাহিনীতে চাকুরী করেও নিজেকে লোভ-লালসা আর দুর্নীতির ঊর্ধ্বে নিয়ে গিয়ে অর্জন করে ছিলেন ব্যাপক সুনাম ও ভ‚য়সী প্রশংসা। আর এটাই ছিল ব্যক্তি জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর বড় অর্জন। সততা আর নিষ্ঠার পুরস্কার স্বরূপ তিন তিন বার জাতি সংঘ বাহিনীতে সফলতার সাথে কাজ করে বিশ্বের বুকে দেশের নাম উজ্জ্বল করেছেন।
ব্যক্তি জীবনে খুবই নির্লোভ নির্মোহ ও সাদাসিধে মানুষ ছিলেন প্রয়াত জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। আসলে তাঁর কবি সত্তাই তাঁকে এক অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। তিনি বলতেন একজন কবির পক্ষে কখনোই অন্যায় করা সম্ভব নয়। কবি মানেই সুকুমারবৃত্তির ও উদার মনের মানুষ। তিনি নিজেকে যতোটা না একজন পুলিশ অফিসার হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করতের তার চেয়েও বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন নিজেকে একজন কবি ভাবতে। এজন্য বিভিন্ন কাব্য ও সাহিত্য সংগঠনগুলোর সাথে ছিল তাঁর নিবিড় যোগাযোগ। ‘রিমিঝিমি সাহিত্য পরিষদ’, ‘গাংচিল সাহিত্য পরিষদ’ এর উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক মহলে ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সাথে ছিল তাঁর নিয়মিত উঠা-বসা। মন ও মননে প্রগতিশীল ও আধুনিক চিন্তাধারার মানুষ জনাব জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। সৃজনশীলতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি বিচরণ করেছেন নিজের সৃষ্টিশীল সত্তাকে ফুটিয়ে তুলতে। একাধারে তিনি ছিলেন কবি ও সাহিত্যিক, ছিলেন নাট্যকার, ছিলেন গীতিকার, আবার নিজের লিখা গানে সুর দিয়ে হয়েছেন সুরকার। বাংলাদেশ বেতার চট্টগ্রাম কেন্দ্রে তিনি ছিলেন তালিকাভুক্ত গীতিকার ও সুরকার। এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, সভা-সমাবেশ ও সেমিনারে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করে নানাবিধ সমাজ সেবামূলক কর্মকাÐে তিনি নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে পছন্দ করতেন। তাঁর এই বহুমুখী কর্মকাÐের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘শেরেবাংলা পদক’, ‘বেগম রোকেয়া পদক’, ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি পদক’, ‘পদ্মকুঁড়ি পদক’, ‘সোহরাওয়ার্দী পদক’, ‘স্বাধীনতা পদক’ জার্নালিস্ট সোসাইটি ফর হিউম্যান রাইটস কর্তৃক প্রদত্ত ‘মানবাধিকার শান্তি পদক-২০১৭’, ইউনাইটেড মুভমেন্ট ফর হিউম্যানরাইটস কর্তৃক প্রদত্ত ‘মহাত্মাগান্ধী পিস এ্যাওয়ার্ড-২০১৭’ ও ‘মাদার তেরেসা স্বর্ণপদক’ সহ অসংখ্য সম্মাননা পুরস্কার লাভ করেছেন।
ধনী-গরীব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-মুসলমান ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের সাথে মিশতে ও প্রাণ খুলে হাসতে ভাল বাসতেন। পুলিশের লোক হিসেবে যেরূপ গুরুগম্ভীর ও রাশভারী হওয়ার কথা তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ তার বিপরীত। অহংকার বা ক্ষমতার দম্ভের লেশ মাত্র ছিলনা তার মধ্যে। এজন্যই আপামর মানুষের সাথে মিশে যেতে পারতেন অবলীলায়। তাঁর এই অসাধারণ গুণের জন্য পরিচিত মহলে খুবই সমাদৃত হতেন আর অবসর জীবনে মানুষের কল্যাণে রাজনীতি করার সুপ্তবাসনা লালন করতেন। যদিও তা আর হয়ে উঠেনি প্রকৃতির অলিখিত নিয়মে ‘মৃত্যু’ নামক অনিবার্য পরিণতির কাছে আত্মসমর্পণ করার কারণে। গত ২০২১ সালের এই দিনে সফলতা-ব্যর্থতার সকল হিসাব-নিকাশ চুকিয়ে তিনি পরপারে পাড়ি জমান বিধাতার দরবারে হাজিরা দিতে। মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন তাঁর জীবনের সকল পাপ মোচন করে ভাল কাজগুলোকে যেন কবুল করেন এই কামনা করছি।
লেখক : প্রাবন্ধিক