জামিনে বেরিয়ে লাপাত্তা জঙ্গি মামলার আসামিরা

18

তুষার দেব

উগ্রবাদী সংগঠনের কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হয়ে সম্প্রতি কথিত হিজরতের নামে স্বেচ্ছায় নিরুদ্দেশ হওয়া কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের পর বিচারাধীন জঙ্গি মামলার আসামিরা নতুন করে আলোচনার সামনে এসেছে। জঙ্গি তৎপরতায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যাওয়া এসব আসামির বেশিরভাগই গত কয়েকবছরে জামিনে বেরিয়ে লাপাত্তা রয়েছে। জঙ্গি মামলার অধিকাংশ আসামি আদালতে হাজিরা দেন না। উগ্রবাদী তৎপরতা ফের মাথাচাড়া দেয়ায় জঙ্গি মামলার পলাতক আসামিদের ধরতে পুলিশের সবকটি ইউনিট, রেঞ্জ ডিআইজি ও পুলিশ সুপারদের সদর দপ্তর থেকে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, জামিনে থাকা জঙ্গিরা নিয়মিত আদালতে হাজিরা দেয়ার শর্ত থাকলেও তাদের বেশিরভাগই হাজির হচ্ছে না। এ জন্য তাদের ধরতে পুলিশের সবকটি ইউনিট, রেঞ্জ ডিআইজি ও জেলার পুলিশ সুপারদের বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। জামিনপ্রাপ্তরা ছাড়াও নতুন করে উগ্রবাদী তৎপরতায় জড়িতদেরও ধরতে বলা হয়েছে। পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করছে দেশ থেকে জঙ্গি নির্মূল করতে। কিন্তু এখনও জঙ্গিরা গোপনে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, বর্তমানে প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য পাহাড়ে অনেক জঙ্গি অবস্থান করছে। একটি সংস্থা তাদের অবস্থান চিহ্নিত করেছে। সেখানে র‌্যাব-পুলিশকে সবধরনের সহায়তা করছে সেনাবাহিনী। ইতিমধ্যে সেনাবাহিনী, র‌্যাব ও পুলিশ পার্বত্য জেলা রাঙামাটি ও বান্দরবানের দুর্গম কিছু এলাকা কর্ডন করে রেখেছে। ওই এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সহস্রাধিক সদস্য অভিযানে রয়েছে। স্পিড বোট, নৌকা ও হেলিকপ্টারে টহল দেয়া হচ্ছে। বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ সেখান থেকে সাত জঙ্গি ও তিন পাহাড়ি সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আশা করি অল্প সময়ের মধ্যেই জঙ্গিদের আস্তানা গুঁড়িয়ে দেয়া সম্ভব হবে।
চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, গত বেশ কয়েকদিন ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে জঙ্গি আস্তানায় বড় ধরনের অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। তাতে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সদর দপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী জঙ্গি মামলার পলাতক আসামিদের ধরতে কাজ শুরু করা হয়েছে। সদর দপ্তরের বার্তা সব স্টেশন ইনচার্জদের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। যারা পালিয়ে বেড়াচ্ছে তারা যাতে পুনরায় সংগঠিত হতে না পারে সেদিকে সতর্ক নজরদারি বাড়াতে বলা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রামে গত সাত বছরে বিভিন্ন উগ্রবাদী ও নিষিদ্ধ সংগঠনের দুই শতাধিক সদস্যকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর মধ্যে বর্তমানে কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক রয়েছে মাত্র ৩৭ জন। বাকিরা আদালত থেকে জামিন নিয়ে বেরিয়ে গেছে। জামিনে মুক্তি পাওয়া অনেকের বিরুদ্ধে আদালতে ঝুলছে একাধিক মামলা। কারাগার থেকে বেরিয়ে জঙ্গি মামলার আসামিদের কেউ কেউ আদালতে হাজিরা দিলেও বেশিরভাগই লাপাত্তা হয়ে গেছে। পলাতক আসামিরা কে কোথায় আছে সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই।
কেন্দ্রীয় কারাগার সূত্র জানায়, কারাগারে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের ৩৭ জন বন্দি আছেন। এর মধ্যে সাজাপ্রাপ্ত জঙ্গি আছে তিন জন। বাকি ৩৪ জনের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো বিচারাধীন আছে। কারাগারে আটক জঙ্গি মামলার আসামিদের মধ্যে রয়েছেন, জাবেদ ইকবাল ওরফে মোহাম্মদ ওরফে আমান উল্লাহ ওরফে আবু হুররার, মো. শামীম হোসেন গালিব, শামীম হোসেন ওরফে শামীম হাসান, মো. এরশাদ হোসেন ওরফে মামুন, মো. মাহবুব ওরফে খোকন, মিনহাজুল ইসলাম ওরফে সাজিল, মো. শাহজাহান ওরফে কাজল, মো. নূরনবী ওরফে রাজু, রমজান আলী ওরফে রাজু, মো. আবদুল মান্নান, মো. সুজন ওরফে বাবু, বুলবুল আহম্মদ সরকার ওরফে আপেল ওরফে ফুয়াদ, জহিরুল হক ওরফে জসিম উদ্দিন, আরজিনা আকতার, মো. হাছান, রাকিবুল হাসান ওরফে জনি, আশফাকুর রহমান ওরফে আবু মাহির আল বাঙালি, মো. বাবলু রহমান, মাওলানা মো. তাজুল ইসলাম সুমন, মঞ্জুরুল মুরাদ ওরফে আবদুল্লাহ, মো. শরফুল আওয়াল, আমিরুজ্জামান পারভেজ, সাবকাত আহম্মেদ, ফাহাদ বিন সোলাইমান, রাকিব হাসান ওরফে মনা, হাবিবুর রহমান ওরফে তাহসীন ওরফে হাবিব, মো. আবদুল খালেক হুরায়রা ওরফে মালেক, মো. আমির হোসাইন ইসহাক ওরফে লিটন, মো. আমিনুল ইসলাম হামজা ওরফে আমিনুল, মো. মোবাশ্বের সামাদ খান ওরফে সামাদ, মো. আজিজুল হক ওরফে আজিজ, আবদুল কাইয়ুম শেখ ওরফে মানছুর ইসলাম, শফিকুল ইসলাম শেখ ওরফে সালাউদ্দিন, ধর্মান্তরিত মুসয়াব ইবনে উমায়ের ওরফে পিংকু দাশ, শহীদ হামজা ব্রিগেডের মো. মনিরুজ্জামান মজুমদার ওরফে মাসুদ ওরফে ডন, মো. মোজাহের হোসেন ও মো. সাব্বির আহমদ। এদের মধ্যে শীর্ষ জঙ্গি জাবেদ ইকবালের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও রাঙামাটির বিভিন্ন থানায় ১৯টি মামলা রয়েছে। ১৬টি মামলায় তার সাজা হয়েছে। এসব মামলার মধ্যে তিনটিতে ২০ বছর করে, একটিতে ১৪ বছর, আটটিতে ১০ বছর করে, একটিতে ৩০ বছর সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। বাকি তিনটি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। বাকিদের বিরুদ্ধেও রয়েছে একাধিক মামলা।
একইভাবে গত কয়েক বছরে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে জঙ্গি মামলার শতাধিক আসামি জামিনে বেরিয়ে লাপাত্তা হয়েছেন। পলাতক এসব আসামির মধ্যে পাবনার সুজানগর এলাকার বাসিন্দা আল আমিন, নীলফামারীর জলঢাকার জেএমবি নেতা আবদুল হাফিজ ওরফে খলিল, সাতক্ষীরার আবুল কালাম আজাদ ওরফে কালাম, লক্ষীপুরের মো. ইসমাইল, ঝিনাইদহের আসাদুজ্জামান, দিনাজপুরের আরিফুল ইসলাম ওরফে নাছির, রংপুরের শাকিব খান ওরফে এরশাদ, জামালপুরের ওবায়দুর রহমান ওরফে আবুল খায়ের, কুমিল্লার আরশাদুল আলম, জামালপুরের আবুল কালাম, ময়মনসিংহের মাহফুজুর রহমান অপু ও চট্টগ্রামের সালাহউদ্দিন হোসাইন ভুঁইয়া, কুমিল্লার রাজু খন্দকার ওরফে রাজু, বোয়ালখালীর হাবিবুন নবী ওরফে আশিকুর রহমান ওরফে রানা ও রায়হানুল ইসলাম, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিক মোবারক হোসেন, চাঁদপুরের শেখ ওমর শরীফ, সাতকানিয়ার তন্ময় সুফিয়ান ওরফে তন্ময়, ফটিকছড়ির সাফায়েত ইয়ামির ইকবাল, কক্সবাজারের আরিফুল ইসলাম, কুতুবদিয়ার ইফতেখারুল ইসলাম, কক্সবাজারের শহিদুল ইসলাম ওরফে শহিদ ও সাতকানিয়ার আহসান আলী রিয়াজও রয়েছেন। এ ছাড়া ময়মনসিংহের ত্রিশালে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে পালিয়ে যাওয়া শীর্ষ জঙ্গি সদস্য মিজানুর রহমান ওরফে বোমা মিজানও এখনও অধরা রয়েছেন।
আদালত সূত্র জানায়, জঙ্গিদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের বিভিন্ন আদালতে অন্তত ৬৮টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে ২০০৫ সালে দায়ের হওয়া মামলাও আছে। আইনজীবীরা বলছেন, আদালতে বিচারক শূন্যতা, সাক্ষী হাজির না হওয়া এবং পলাতক আসামিদের বিষয়ে আদালতে প্রতিবেদন না আসাসহ নানা কারণে জঙ্গি মামলার বিচার কার্যক্রমে দীর্ঘসূত্রিতা বিরাজ করছে।
উল্লেখ্য, চলতি মাসের শুরুতে র‌্যাব কথিত হিজরতের নামে সম্প্রতি ‘স্বেচ্ছায় নিখোঁজ’ হওয়া কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের পর উগ্রবাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী নতুন জঙ্গি সংগঠনের সন্ধান পায়। যার নাম- ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’। র‌্যাবের দাবি, নতুন করে দলভুক্ত করা সদস্যদের মোটিভেশন (উদ্বুদ্ধকরণ) ও প্রশিক্ষণসহ সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য সামরিক প্রশিক্ষণে নেতৃত্ব দিচ্ছেন নিষিদ্ধ ঘোষিত হরকাতুল জিহাদ (হুজি) জেএমবি, নব্য জেএমবি, হিজবুত তাহরীরসহ অন্যান্য জঙ্গি সংগঠন থেকে আসা নেতৃস্থানীয়রা। নিষিদ্ধ ঘোষিত বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন থেকে কয়েকজন সদস্যকে একত্রিত করে বিগত ২০১৭ সালে নতুন এই জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম শুরু হয়। গত ১০ অক্টোবর ‘জঙ্গিবাদে’ জড়িয়ে দুই বছরে বাড়ি ছাড়া ৫৫ তরুণের মধ্যে ৩৮ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করে র‌্যাব জানায়, পার্বত্য জেলার দুর্গম পাহাড়ে তাদেরকে সশস্ত্র প্রশিক্ষণও দেয়া হচ্ছে। এ তথ্যের ভিত্তিতে পার্বত্য জেলা রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির দুর্গম অঞ্চলে র‌্যাব অভিযান শুরু করে। গত ২০ অক্টোবর সেখান থেকে ১০ জঙ্গি ও পাহাড়ি সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তারের খবর প্রকাশ করা হয়।