জান্নাতের সুসংবাদ পাওয়া ১০ সাহাবির নাম চন্দনপুরা মসজিদে

54

সবুর শুভ

মসজিদটির চারদিকে রঙের মেলা, আকাশপানে উত্থিত সুউচ্চ মিনার, কারুকাজে ভরা দেয়াল ও দরজা-জানালা। এর প্রতিটি পরতে পরতে যেন ইসলামি স্থাপত্যশৈলীর ঢেউ খেলছে। সুনিপুণ শিল্পের সাথে রং তুলির মিশ্রণ ঘটিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে দেশের তথা চট্টগ্রাম নগরীর অনন্য নিদর্শন ঐতিহ্যবাহী চন্দনপুরা হামিদিয়া তাজ মসজিদ। মসজিদ-ই-সিরাজউদ্দৌলা নামেও পরিচিত এটি। তবে বেশিরভাগ মানুষ চিনে চন্দনপুরা মসজিদ হিসেবে।
কারুকাজ ও গঠনশৈলী দেখেই বোঝা যায় কতটুকু নিখুঁত ও আন্তরিকতা দিয়ে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে। চকবাজার ওয়ার্ডের নবাব সিরাজউদ্দৌলা সড়কে মসজিদটির অবস্থান। ১৯৫০ সালে এটি নির্মাণ করেন আবু সৈয়দ দোভাষ। ১৮৭০ সালে সেখানে মাটি ও চুন-সুরকির দেয়াল আর টিনের ছাদের একটি মসজিদ ছিল। সেটি প্রতিষ্ঠা করেন সৈয়দ দোভাষের পূর্বসুরী আব্দুল হামিদ মাস্টার। সেই হিসেবে মসজিদের বয়স ১৫২ বছর।
জানা যায়, ১৮৭০ সালেও মাটির দেয়াল কারুকাজে ভরপুর ছিল। হামিদ মাস্টারের বংশধর ব্রিটিশ সরকারের ঠিকাদার আবু সৈয়দ দোভাষ ১৯৪৭ সালে প্রথম এই মসজিদ সংস্কারে হাত দেন। প্রায় ১৩ শতক জায়গার ওপর দোতলা মসজিদটি গড়ে তোলেন তিনি।
আরেক তথ্যে জানা যায়, ১৬৬৬ সালে শায়েস্তা খাঁনের সেনাবাহিনী আরাকান মগরাজাদের কবল থেকে চট্টগ্রামকে মুক্ত করে প্রতিষ্ঠা করেন মুঘল শাসন। তখন শাহী ফরমান বলে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে অনেকগুলো মসজিদ নির্মিত হয়। এর মধ্যে চন্দনপুরা মসজিদ, হামজা খাঁ মসজিদ, আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ, অলি খঁাঁ মসজিদ অন্যতম। মুগল শাসনামলে এই স্থাপত্যশিল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
তবে কয়েকশ’ বছর মসজিদটি মাটি ও টিনশেডের ছিল। মসজিদটির প্রথম সংস্কারক ছিলেন মাস্টার হাজী আব্দুল হামিদ। পরে ১৯৪৭ সালে তাঁর পুত্র আবু সৈয়দ দোভাষ মসজিদটি নতুন করে সংস্কারের উদ্যোগ নেন। মসজিদ তৈরিতে ভারতের উত্তর প্রদেশের রাজধানী লক্ষো থেকে আনা হয় মুঘল ঘরানার কারিগর। এছাড়া ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে আনা হয় নান্দনিক নানা উপকরণ। স্থাপত্যশিল্পে তাক লাগানো ছোট্ট এই মসজিদটির সংস্কার কাজে তখন ব্যয় হয়েছিল প্রায় পাঁচ লাখ টাকা। মসজিদের নান্দনিকতা বাড়াতে নির্মাণ করা হয় ১৫টি গম্বুজ।
জনশ্রæতি আছে, সবচেয়ে বড় গম্বুজ নির্মাণে ব্যবহৃত হয় প্রায় ১০ টন পিতল। এক সময় পিতলে নির্মিত সুউচ্চ গম্বুজটি সূর্যালোকে ঝলমল করত। সত্তরের দশকেও এ মিনারে ওঠে আজান দিতেন মুয়াজ্জিন। এ ধরনের দু’টি মিনার এখনও আছে। এই মসজিদের গম্বুজের চারপাশে আহলে বায়তে রাসূলসহ দুনিয়ায় জান্নাতের সুসংবাদ পাওয়া ১০ সাহাবির নাম লেখা আছে। মসজিদটির খ্যাতি আছে দেশ-বিদেশে।
চট্টগ্রামের আইকনিক ছবি হিসেবে মসজিদটির ছবি ব্যবহৃত হয় বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের বিভিন্ন প্রকাশনায়। জাপানের এশিয়া ট্রাভেল ট্যুরস ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে ব্যবহৃত হয় মসজিদটির ছবি। প্রতি ওয়াক্তে প্রায় তিনশত এবং জুমার দিন প্রায় হাজারের বেশি মুসল্লি নামাজ আদায় করেন। প্রতি মাসে ১৫-২০ জন পর্যটক মসজিদটি দেখতে আসেন। তাছাড়া সৌন্দর্য রক্ষায় প্রতি চার বছর অন্তর এটির রং করা হয়।
সরেজমিন দেখা যায়, কারিগরের অভাবে সূ² কাজগুলোর সংস্কার না হওয়ায় অনেক কিছু বিবর্ণ হয়ে গেছে। তবে এখনও আগের মতো মানুষের কাছে মসজিদটির আবেদন রয়েছে। চারপাশের দেয়ালগুলো ভেন্টিলেশন সিস্টেমের। দেয়ালের ফাঁক গলে ঢুকছে আলো-বাতাস। বাইরের আলোর ঝর্নায় ভেতরটা ঝলমল করে। আছে বাতাসের কোমল পরশ।
স্থানীয়রা জানান, আশপাশে অনেক নতুন মসজিদ গড়ে উঠলেও এ মসজিদে মুসল্লির সংখ্যা বাড়ছে। মসজিদটিতে রয়েছে দুর্লভ ইসলামী নিদর্শনাবলীর সমৃদ্ধ সংগ্রহশালা।