জাতীয় শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন পারদর্শী করার পূর্বশর্ত পারদর্শী হওয়া

17

জহির সিদ্দিকী

যেকোন কারখানার উৎপাদন ভালো না খারাপ তা নির্ভর করে দক্ষ জনশক্তির উপর। এখানে দক্ষ বলতে মেশিন চালানোর পদ্ধতি, কৌশল জানার সক্ষমতাকে বুঝায়। যে যতই দক্ষ হবেন সে ততই ভালো উৎপাদনে সক্ষম হবেন। উৎপাদনের প্রক্রিয়াকে মনে প্রাণে গ্রহণ না করলে তার উৎপাদন ব্যাহত হবার সম্ভাবনাও থাকে বেশি। তার সাথে প্রয়োজন যথাযথ পরিবেশ, উপকরণ এবং মর্যদা। প্রক্রিয়াজাতকে আরো সুসংহত, উন্নত করতে সবচেয়ে যেটি বেশি ভূমিকা রাখে তা হলো- সুন্দর পরিকল্পনা, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহীতা।
প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়- একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সার্বিক সফলতা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষার্থী, পরিবেশ, প্রশাসন ইত্যাদির উপর। তন্মধ্যে শিক্ষকরাই আলোকবর্তিকা হয়ে কাজ করে থাকেন। যাঁরা আলো বিলিয়ে দেন, শিক্ষার্থীরা আলোকিত হয়। শিক্ষকরা সমাজ স্বীকৃত জনগণের কাক্সিক্ষত শিখন কার্যক্রমে পেশাগত দায়িত্ব পালন করেন। যিবরঃযবফ এর মতে- ‘ঞবধপযরহম রং ধৎঃ ধহফ ঃবধপযবৎ রং ঃযব মৎবধঃবংঃ ধৎঃরংঃ.’ অর্থাৎ শিক্ষকতা হলো শৈল্পিক কর্মকাÐ আর শিক্ষক হলেন ঐ শিল্পের মহান শিল্পী। দার্শনিক রুশো এর মতে- ‘সু-অভ্যাস গঠনের নাম শিক্ষা, আর শিক্ষক শিক্ষার্থীর সু-অভ্যাস গঠনের নির্দেশক।
আমরা জানি একটি শিক্ষা ব্যবস্থার যাবতীয় কার্যক্রম শ্রেণিকক্ষকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়। শ্রেণিকক্ষের উপযুক্ত পরিবেশ, পাঠদান পদ্ধতির সফল প্রয়োগ, শিক্ষা উপকরণের উপযুক্ত ব্যবহার সব কিছুই শিখন- শেখানো কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জাতীয় শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য সফল ও সার্থক করতে হলে উপযুক্ত শ্রেণি পাঠদানের বিকল্প নেই। যার আইকন হিসেবে কাজ করেন শ্রেণি শিক্ষক। একজন শ্রেণি শিক্ষক হবেন বিষয়গত গভীর জ্ঞানের অধিকারী। কারণ শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীরা জানার নেশায় নানা বিষয়ের প্রশ্ন করার সম্ভাবনা থাকে। কাজেই উত্তরের সক্ষমতা থাকাই বাঞ্চনীয়। অপরদিকে শ্রেণিকক্ষে বিষয়বস্তু কার্যকরভাবে উপস্থাপন করার জন্য চাই পাঠদান পদ্ধতি ও কৌশল ভালোভাবে আয়ত্তকরণ। বর্তমান জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২২-এ শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। যেখানে পাঠদান প্রক্রিয়ায় রয়েছে বিভিন্ন ধাপ। এগুলো রপ্ত না হলে পাঠদান নিশ্চিত ব্যাহত হবে। তাহলে যুগের সাথে তাল মিলাতে এবং সফল শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হলে নিজেকে সেই ভাবেই গড়ে তুলতে হবে। কারণ শিক্ষকের কর্মতৎপরতা, দক্ষতা ও পাঠদানের প্রয়োজনীয় পদ্ধতি ও কৌশল অনুসরণের উপর নির্ভর করে শ্রেণি পাঠদানের সফলতা। শিক্ষার্থীরা শিক্ষককে সবসময় জ্ঞানের উৎস হিসেবে মনে করে। কাজেই শিক্ষককে নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর গভীর জ্ঞান অর্জন তথা তথ্য-উপাত্ত জেনে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করতে হবে। নতুবা শিক্ষার্থীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা দিনোত্তর হ্রাস পাবে। অন্যদিকে, পাঠদান সফল করার অন্যতম দিক হলো পূর্ব পরিকল্পনা। তাই শ্রেণিকক্ষে যাবার পূর্বেই সময় বিভাজন পূর্বক নির্দিষ্ট বিষয়ে পাঠ পরিকল্পনা করা আবশ্যক। পাঠদানের নীতি অনুযায়ী পাঠদানের বিষয়বস্তু উপস্থাপন কালে শিক্ষককে সব সময় ‘সহজ থেকে কঠিন’ ‘জানা থেকে অজানা’ ‘মূর্ত থেকে বিমূর্ত’ ইত্যাদি দিকগুলো গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় রাখতে হবে। সে সাথে পাঠের পূর্ব নির্ধারিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এগিয়ে যেতে হবে। আর বিষয় সংশ্লিষ্ট উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে বিষয়বস্তুকে শিক্ষার্থীদের নিকট আকর্ষণীয় ও ফলপ্রসু করা যায়। সুতরাং একজন শিক্ষককে বিষয়বস্তুর সাথে সামঞ্জস্য রেখে উপকরণ নির্বাচন, যাচাই , সংগ্রহ ও ব্যবহার করার ক্ষেত্রে দক্ষ, রুচিশীল, বুদ্ধিমত্তা এবং দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। শ্রেণিতে শিক্ষার্থীরা মত বিনিময়, আলোচনার মাধ্যমে শিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তাই দলগত কাজ দিয়ে উৎসাহিত করার জন্য শিক্ষককে অনন্য ভূমিকা পালন করতে হয়। শিক্ষার্থীদের মাঝে ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তোলার জন্য পাঠদান বা দলগত কাজের মধ্যে ধন্যবাদ দেওয়া, প্রশংসা করা, সহমর্মিতা দেখানো প্রয়োজন। এসব দিক শিখনকে ত্বরান্বিত করে। এমনকি শিক্ষকের আন্তরিক ও হৃদ্যতাপূর্ণ আচরণ শিক্ষার্থীদের মনোজগতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। শিক্ষার্থীরা পাঠ গ্রহণে, দক্ষতা অর্জনে কতটুকু সক্ষম হলো তা নানাভাবে মূল্যায়ন করে শিক্ষক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
নিঃসন্দেহে বলা চলে- একজন শিক্ষক চৌকস প্রতিভার অধিকারী হবেন। যে কোন সময়ে যে কোন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সক্ষম হবেন। অর্থাৎ শিক্ষকতার এই মহান পেশায় সফল হতে হলে নিজেকে প্রথমেই পারদর্শী হতে হবে। অবশ্যই সার্বিক বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জন করতে হবে। নিজে পারদর্শী না হলে অন্যকে পারদর্শী করে গড়ে তুলতে পারবেননা। জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২২ অনুযায়ী শ্রেণিভিত্তিক এবং শিখন অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষার্থীদের যেভাবে পারদর্শী করে তোলার কথা বলা হয়েছে তার কারিগর হিসেবে নিজেকে তথা শিক্ষককে সেভাবে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। তবেই আপনি নিজেকে সফল শিক্ষক হিসেবে পরিচয় দিতে পারবেন। এর এ লক্ষ্যে শিক্ষকতা পেশাকে মনে প্রাণে ধারণ এবং গ্রহণ করা আবশ্যক। নতুবা এ পেশা বাদ দিয়ে নতুন পেশায় যুক্ত হওয়া সমুচিত বলে মনে করি। কেননা, আপনি ‘মানুষ গড়ার কারিগর’- এই বাক্যকে অসম্মানিত করে এ পেশায় থাকতে পারেননা। সবিনয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের নিকট প্রত্যাশা যেন শিক্ষা প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহীতার নিরপেক্ষতা বজায় থাকে। তা না হলে শিক্ষকদের মনোবল হারিয়ে যাবে অপপ্রীতির গ্যাড়াকলে। শিক্ষকদের যথাযথ পরিবেশ ও মর্যদা নিশ্চিত করে জাতীয় শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সফলতার দ্বার উন্মোচন করা আজ সময়ের দাবি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রায়শই শিক্ষকদের ব্যবস্থা করে থাকেন। জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২২ বাস্থবায়নেও প্রশিক্ষণ চলমান। সুতরাং আপনি যতই প্রশিক্ষণ পাবেন ততই পারদর্শী হবেন। আর আপনি যতই পারদর্শী হবেন ততই শিক্ষার্থীদের পারদর্শী করে গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন।
লেখক : মাস্টার ট্রেইনার (বাংলা)
শিক্ষক, কবি ও প্রাবন্ধিক