জালহারা জেলেদের জলের আমন্ত্রণ

9

এম এ হোসাইন

দীর্ঘ ২২ দিন পর নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় আজ থেকে সাগরে নামছেন জেলেরা। ইলিশপ্রেমী মানুষের জন্য এটি খুবই সুখবর হলেও উপকূলীয় জেলেরা ভুগছেন হতাশায়। নিষেধাজ্ঞার সময়ের মধ্যেই উপকূলে আঘাত হেনেছে ঘূণিঝড় সিত্রাং। অনেক জেলে ঘরবাড়ি থেকে শুরু করে উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন জালটিও হারিয়েছেন। এতে সাগরে নামার সামর্থও হারিয়েছেন অনেক জালহারা জেলে।
অন্য বছরগুলোতে যখন এ সময়ে সাগর পাড়ের জেলেপাড়ায় থাকে সাগরে যাওয়ার সাজ সাজ রব; এবার সেখানে বাজছে বেদনার সুর। ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে সাগরে ফেরার তাড়া থাকে তাদের। কারণ মাছ ধরেই চলে জেলে পাড়ার জীবন। কিন্তু এবার জলোচ্ছ্বাসে তাদের ঘরের পাশাপাশি তলিয়ে গেছে জাল, ভেঙেছে ট্রলার। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আকমল আলী ঘাটের বসবাসকারী শতাধিক জেলে পরিবার। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে পুরো পাড়া। নষ্ট হয়েছে জাল, ট্রলার, ঘর ভেঙে হয়েছে বিলীন। এ অবস্থায় কী করে সাগরে মাছ ধরতে যাবেন, সে চিন্তা এ পাড়ার বাসিন্দাদের। মাছ ধরতে যেতে না পারলে কী করে চলবে সংসার, সেই ভাবনা ছাড়ছে না তাদের। এমন হাজারো চিন্তা মাথায় নিয়ে ছাপড়া ঘর বানিয়ে এখন আশ্রয় নিয়ে আছেন তারা। আস্তে আস্তে আবার সাগরে ফেরার মানসিক প্রস্তুতিও নিচ্ছেন অনেকে।
গত সোমবার রাতে ঘণ্টাখানকের ঝড়ো হওয়া আর জলোচ্ছ্বাসে আকমল আলী ঘাটের দুই শতাধিক বাসিন্দার কাঁচা ঘর-বাড়ি উড়িয়ে নিয়ে যায়। সাগর পাড়ে দুই শতাধিক বাসিন্দার ঘর ছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত হয় মালামাল রাখার ঘর, দোকানসহ বিভিন্ন স্থাপনা। সিত্রাং সব স্থাপনা শুধু উড়িয়ে নিয়ে যায়নি, নিয়েছে একমাত্র উপার্জনের হাতিয়ার জালও। সাগরে ফেরার সম্বল জাল হারিয়ে দিশেহারা জেলেরা। এরপরও আবার ঘুরে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। যেটুকু জাল রক্ষা পেয়েছে সেটা মেরামতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন কেউ কেউ। কেউ বা আবার ঘূর্ণিঝড়ের পর তাদের ঘরের যতটুকু আছে সেটা মেরামত করার চেষ্টায় আছেন।
রিপন দাস নামের এক বাসিন্দা বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের বিপদ সংকেত দিলেও সবাই ঘরে ছিলেন। রাত সাড়ে ৮টার দিকে পানি বাড়তে শুরু করে। ৯টার পর শুরু হয় ঝড়ো বাতাস আর পানিতে তলিয়ে যায় সব। ঘর পানিতে তলিয়ে গেছে, ভেসে গেছে মাছ ধরার জাল। কিছু জাল পেলেও অনেক জালের সন্ধান মেলেনি।
শুধু জাল আর ঘর গেছে সেটা নয়, নষ্ট হয়েছে মাছ ধরার ট্রলারও। তাছাড়া বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়েই চলতো বেশিরভাগ জেলেরা। মাছ বিক্রি করেই শোধ করা হতো ঋণের টাকা। কিন্তু এবার মাছ ধরতে যাওয়ার আগেই সব ছিনিয়ে নিয়েছে ঘূর্ণিঝড়।
পরিমাল দাশ নামের এক বাসিন্দা বলেন, জাল হারিয়ে গেছে, ট্রলার নষ্ট হয়েছে, ঘরবাড়ি নষ্ট হয়েছে। এরপরও তো ঋণের টাকা শোধ করতে হবে। প্রায় সবার ঋণ আছে। শুক্রবার রাত থেকে মাছ ধরতে যাওয়ার কথা। মাছ ধরতে যেতে পারলে ঋণের কিস্তি শোধ করা যেতো। এখন তো সাগরে যাওয়ার আগেই সব শেষ হয়ে গেল। এখন সাগরে যেতে হলে জাল লাগবে। ট্রলার ঠিক করতে হবে। আবার ঋণ নিয়ে এসব করতে হবে।
ঝড় আসে, ক্ষতি করে দিয়ে যায়, তা থেকে আবার উঠে দাঁড়ানোর সংগ্রামের মধ্য দিয়েই চলে সাগর পাড়ের জেলেদের জীবন। কিন্তু এবার ক্ষতিটি বেশিই দেখছেন জেলেরা। তার মধ্যেই ঝড়ের ক্ষত ভুলে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন তারা। সরকারের পক্ষ থেকেও ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার কথা জানানো হয়েছে। তবে এখনও সেরকম সহায়তা পায়নি বলে জানান স্থানীয়রা।
চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী বলেন, চট্টগ্রামে নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ২৬ হাজার ৯৯২ জন। আমরা স্থানীয় ওয়ার্ড, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী তাদের চাল সহায়তা দিয়েছি।
আকমল আলী ঘাটে জেলেরা বেদনাহত অবস্থায় থাকলেও উপক‚লের অন্যান্য জায়গায় জেলেদের সাগরে ফেরার তাড়া লক্ষ্য করা যায়। সাগরে যাওয়ার জন্য ট্রলার মেরামত, প্রয়োজনীয় বাজার-সদাই, সব ধরনের সামগ্রী প্রস্তুতির কাজ করছেন তারা। ২২ দিনের অলস সময় পার করার পর কর্মময় হয়ে উঠছে সাগর পাড়।