জাতির দুঃসময়ের কাণ্ডারি চার জাতীয় নেতাকে সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করছি

10

এমরান চৌধুরী

ত্রিশ লক্ষ শহিদের এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা যে দেশের স্বাধীনতা অর্জন করেছি, এ স্বাধীনতার জন্য যাঁদের অপরিসীম ত্যাগ ছিল তাঁদের আমরা স্বাধীন দেশের মাটিতে বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি। স্বাধীন দেশের একজন নাগরিক হিসেবে এটা আমাদের জন্য কত বড় লজ্জার, কত বড় কলঙ্কের তা পরিমাপ করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর সভ্য দেশের মানুষ বাঙালি নাম শুনলেই নাক সিঁটকায়। ঘেন্নায় মুখ ফিরিয়ে নেয়। বাঙালি নাম ধরে তাঁরা তাঁদের ভাষায় অকৃতজ্ঞ, অমানুষ এ রকম যত তিক্ত বিশেষণ প্রয়োগ করা যায়, সবটাই করে। বঙ্গবন্ধুকে নির্মভাবে সপরিবারে হত্যার পর পৃথিবীর বুকে দুটো দেশ খুশি হয়েছিল বা শান্তি পেয়েছিল। দৃঃখের বিষয় দুটো দেশই ছিল মুসলিম দেশ, একটি পাকিস্তান, অন্যটি সৌদি আরব। পাকিস্তান এত বেশি খুশি হয়েছিল যে সেদিনই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এ থেকে একটা বিষয় দিব্যলোকের মতো স্পষ্ট যে খোন্দকার মোশতাক আহমদ আর তাঁর সহযোগী খুনির দল সবাই পাকিস্তানের আশির্বাদপুষ্ট ছিল। অন্যদিকে বিশ্বের সবকটি দেশ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাÐে সোচ্চার হয়। জার্মান চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ট আক্ষেপ করে বলেছিলেন, মুজিব হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যারা মুজিবকে হত্যা করেছে, তারা যে কোনো জঘন্য কাজ করতে পারে (খ্যাতিমানদের চোখে বঙ্গবন্ধু, মুনতাসির মামুন, বাশিএ, ৭২০, পৃষ্ঠা -২৮)। তখনকার বৃহত্তম মুসলিম দেশ ছিল ইন্দোনেশিয়া। সে ইন্দোনেশিয়ার জাতির জনক সুকর্ত’র ভাবশিষ্য সুদানো বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে বলেছিলেন, ‘আমরা ইন্দোনেশিয়ার প্রগতিবাদীরা তাঁর মাঝে আমাদের নেতা সুকর্তকে খুঁজে পেয়েছিলাম। তোমরা তাঁকে মেরে ফেললে ? ক্ষতি যে কত বড়, বাইরেরর লোকেরা তা যত বেশি বুঝতে পেরেছে, তোমরা বাঙালিরা তা পারোনি। তোমরা আমাদের মতোই দুর্ভাগা। আমরাও সুকর্তকে রাখতে পারিনি, তবে তাঁকে আমরা হত্যা করিনি। সেদিক থেকে আমরা ভালোই আছি (খ্যাতিমানদের চোখে বঙ্গবন্ধু, ঐ)।’
আমার এক বন্ধু অনেকদিন বিদেশে ছিল।ছিয়াত্তর সাতাত্তরের মাঝামাঝি কোনো এক সময় সে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে চাকুরি নিয়ে গিয়েছিল । বেশ কয়েক বছর চাকুরি করে দেশে ফেরার পর একদিন তাঁর সঙ্গে দেখা। কুশল বিনিময় করতে করতে আমরা ঢুকে পড়ি একটা রেস্তোরাঁয়। এটা ওটা নিয়ে কথা বলার পর আসল বঙ্গবন্ধু ও জেলহত্যা প্রসঙ্গ। এ প্রসঙ্গ আসতেই তার মুখে কে যেন ছাই ছিটিয়ে দিল। অসম্ভব ফ্যাকাশে হয়ে গেল তার মুখখানা।
বলল, জানিস ভাই! বিদেশে বাঙালিদের হারামি বলে। আমি বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলাম, কেন! কেন হারামি বলবে ?
সে বলা শুরু করল এক মধ্যদুপুরের ঘটনার কথা। ভাড়া করা একটি গাড়িতে করে সে তার কর্মস্থলে যাচ্ছিল। ড্রাইভার বাঙালি না হলেও বাংলাদেশের খবর রাখত এবং একটু আধটু বাংলা বলতে পারত। কথায় কথায় যখন সে জানতে পারল তার গাড়ির যাত্রী বাংলাদেশের মানুষ। তখন তার চক্ষুজোড়ায় আগুনের হল্কা ফুটতে থাকল। প্রচÐ ঘৃণার রেখা ফুটে উঠল তাঁর চোখেমুখে। গন্তব্যে পৌঁছার পর ড্রাইভার আমার বন্ধুটিকে বলল, তোমরা বাঙালিরা হারামি! বন্ধুটি চমকে ওঠে প্রতিবাদের সুরে কিছু একটা বলতে যাওয়ার আগেই সে বলল, তোমরা না বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছ!
বন্ধুটি এতদিন বঙ্গবন্ধু কত বড় মাপের মানুষ তা চিন্তা করেনি। কিন্তু সামান্য একজন গাড়ি চালক, তাও আবার বিদেশির কাছে বঙ্গবন্ধুর জন্য আকুতি দেখে তার অন্তর চোখ খুলে গেল। সে বুঝতে পারল আসলেই আমরা অকৃতজ্ঞ, হারামি। তা যদি না হয় আমরা কীভাবে জাতির জনকে হত্যা করি, তাও আবার সপরিবারে। যে সময়টায় একজন মুসলমান হিসেবে ফারুক, রশিদ, ডালিম গংদের মসজিদে থাকার কথা, আল্লাহকে ডাকার কথা, সে সময়টায় তারা গিয়েছিল ধানমÐির বত্রিশ নম্বর বাড়িতে আশরাফুল মাখলুকাত নিধনে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর জার্মান চ্যান্সেলর যে কথাটি বলেছিলেন ( বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না) তা প্রমাণিত হতে সময় লেগেছিল মাত্র ৭৯ দিন। এই ৭৯ দিনের মাথায় ঘটে জাতীয় জীবনে সংঘটিত হয় আরেক হারামির ঘটনা। পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙালিরাই ফের রচনা করে নতুন ইতিহাস। এবার সরাসরি জেলখানার ভেতরে ঢুকে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে একাত্তরের পরাজিত শক্তির মদদপুষ্ট খন্দকার মোশতাক আহমদ ও জেনারেল জিয়াউর রহমানের অনুগত দেশদ্রোহীর দল। তারা জাতীয় চার নেতা মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ, অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী এ.এইচ.এম কামারুজ্জামানকে হত্যা করে। কেন এই হত্যাকাÐ ? ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ও ১৪ ডিসেম্বর যে উদ্দেশ্যে পাকিস্তানি হায়েনা ও তাদের দোসর আল বদর, আলশামসরা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল ঠিক একই উদ্দেশ্যে ফারুক রশিদ গং বাংলাদেশকে মেধা ও নেতৃত্বশূন্য করতে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করেছিল।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর পলাশী যুদ্ধের বিশ^াসঘাতক সেনাপতি মীর জাফর আলী খানের প্রেতাত্মা বাংলাদেশের তৎকালীন বাণিজ্য মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ খুনি ফারুক-রশিদ গং এর কাঁধে ভর করে ক্ষমতায় আসীন হয়। তাদের স্বপ্ন ছিল দেশকে পাকসার জমিন শাদ বাদ এ ফিরিয়ে নেওয়া। সেই ফিরিয়ে নেওয়ার কাজটি শুরু করেছিল খন্দকার মোশতাক আহমদ রাতারাতি জয় বাংলা ¯েøাগান পাল্টিয়ে দিয়ে। জয় বাংলার পরিবর্তে জাতীয় ¯েøাগান করা হয় বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। বাংলাদেশ বেতার তারা আওড়াতে পারত না বলে সেটিকে করা হয় রেডিও বাংলাদেশ। ১৫ আগস্ট হত্যাকাÐের সাত দিনের মাথায় (২২ আগস্ট) জাতীয় চার নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২৪ আগস্ট জেনারেল জিয়াকে সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ নিযুক্ত করা হয়। এই জিয়াউর রহমান ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলার খবর শোনার পরও দেশের প্রেসিডেন্টকে রক্ষায় এগিয়ে না গিয়ে আয়েশ করে ক্লিন সেভ করতে ব্যস্ত ছিলেন এবং খবরদাতাকে নির্বিকারভাবে বলেছিলেন (সো হোয়াট)-কি হয়েছে? এ প্রসঙ্গে সচেতন ও দেশপ্রেমিক নাগরিকের মনের ভেতর একটি প্রশ্ন আজও ঘুরপাক খায় তখন সেনা, নৌ, বিমান ও রক্ষী বাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব যারা ছিলেন তারা প্রেসিডেন্টকে রক্ষায় কেন এগিয়ে গেলেন না। প্রেসিডেন্টের সামরিক সচিব যদি যেতে পারে এবং প্রেসিডেন্টের প্রাণরক্ষায় জীবন উৎসর্গ করতে পারে তারা কেন একটি ঢিলও ছুঁড়তে পারল না? এসব প্রশ্ন যুগ যুগ ধরে আসবে ?
সেনাবাহিনীর ২৬ সেপ্টেম্বর খন্দকার মোশতাক এমন এক অর্ডিন্যান্স জারি করেন যাতে জাতির জনকের হত্যাকাÐে যারা অংশ নিয়েছিল তাদের কোনো বিচার করা হবে না মর্মে নির্দেশ জারি করা হয়। এই অর্ডিন্যান্সটির নাম কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স’। সংবিধান ও আইনের শাসন বিরোধী এই কুখ্যাত ইনডেমনিটির সুবাদে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাÐে জড়িত সেনা অফিসাররা ব্যারাকে ফিরে না গিয়ে প্রেসিডেন্ট ভবনে বসে দেশ পরিচালনায় হস্তক্ষেপ করতে থাকে। এ অবস্থায় বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সংঘটিত হয় এক সেনা অভ্যুত্থান। তিনি সেনাবাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হন। খালেদ মোশাররফের সেনা অভ্যুত্থানে ভড়কে যায় খন্দকার মোশতাক আহমদ ও তার অনুসারী বিপথগামী সেনা অফিসাররা। তারা চোখে সর্ষে ফুল দেখতে থাকে। প্রাণ বাঁচাতে তারা দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আর পালিয়ে যাওয়ার আগে সংঘটিত করে যায় আরেক পৈশাচিক হত্যাকাÐ জেল হত্যাকাÐ। এই জেল হত্যাকাÐের উদ্দেশ্য ছিল ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ যদি কখনো ক্ষমতায় আসীন হয় তারা যাতে চরম নেতৃত্ব শূন্যতায় ভোগে।
গত ৩ নভেম্বর ছিল সেই পৈশাচিক জেল হত্যাকাÐ দিবস। যে চার জন জাতীয় নেতাকে সেদিন হত্যা করা হয়েছিল তাঁরা ছিল জাতির দুঃসময়ের কাÐারী। বঙ্গবন্ধু অনুপস্থিতে তাঁরাই দীর্ঘ নয় মাস নানা বৈরী পরিবেশের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। একাত্তর সালে এই পরীক্ষিত নিখাদ সোনার মতো নেতারা না থাকলে স্বাধীনতার সোনার হরিণ অধরাই থেকে যেত। অথবা খন্দকার মোশতাক, জেনারেল জিয়া, ফারুক, রশিদের মতো মীর জাফরের হাতে পড়ে অনিশ্চিত হতে পারত বাংলার স্বাধীনতা। ৩ নভেম্বরের হত্যাকাÐের মোটিভ ছিল ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত, স্বাধীনতা বিরোধী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর সম্মিলিত ষড়যন্ত্র ও নীল নকশার বাস্তবায়ন। উভয় হত্যাকাÐের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের অর্জনসমূহ ধ্বংস, দেশকে নেতৃত্বশূন্য এবং পাকিস্তানি ভাবাদর্শ প্রতিষ্ঠা করা। তাই আমরা বাঙালিরা এই জাতীয় চার নেতার কাছে আজন্ম ঋণী। তাঁদের এই নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান / ক্ষয় নেই তার ক্ষয় নেই এর মতো ঋণ আমরা কখনো শোধ করতে পারবো না। আমরা জাতির দুঃসময়ের কাÐারি চার জাতীয় নেতাকে সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করছি।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক