জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা

12

মোহাম্মদ শফর আলী

[ পূর্ব প্রকাশের পর ]
যশোরে আমাকে বাধা দেয়া হয় এবং আপত্তিকর বক্তৃতার অভিযোগে ঢাকা থেকে পাঠানো এক পারোয়ানা বলে আমাকে গ্রেপ্তার করা হলো। যশোর মহকুমা হাকিমের নিকট হাজির করা হলে তিনি আমাকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করেন। ঢাকা ফেরার পর সদর মহকুমা হাকিমের নিকট হাজির হলে তিনি আমার জামিনের আবেদন প্রত্যাখ্যান করলেন। সে দিনই দায়রা জজ আমার জামিন মঞ্জুর করায় আমি মুক্তি পেলাম। সন্ধ্যায় ৭ টাকা আমি বাড়ী পৌঁছি। এক ঘন্টা পর রাত ৮ টায় পুলিশ আর একখানা গ্রেপ্তারি পারোয়ানা নিয়ে আমার বাড়ীতে হাজির হয়। সিলেটে আপত্তিকর বক্তৃতা দেবার অভিযোগে এই পারোয়ানা সেখান থেকে পাঠানো হয়েছিল। পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করে সে রাতে আমাকে পুলিশ প্রহরাধীনে সিলেট নিয়ে যাওয়া হয়। পরদিন সকাল বেলায় মহকুমা হাকিম আমার জামিনের আবেদন প্রত্যাখান করে আমাকে হাজতে পাঠালেন। এর পরের দিন সিলেট মাননীয় দায়রা জজ মেহরবানি করে আমাকে জামিন দেন। আমি মুক্তি পেলাম, কিন্তু জেল গেটে নতুন পারোয়ানা বলে পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করলো। মোমেন শাহীর জনসভায় আপত্তিকর বক্তৃতা দেওয়ার অভিযোগে সেখান থেকে এই পারোয়ানাটি পাঠানো হয়। সেদিন রাত্রেই পুলিশ প্রহরাধীনে আমাকে সিলেট থেকে ময়মনসিংহে নিয়ে যাওয়া হয়। পরদিন ময়মনসিংহ মহকুমা হাকিমের নিকট আমাকে হাজির করা হলে তিনি আমার জামিনের আবেদন প্রত্যাখান করে আমাকে জেল হাজতে পাঠালেন। ১৯৬৬ সালের এপ্রিল মাসেই এই ধারাবাহিক গ্রেপ্তার আর হয়রানি করা হয়। পরদিন ময়মনসিংহের মাননীয় দায়রা জজ আনার জামিন মঞ্জুর করেন। আমি হাজত থেকে মুক্তি পেয়ে ঢাকা ফিরে এলাম।
১৯৬৬ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে সম্ভবতঃ ৮ই মে নারায়নগঞ্জের এক জনসভায় বক্তৃতা করে আমি রাত প্রায় একটার সময় বাড়ীতে ফিরে আসি। সে রাতেই ১টার সময় পুলিশ দেশ রক্ষা আইনে ৩২ ধারায় আমাকে গ্রেপ্তার করে। এরপর আমার দলের বহু সংখ্যক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুদ্দিন আহমেদ। পাকিস্তান আওয়ামীলীগের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট মুজিবুর রহমান। চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক এম.এ আজিজ, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগের কোষাধ্যক্ষ নুরুল ইসলাম চৌধুরী। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগের শ্রম সম্পাদক জহুর আহমেদ চৌধুরী সহ শত শত নেতা কর্মী। পূর্ব পাকিস্তানের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় বাংলা দৈনিক পত্রিকা “ইত্তেফাক” বন্ধ করে দিলেন। ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিঞা পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আমার বোনের ছেলে শেখ ফজলুল হক মনি এবং অপর ছাত্র নেতা শেখ শহীদুল ইসলামকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। আমার উপর নির্যাতন গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে আমার দল ৭ জুন সাধারণ ধর্মঘট আরম্ভ করে। এই ধর্মঘটের দিন ঢাকা-নারায়নগঞ্জে পুলিশের গুলিতে ১১ জন নিহত হয়। প্রায় ৮০০ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। বহু সংখ্যক লোকের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আবদুল মোনেম খান কিছু সংখ্যক অফিসার এবং অন্যান্যদের নিকট প্রায়ই প্রকাশ্যে বলে থাকেন যে, যতদিন তিনি ক্ষমতায় থাকবেন ততদিন শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে থাকতে হবে। একথা প্রায় সকলেই জানেন, আটকের পর থেকেই আমাকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে বহু সংখ্যক মামলার বিচারের সম্মুখিন হতে হয়। এই সময় ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে আদালতের অধিবেশন বসতো। প্রায় ২১ মাস আট থাকার পর ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি দিবাগত রাত একটার সময় আমাকে মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু জেল গেট থেকে কয়েকজন সামরিক ব্যক্তি বলপূর্বক আমাকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসে এবং একটি বন্ধ কামরায় আমাকে আটক রাখে। কারো সঙ্গে দেখা করতে দেয় না, দীর্ঘ পাঁচ মাস যাবত আমাকে দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছে। বিবাদীদের পক্ষ থেকে কয়েকজনকে সাক্ষী হিসাবে ট্রাইবুনালে সাক্ষী হিসাবে যখন সাক্ষী দিতে দাঁড়ান তারা বিবাদী থেকে কিভাবে সাক্ষী হলেন তার লৌমহস্য ঘটনা আদালতে প্রকাশ করেন। বাংলা দৈনিক পত্রিকা “আজাদ” ও “পূর্ব দেশ” আদালতের বলা লৌমহর্ষক কাহিনী প্রতিদিন প্রকাশ করতো। বৈরী স্বাক্ষীদের স্বাক্ষ পাঠ করে সারা দেশের মানুষের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য পাগল হয়ে উঠে, ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে দেশ ব্যাপী গড়ে উঠা ছাত্র আন্দোলন গণ অভ্যুত্থানে রূপনেয়। এরই মধ্যে পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলে আয়ুব খানের শাসনের বিরুদ্ধে গণ অভ্যুত্থ্যান সৃষ্টি হয়ে গেল। আগরতলা মামলা বৈরী সাক্ষীদের নির্যাতনের যে সকল কাহিনী দৈনিক আজাদ ও পূর্বদেশে প্রকাশ হয়, তাতেই বাংলার মানুষ আর ঘরে বসে না থেকে চল চল কুর্মিটোলা চল, জেলে তালা ভাংবো, শেখ মুজিবকে আনবো। আমার নেতা তোমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব। আমার তোমার ঠিকানা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা।
পিন্ডিনা-ঢাকা শ্লোগানে শ্লোগানে সমগ্র এক গণবিপ্লব সৃষ্টি হলো। প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান বাধ্য হয়ে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রæয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বিনা শর্তে প্রত্যাহার করলেন। এই মামলা প্রত্যাহার সম্পর্কে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভাইস এ্যাডমিয়্যাল এ.আর. খান এক প্রেস রিলিজে বলেন ‘জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করার পরে মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়েছে। সকল বিভ্রান্তির আবসানের জন্য ট্রাইবুন্যাল বাতিল করা হলো। তাই শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেওয়া হল।’ ৬ দফা আগরতলা মামলা আওয়ামীলীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলার একক নেতা বানিয়ে দেন। শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধু উপাধিতে বাংলার মানুষের হৃদয়ে স্থান করেন।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা সহ-সভাপতি, জাতীয় শ্রমিক লীগ, কেন্দ্রীয় কমিটি