জানা, শেখা ও জ্ঞান অর্জনের জন্য বইপড়া আবশ্যক

18

কাজি রশিদ উদ্দিন

বেশ কয়েক সপ্তাহ বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় আমাকে শহরের একটি হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। বর্তমানে বাসায় অবস্থান করছি। এ কারণে পাঠকদের সামনে হাজির হতে পারি নাই বলে দুঃখ প্রকাশ করছি। আমার অসুখের কথা শুনে অনেকে আর্থিকভাবে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পূর্বদেশের পরিচালনা বিভাগের মেনেজার জনাব নিয়াজ আহমদ এবং সহকারী সম্পাদক জনাব আবু তালেব বেলাল যাহাদের প্রচেষ্টায় পত্রিকার স্বত্বাধিকারি সম্পাদক জনাব মুজিবুর রহমান আমাকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আর্থিক সাহায্য দান করেছেন। এছাড়া আমার বিশিষ্ট বন্ধু জনাব হাসিম চৌধুরীও আর্থিক সাহায্য দিয়েছেন এবং জনাব নিয়াজ আহমদ অনেক কষ্ট করে আমার নিকট পৌঁছে দিয়েছেন। তাহাদের সকলকে যে কিভাষায় কৃতজ্ঞতা জানাবো তা খুঁজে পাচ্ছি না। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তাদের রহম করুন এবং দীর্ঘ সুস্থ হায়াত দান করুন।
সর্বশেষ উল্লেখ করতে হয় জনাব ওসমান গণি মনসুরের নাম। যিনি বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং পিপলস্ ভিউয়র সম্পাদক ও উদার মহানুভবতার মানুষ। তিনিও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। যা হোক এবার এ কথাগুলো লিখে আমার মুল প্রবন্ধে ফিরে আসি।
বই পড়ুন, জ্ঞান বৃদ্ধি করতে, কারণ ইংরেজিতে একটি প্রবাদ বাক্য আছে ‘ কহড়ষিবফমব রং ভড়বিৎ ’ অর্থাৎ জ্ঞানই শক্তি। তবে অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় বই পড়া কি সবাই ভুলে যাবে ? বই কি কেবল লাইব্রেরির সেলফে শোভা পাবে ? না কি কেবল জাদুঘরের দর্শনীয় বস্তুর মত টিকে থাকবে ? ইদানীং এমন সব প্রশ্ন দেখা দিয়েছে ভার্চুয়াল জগৎ ও করোনার কারণে। কিন্তু কেন ?
আগের দিনে বই পড়া ছিল মানুষের একটা হবি- খুব পছন্দের একটা শখ। অনেকে বই পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে যেত টেরই পেত না। কিন্তু এখন রাতের খাওয়া শেষ করে শুয়ে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নেট চষে সময় পার করছেন। রাতের গভীরতা যত বেশি হয়, নির্ঘুমের অস্থিরতা তত বৃদ্ধি পায়। এমন এক সময় ছিল যখন। আপনার প্রিয় বই কী ? এর উত্তর ও নেক সময় পাওয়া যেত, আল কুরআন। সাথে অন্যান্য বইয়ের কথা তো আছেই। এখন এমন প্রশ্ন কেউ করে কিনা তাও শোনা যায় না। এখন সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে কুরআন পড়া লোকের সংখ্যা দিনদিন কমে যাচ্ছে। রমজান এলে যে হারে কুরআন তিলাওয়াত হয় অন্য সময় অন্য সময়ে তেমনটি হয় না। সওয়াবের আশায় একটু আধটু পড়লেও জানার আগ্রহ খুব কম দেখা যায়। এখানে পবিত্র কুরআনের কথা বলা হয়েছে এই জন্য যে এটি কোনও মানুষের লেখা নয় এবং এটি আল্লাহর কালাম। প্রত্যেক মুসলমান এমনটি অন্য ধর্মের লোকেরাও কোরআন নিজ ভাষায় বুঝে পড়তে হবে। দেখা যাবে এতে ছত্রে ছত্রে। লাইনে লাইনে আপনার জীবন পথে চলার দিকনির্দেশনা পাবেন। পবিত্র কুরআন হলো একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। ইসলামী সমাজ কায়েমের লক্ষ্যে দ্বীন কায়েমের কর্মসূচি হাতে নিয়ে যারা ইসলামী আন্দোলনের কাজ করেন। কুরআন-হাদিস অর্থসহ অধ্যয়ন এবং ইসলামী সাহিত্য বুঝে পড়ার তাগিদ দেয়া হয় বলেই তাদের মধ্যে সেটি চর্চা করার অভ্যাস বর্তমান আছে। তবে অনেক সময় লক্ষ করা যায়, ব্যক্তিগত রিপোর্ট রাখা এবং সিলেবাস শেষ করার তাগিদে বুঝে পড়ার চেয়ে পরিসংখ্যানগত মান বৃদ্ধির জন্য বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অনেক সময় তদারকির অভাবে এটি হয়ে থাকে।
আগের দিনে পাঠক প্রায় সবার কাছে ব্যাগে দু-একটা পছন্দের বই থাকত। দীর্ঘ সফরে গেলে তো কোনো কথাই নেই। সাথে দু-একটা গ্রন্থ নিতেই হতো। একটি ভালো গল্পের বই হতো সফরসঙ্গী। বাসস্ট্যান্ডে, ট্রেন স্টেশনে, চলন্ত বাস বা ট্রেনে সিটে বসে ব্যাগ থেকে বই বের করে পড়া হতো। এতে সময় কোন দিক দিয়ে চলে যেত টের পাওয়া যেত না। দীর্ঘ সফরের রাস্তা যেন খাটো হয়ে যেত। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন কারণে দিন দিন এ অভ্যাসটা ছুটে যাচ্ছে। সুন্দর বই পড়ার চর্চা হারাতে বসেছে।
ইন্টারনেট, ফেসবুক, ইউটিউট ওই জায়গাটা দখল করেছে। ছাত্র কি অছাত্র সবার মধ্যে বই পড়ার মানসিকতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। কাজ সেরে হাতে একটু সময় বাঁচলে সেটুকুও ফেসবুক পেজ তার নজর কেড়ে নেয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কোন দিক দিয়ে চলে যায় টের পাওয়া যায় না। অশ্লীল কিছু দেখলে কোনো কথা নেই। তা হলে কী করে যুব সমাজ ভাল হবে ?
জানার জন্য বই পড়া, শেখার জন্য বই পড়া (অবশ্য ভাল বই) জ্ঞান অর্জনের জন্য পড়া। আর শেখার জন্যই বই পড়তে বলা, ‘পড়’ বলার মাধ্যমে জ্ঞান অন্বেষণ করার জন্য বিশ্বের সব মানুষকে ইসলাম সর্বপ্রথম আহবান জানিয়েছে। আল্লাহ তার রাসুল সা. কে প্রথম ওহী করে পাঠালে ‘ইকরা’ মানে পড়। কী পড়ব ? এর উত্তরে ‘পড়’ শব্দ প্রতীকটির বাস্তব প্রতিচ্ছবি তুলে ধরা হলো আল কুরআন নামক কিতাব। জ্ঞানের ভাÐার হলো বই, জানার জন্য হলো বই, কিন্তু জানতে হলে, জ্ঞান বৃদ্ধি করতে হলে প্রথমে যেতে হবে বই নামক জ্ঞান ভান্ডারের কাছে। মানুষ প্রকৃতি জগৎ থেকে গবেষণা করে যা পায়। যা কিছু শিখে, তা কালির আচড়ে প্রতীকী রূপ দিয়ে বই বা গ্রন্থাকারে জমা করে রাখা হয়। আল্লাতায়ালার কথাগুলো আরবি অক্ষরের প্রতীকীরূপ দিয়ে সংঘবদ্ধ করে গ্রন্থাকারে আমাদের কাছে সম্পূর্ণ অপরিবর্তনীয় আকারে পৌঁছেছে যে বইটি তার নাম ‘আল কুরআন’ আল হামদুলিল্লাহ, কুরআন নামক বইটি আজো বিশ্বের বুকে অবিকৃত অবস্থায় আছে।
বাস্তব সত্য হলো, মানুষ যা জানে-বোঝে তা অন্যের নিকট বিতরণ করার জন্য যত মাধ্যম আছে তার মধ্যে অতি সহজ ও সস্তা উপায়-উপকরণ হলো বই। জ্ঞানের ভাÐার বই আকারে জমা থাকলে কোনো না কোনো একদিন অন্যের কাছে পৌঁছবে। এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের কাছে হস্তান্তরিত হবে। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে কলের গান চালু হওয়ার পর গ্রাম-গঞ্জে বৈঠক খানা ও দহলিজে লোকেরা বসে কলের গান শুনতো। সেটি এখন আর নেই। তারপর রেডিও এলো। এটার তেমন ব্যবহারও এখন নেই। টিভি শিক্ষার একটা ভালো বাহন হলেও নানা কারণে সেটিরও সমালোচনা হচ্ছে- দর্শক ও শ্রোতারা যা চায় তা পায় না। মনের খোরাক না পেয়ে এটা দেখার শখ আর জাগে না। পরিশেষে মোবাইল নামক ডিভাইসটি হয়েছে সার্বক্ষণিক সঙ্গী।
রাজা-বাদশাহ ও নেতাকর্মী থেকে শুরু করে নি¤œ স্তরের সব শ্রেণি পর্যন্ত সবার হাতে এটি শোভা পাচ্ছে। এর বিপরীতে যত দিন যাচ্ছে বই পড়ার আগ্রহ তত কমে যাচ্ছে। একটা প্রবাদ আছে, ‘ছাত্রনম অধ্যায়নং তপ’ অর্থাৎ ছাত্রদের মূল তপস্যা হলো অধ্যয়ন বা বই পড়া। বই না পড়লে শিখবে কী ?
জ্ঞানের গভীরে পৌঁছানোর জন্য বই পড়া, গবেষণা করা, ছাত্রছাত্রীরা অন লাইনে ক্লাসের অজুহাতে বই পড়া ছেড়ে দিয়েছে। ইউটিউবে, ফেসবুকে ঢুকে ঘণ্টার পরর ঘণ্টা অপচয় করছে। ইন্টারনেটে ভালো-মন্দ দু’টোই আছে। ভালোটা নিতে গিয়ে মনের আবেগে বাঁকা পথে চলে ভালোটা হারিয়ে ফেলছে, শয়তানের উসকানিতে অশ্লীল ছবির পেজে নিজেকে হারিয়ে ফেলছে। ফলে যৌন চাহিদার জোয়ারে গণধর্ষণের মতো কুকর্ম দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে, ইউটিউব ও গুগল পেজে ছেলেমেয়েরা অবাধ মেলামেশা ও যৌনাচার শিক্ষা নিচ্ছে। ইদানীং নাটকরূপে প্রতিবেশী দেশ থেকে বন্যার মতো ভেসে আসছে বিকৃত যৌন সম্পর্কিত নিকৃষ্টতম অতি জঘন্য দৃশ্য এবং তা ভাইরাল হচ্ছে সোস্যাল মিডিয়ায়।
এভাবে মানবতার দৃশ্যমান একটি মহল মনুষ্যত্বকে জবাই করে পশুত্বকে লালন করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে যুবসমাজ এবং শিক্ষার্থীদের একটা বিরাট অংশ বই পড়া বাদ দিয়ে বিকৃত যৌনাচার শিখতে অভ্যস্ত হচ্ছে দিন দিন সুস্থবিকাশ হুমকির মুখে চলে যাচ্ছে। এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে জ্ঞানী-গুণী ও দেশ প্রেমিকদের জাতিকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসা প্রয়োজন।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট