জাতিসংঘে বাংলায় ১৭তম ভাষণ

1

 

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি মহাকালের মহানায়ক স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের দুঃখী-অসহায়-অভাবী মানুষের জন্য একটি লাল-সবুজের পতাকার মুক্ত মাতৃভূমি উপহার দিয়েছিলেন। ছাত্রজীবন থেকে বঙ্গবন্ধু বাংলার দরিদ্র মানুষের দুঃখ-দুর্দশা-যন্ত্রণা ভবনায় ব্যথিত থাকতেন। দিনের পর দিন এক বেলা খাবার জোগাড় করতে না পারা, মাথা গোঁজার ঠাই না পাওয়া, মায়ের কোলে রোগে শোকে ধুঁকে ধুঁকে শিশুর মৃত্যু হওয়া ইত্যাদিসহ বঞ্চিত বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সর্বাঙ্গীণ মুক্তিই ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের কেন্দ্রবিন্দু। ফলশ্রæতিতে অসাধারণ নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর, বিশ্বপরিমন্ডলে এক স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে বাঙালি জাতিকে প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত সফল হয়েছিলেন। স্বাধীনতার অর্থবহতায় বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলার মানুষ অন্ন পাবে, বস্ত্র পাবে, উন্নত জীবন পাবে।’
বাংলাদেশে যখন ৮০ শতাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে বাস করছে; তখন স্বাধীনতার সুফল ঘরে ঘরে পৌঁছাতে পারে সেজন্য বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ‘সোনার বাংলা’ বলতে বুঝতেন ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ। গণবিপ্লবের পর প্রতিটি সমাজ-দেশে একটা বিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। তখন সমাজে কিছু মানুষ অর্থ-বিত্তের দিকে হঠাৎ করে ঝুঁকে পড়েন: আর যারা পূর্ব থেকে বিত্তশালী ছিলেন তাঁরা তাদের সাথে তাল মেলাতে পারেন না। তখন বাংলাদেশে আরেক সমস্যা বিরাজিত ছিল। স্বাধীনতার ঘোষণা বিরোধিতাকারী পাকিস্তানিদের হাতে গড়া দালাল, রাজাকার, আল বদর, আল-শামস্ বাহিনী কর্তৃক গণহত্যা, লুটপাট, নারী নির্যাতন ও নানা যুদ্ধাপরাধসহ বহু কুকর্মে লিপ্ত ছিল। অনেকে রাতারাতি বেশ পাল্টে সাধারণ মানুষ-কমিউনিস্টি পার্টি বা অন্যান্য আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টির সঙ্গেও মিলেমিশে যাওয়ায় সমাজে তৈরি হয় একটা ব্যাপ্ত অস্থিরতা। স্বাধীনতার অর্জনকে ব্যর্থ করতে; মুক্তিযুদ্ধের ‘প্রতিশোধ’ নিতে তৎপর এই গোষ্ঠী প্রকাশ্যে বিশ্বস্ত ও প্রচ্ছন্নে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থেকে তারা স্বাধীনতাকে ব্যর্থ করতে মরিয়া ছিল।
একদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে আবার নতুন করে গড়ে তোলা, শহীদ পরিবারের সদস্যদের পুনর্বাসন, যুদ্ধাহত নির্যাযিত নারীদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন, বিধবা-এতিমদের দেখাশুনা, নতুন বাংলাদেশকে একটা স্বনির্ভর দেশ হিসেবে গড়ে তোলা অন্যদিকে ঐসব অশুভ-অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই বঙ্গবন্ধুকে তখন এক দুরূহ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখী করেছিল। দেশের করুণ অর্থনীতি, যুদ্ধের সময় কৃষকদের ফসল ফলাতে না পারা এবং গুদামে পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক আগুন দেওয়ায় খাদ্যশস্যের শূন্য মজুদ ও ব্যাংকে কোন টাকা না থাকায় বন্ধুপ্রতিম দেশের সহযোগিতায় দেশ গড়ার এই কঠিন কাজে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী-মুক্তিকামী মানুষদের সাথে নিয়ে বঙ্গবন্ধু ব্রতী হন নতুন সংগ্রামে। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে একটি নতুন রূপদান করে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ৭ শতাংশের বেশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে দেশকে প্রায় স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদায় সমাসীন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ২৯তম অধিবেশনে প্রথম বাংলায় ভাষণ প্রদান করে বাঙালি জাতি এবং বিশ্বের সকল বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জন্য দিনটিকে অবিস্মরণীয় করে রেখেছেন। বাংলা ভাষাকে বিশ্ব দরবারে অধিকমাত্রায় মর্যাদাসীন করা যুগান্তকারী এই ভাষণটি বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের ৮ম দিনে। ভাষণের শুরুতে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘জনাব সভাপতি, আজ এই মহামহিমান্বিত সমাবেশে দাঁড়াইয়া আপনাদের সাথে আমি এই জন্য পরিপূর্ণ সন্তুষ্টির ভাগীদার যে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ এই পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করিতেছেন। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পূর্ণতা চিহ্নিত করিয়া বাঙালি জাতির জন্য ইহা একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। স্বাধীনভাবে বাঁচার আধিকার অর্জনের জন্য এবং একটি স্বাধীন দেশে মুক্ত নাগরিকের মর্যাদা নিয়া বাঁচার জন্য বাঙালি জনগণ শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী সংগ্রাম করিয়াছেন, তাঁহারা বিশ্বের সকল জাতির সাথে শান্তি ও সৌহার্দ্য নিয়া বাস করিবার জন্য আকাঙ্খিত ছিলেন। যে মহান আদর্শ জাতিসংঘ সনদে রক্ষিত আছে, আমাদের লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই আদর্শের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করিয়াছেন। আমি জানি, শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সকল মানুষের আশা-আকাঙ্খা বাস্তবায়নের উপযোগী একটি বিশ্ব গড়িয়া তোলার জন্য বাঙালি জাতি পূর্ণ প্রতিশ্রæতিবদ্ধ, আমাদের এই অঙ্গীকারের সাথে শহীদানের বিদেহী আত্মাও মিলিত হইবে। ইহা বিশেষ আনন্দের ব্যাপার যে স্বাধীনতাযুদ্ধের একজন সক্রিয় যোদ্ধা সভাপতি থাকাকালেই বাংলাদেশকে এই পরিষদের অন্তর্ভুক্ত করিয়া নেওয়া হইয়াছে।’
বঙ্গবন্ধু সেই অমিয় ভাষণে যাঁদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ বিশ্বদরবারে স্থানলাভ করেছে, বাংলাদেশের দীর্ঘ সংগ্রামে যেসব দেশ ও জনগণ সমর্থন দিয়েছে, দেশের স্বাধীনতা সংহতকরণ-পুনর্গঠন-ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সাহায্যকারী দেশ এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশকে যাঁরা স্বাগত জানিয়েছে তাঁদের সকলের প্রতি আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। সমগ্র বিশ্বে শোষণ-নির্যাতন-নিষ্পেষণের শিকার সুবিধা-অধিকারবঞ্চিত জাতি-গোষ্ঠীর অধিকারের স্বপক্ষে বলিষ্ঠকন্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বিশ্বের বহু অংশে এখনো অবিচার ও নীপিড়ন চলিতেছে। অবৈধ দখলকৃত ভূখন্ড পুরাপুরি মুক্ত করার জন্য আমাদের আরব ভাইদের সংগ্রাম অব্যাহত রহিয়াছে এবং প্যালেস্টাইনি জনগণের বৈধ জাতীয় অধিকার এখনো পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয় নাই। উপনিবেশ বিলোপ প্রক্রিয়ার যদিও অগ্রগতি হইয়াছে, কিন্তু এই প্রক্রিয়া এখনো চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছায় নাই, বিশেষ করিয়া অফ্রিকার ক্ষেত্রে এই সত্যটি স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। এই অঞ্চলের জিম্বাবুয়ে (দক্ষিণ রোডেশিয়া) এবং নামিবিয়ার জনগণ জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য দৃঢ়তার সাথে লড়াই করিয়া যাইতেছে। বর্ণবৈষম্যবাদ, যাহাকে মানবতার বিরোধী বলিয়া বার বার আখ্যায়িত করা হইয়াছে, তাহা এখনো আমাদের বিবেককে দংশন করা অব্যাহত রাখিয়াছে।’
বঙ্গবন্ধুর উল্লেখ্য ভাষণের প্রতিপাদ্য অন্যান্য বিষয়সমূহ ছিল; স্বল্পভোগী মানুষের অনাহারের মুখে পতিত হওয়া, খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ম্বরতা অর্জনে প্রয়োজনীয় উৎপাদন সহায়ক সামগ্রীর ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি ও দুস্প্রাপ্যতা, মানবিক সংহতি-ভ্রাতৃত্ববোধ-পারস্পরিক স্বনির্ভরতার স্বীকৃতিতে এই পরিস্থিতির যুক্তিযুক্ত সমাধানে মহাবিপর্যয় পরিহারে জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণের আবশ্যকতা, মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক ঘোষণা অনুযায়ী প্রত্যেক মানুষের মুক্তভাবে অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সুবিধা ভোগের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিতকল্পে আন্তর্জাতিক দায়িত্বের পুনরুল্লেখ, অস্ত্র প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণ, সমঝোতার অগ্রগতি-উত্তেজনা প্রশমন-অস্ত্র সীমিতকরণ ও শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান নীতির সম্প্রসারণের লক্ষ্যে এশিয়া-আফ্রিকা-ইউরোপ-ল্যাটিন আমেরিকাসহ বিশ্বের যে কোন অংশে গৃহীত প্রচেষ্টাকে স্বাগত ও সমর্থন জানানো, শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান-সার্বভৌমত্ব-আঞ্চলিক অখন্ডতার প্রতি শ্রদ্ধা এবং অন্যের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতির ভিত্তিতে প্রতিবেশী সকল দেশের সাথে বাংলাদেশের সৎপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক বজায় রাখার অঙ্গীকার এবং বিশ্বশান্তি অন্বেষার সকল উদ্যোগের প্রতি পরিপূর্ণ সমর্থন অব্যাহত রাখাসহ আরও অনেক বিষয়ে বঙ্গবন্ধু আলোকপাত করেছিলেন।
ধারাবাহিকতায় জাতির জনকের সুযোগ্য তনয়া প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা পিতার আরাধ্য বাঙালি জাতীয়তাবাদের উৎসভিত্তি মাতৃভাষা বাংলাকে সমুন্নত রাখার আদর্শ অনুসরণে বিগত বছরগুলোর ন্যায় এবারও ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) ৭৬তম অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ প্রদান করেন। তিনি ভাষণে প্রণিধানযোগ্য তেজোদীপ্ত উচ্চারণে মহামারী করোনা-জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবেলা এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন ইস্যুতে সুনির্দিষ্ট ৬ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রস্তাবগুলো হচ্ছে- কভিডমুক্ত বিশ্ব গড়তে টিকার সর্বজনীন ও সাশ্রয় মূল্যে প্রাপ্যতা নিশ্চিতকরণ, ধনী ও শিল্পোন্নত দেশের কার্বন নিঃসরণ হ্রাস-ক্ষতিপূরণ এবং টেকসই অভিযোজনে অর্থায়ন-প্রযুক্তি হস্তান্তর, শিক্ষাব্যবস্থাকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য ডিজিটাল সরঞ্জামাদি-সেবা-ইন্টারনেট ও শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগ, আরো প্রণোদনাভিত্তিক এলডিসি উত্তরণ কাঠামো, অভিবাসীদের কল্যাণ নিশ্চিত এবং রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জোরালো ভূমিকা-সহযোগিতা।
দেশরত্ন শেখ হাসিনা ভাষণে করোনা টিকাকে ‘বৈশ্বিক সম্পদ’ হিসেবে বিবেচনার জন্য বিশ্বনেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বৈশ্বিক করোনা মহামারী মোকাবেলায় তিনি কিছু প্রস্তাবও তুলে ধরেন। এই মহামারী আরও বেশি দিন স্থায়ী হওয়ার আশঙ্কায় তিনি এ অভিন্ন শত্রু প্রতিহতে অতীতের চেয়ে অনেক বেশি নতুন-অন্তর্ভুক্তিমূল ও বৈশ্বিক পরিকল্পনা গ্রহণ করার আহŸান জানান। করোনা মহামারী জরুরী পরিস্থিতি উত্তরণে কার্যকর-প্রায়োগিক বৈশ্বিক উদ্যোগের ঘাটতির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটি বৈশ্বিক সংহতি ও সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার উপরেও আলোকপাত করেছে। সর্বজনীন বিষয়গুলোতে আমাদের অবশ্যই একসঙ্গে কাজ করতে হবে। নতুন নতুন অংশীদারিত্ব ও সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে। সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশগুলো এই জাতিসংঘের মঞ্চ থেকেই তা শুরু করতে পারে। তবেই আমরা সহনশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উত্তরণের লক্ষ্যে একটি অর্থবহ সহযোগিতা অর্জন করতে পারব। এই ক্রান্তিলগ্নে জাতিসংঘই হোক আমাদের ভরসার সর্বোত্তম কেন্দ্রস্থল। আসুন, সেই ভরসাকে বাঁচিয়ে রাখার প্রত্যয়ে আমরা সবাই হাতে হাত মিলিয়ে একযোগে কাজ করি।’ বাংলাদেশ ও দেশের সরকারকে মারাতœক সংকট ও চ্যালেঞ্জে নিপতিত করা বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর স্বদেশে প্রত্যাবর্তন বিষয়ে ইতিপূর্বে বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ফোরামে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত সাহসী ও নির্ভিক মনোভাব প্রতিফলিত হয়েছিল। এক অত্যন্ত উঁচুমার্গের অন্যতম বিশ্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়কোচিত-রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব-সরকার প্রধান হিসেবে সুদৃঢ় এবং সুষ্পষ্টভাবে তিনি বলেছেন ‘এটি মিয়ানমার সরকারের সৃষ্ট সংকট, এই সংকট তাদেরই সমাধান করতে হবে। এই বিতাড়িত জনগোষ্ঠীকে স্বসম্মানে-স্বমর্যদায় সুরক্ষা নিশ্চিত করে তাদের দেশ মিয়ানমারে ফেরত নেওয়ার ব্যবস্থা করতেই হবে।’ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবনা ছিল ‘সেইফ জোন নির্মাণ এবং পূর্ণ মানবিক মর্যাদা-নিরাপত্তা-অধিকারের’ ভিত্তিতে তাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এই সমস্যার টেকসই এবং একমাত্র স্থায়ী সমাধান।
বিশ্বসভায় অতিসাম্প্রতিক প্রদত্ত ভাষণেও বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন বিষয়ে পুনরায় দৃঢ়চেতা কন্ঠে বিশ্ব নেতৃত্বের কার্যকর-সক্রিয় ভূমিকা ও অব্যাহত সহযোগিতার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। মানবিকতার শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শনে বাংলাদেশ সরকার ও জনগণ বিগত পাঁচটি বছর উদ্ভুত সকল সঙ্কট মোকাবেলা করে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কোন সদস্যকে বলপূর্বক মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর প্রয়াস গ্রহণ করেনি। সমকালীন মিয়ানমারে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের চলমান পরিস্থিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন অনিশ্চয়তায় পর্যবসিত হয়। দ্রুত এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানে যথোপযুক্ত পন্থা অনুসন্ধানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃশ্যমান হস্তক্ষেপ কামনা করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘মিয়ানমারকে অবশ্যই তার নাগরিকদের প্রত্যাবর্তনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সহযোগিতা করতে সদা প্রস্তুত। আর আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি-রোহিঙ্গা সঙ্কটের সৃষ্টি মিয়ানমারে, সমাধানও রয়েছে মিয়ানমারে। রাখাইন রাজ্যে তাদের মাতৃভূমিতে নিরাপদ-টেকসই ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমেই কেবল এ সঙ্কটের স্থায়ী সমাধান হতে পারে। সেই জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই গঠনমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।’
কথিত বিরোধীদলের পক্ষ থেকে কেবল বিরোধীতার জন্যই রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির অপপ্রয়োগে সিদ্ধহস্ত কুশীলবদের নানামুখী অপপ্রচার-জঙ্গী প্ররোচনা-দেশকে অস্থিতিশীল করার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কদর্য কার্যক্রম রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে নূন্যতম ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে না। পক্ষান্তরে প্রতিহিংসা-প্রতিশোধপরায়ণতায় নিজেদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা আড়াল ও জনগণকে বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যে যারপরনাই মিথ্যাচার-পাপাচার-কদাচার-সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে নিজেদের জঘন্য স্বার্থ চরিতার্থে নৈতিকতকা-শিষ্টাচার বর্হিভূত কর্মকান্ড অব্যাহত রেখেছে। গভীর পরিতাপের সাথে দেশবাসী পর্যবেক্ষণ করছে, উচুঁমাত্রিকতায় উন্নয়নের সকল সূচকে দেশ যখন অপ্রতিরোধ্য-অদম্য অগ্রগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে; অপাংক্তেয়-অযাচিত-অযৌক্তিক কর্মসূচির বহিঃপ্রকাশে অশুভ শক্তি প্রচÐ তৎপর রয়েছে। মূলতঃ উন্নয়ের পথে প্রতিবন্ধকতা-অন্তরায় সৃষ্টি ও সাবলীল ধারাকে বাধাগ্রস্ত করার অশুভ চক্রান্ত ও অন্ধকারের শক্তির আঁতাত দেশবাসীকে হতাশাগ্রস্ত করছে। সমগ্র জনগণের আশা-আকাঙ্খাকে ভূলুন্ঠিত ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় আপামর জনগণের ঐক্যবদ্ধ দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেদ করে তারা কখনোই কোন অপকর্ম সাধনে সফল হতে পারবে না – এটিই দেশবাসীর সুদৃঢ় বিশ্বাস।
বিশ্বসভায় ১৭তম ভাষণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য শুধু নয়; দেশ ও বিশ্বের সকল বাঙালির অভূতপূর্ব আনন্দ ও অপরাজেয় দিগ¦লয় নির্মিত হয়েছে। পুরো দেশ যখন তাঁর ৭৫তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপনে বিপুল উদ্বেলিত; চারদিন পূর্বেই এই ভাষণ ও ‘এসডিজি অগ্রগতি পুরষ্কার’ প্রাপ্তি রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার গৌরবদীপ্ত পরিচিতিকে সমধিক অত্যুজ্জ্বল করেছে। অধিকন্তু দেশোন্নয়ন-বিশ্বপরিমন্ডলে দেশের সামগ্রিক ভাবমূর্তিকে সমুজ্জ্বল করার জন্য জাতিসংঘ মহাসচিব কর্তৃক তাঁর দুর্দমনীয় নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা প্রকৃত অর্থে দেশকে নবতর আলোকোজ্জ্বল ঠিকানায় অধিষ্ঠিত করেছে। একই মঞ্চে বার বার এরকম ভাষণ সরকার প্রধান হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্ব-তাৎপর্যপূর্ণ সৌভাগ্যের বিষয়। কিন্তু এটি অস্বীকার করার অবকাশ নেই যে, তাঁরই পিতা মুক্তির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর বাংলা ভাষায় প্রথম ভাষণ প্রদানের স্মৃতি তাঁর আনন্দাবেগের সাথে যুক্ত হয়ে যায় শোকাতুর মনস্তাত্তি¡ক কাতরতা। পরিবারের প্রায় সকল সদস্যদের হারানোর ব্যথা ও হৃদয়ে রক্তক্ষরণের অদৃশ্য করুণ কাব্যগাঁথা বরাবরই অনুরণিত হয়ে আসছে। দেশবাসীর উপলব্ধিতে যন্ত্রণাকাতর এই অনুভূতি অবশ্যই হৃদয়স্পর্শী। দেশরতœ শেখ হাসিনার অন্তরের গভীরে ভাষণরত পর্যায়ে এই যাতনা কতটুকু মর্মপীড়ার কারণ; তা শুধু তিনিই হৃদয়াঙ্গম করতে পারেন। প্রাসঙ্গিকতায় কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার’র ‘বুঝিবে সে কিসে’ কবিতার কিছু পংক্তি উপস্থাপন করতে চাই। ‘চিরসুখীজন ভ্রমে কি কখন/ ব্যথিতবেদন বুঝিতে পারে?/ কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে? কভু আশীবিষে দংশেনি যারে?/ যতদিন ভবে, না হবে না হবে,/ তোমার অবস্থা আমার সম।/ ঈষৎ হাসিবে, শুনে না শুনিবে/ বুঝে না বুঝিবে, যাতনা মম।’

লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়